"মেয়ে হয়ে জন্মেছে যখন,পরের ঘরে তো যেতেই হবে। যত তাড়াতাড়ি পাঠানো যায় ততই ভালো।দেখোনা,আমার যখন দশ বছর বয়স তখন এই সংসারে আমার পদার্পন।প্রথম প্রথম কোনো কাজই আমি ঠিকভাবে পারতাম না।কিন্তু ধীরে ধীরে সময়ের সাথে মানিয়ে নিতে নিতে আজ আমি এই পর্যায়ে।"
"মা,আপনার শাশুড়ি কখনো এই নিয়ে কিছু বলেনি?"
"মা অবশ্য বলতেন আমি কোনো কাজই ঠিকমতো পারি না।আমার সামনেই বলতেন।সত্যিই তো তখন সংসারের কোনো কাজই পারতাম না।তিনিই আমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে সংসারী হতে শিখিয়েছেন। "
মনোরমা আর সুললিতা উঠতেই যাচ্ছিলেন, এমন সময় বীণাবউদি আর লক্ষ্মীবউদি হাজির হলেন বাড়ির উঠোনে। দুজনকে দুটো মোড়া এগিয়ে দিয়ে সুললিতা দাঁড়িয়ে রইলো তাদের পাশে।
লক্ষ্মীবউদি আঁচল টেনে বসলেন,"এখন আপনি কেমন আছেন মাসিমা?"
" আছি " মনোরমা হাসলেন।
"মাসিমা, তাহলে আপনাদের কী মত?"
"কী বিষয়ে বলো তো বউমা?"
"কেন?বেয়াইমশাই যে অসীমদার সাথে কথা বললেন?"
"কই?অসীম তো আমায় কিছু বলেনি।"মনোরমা আর সুললিতার দৃষ্টিবিনিময় হলো।
বীণাবউদি গলা খাকারি দিয়ে বললেন,"হয়তো ভাবনা চিন্তা করে তারপর জানাতে চেয়েছে আপনাদের"
"যাই হোক,গেল বার লক্ষ্মীপূজোর পর আমাদের ওইদিকে আর গেলেন না যে মাসিমা"
"তোমরাও তো এলেনা। এখন বয়স হয়েছে,এপাড়া থেকে ওপাড়া যেন মস্ত দূরত্ব বলে মনে হয়।"
"তবে এবার কিন্তু আমাদের ওপাড়ার পূজোটা দেখে আসতে হবে মাসিমা।মায়ের প্রতিমাটা যা বানিয়েছে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে যেন প্রাণ ভরে যায়।"
"ওপাড়ার মূর্তি গড়া শেষ বুঝি?"
"তা কাজ প্রায় শেষ বললেই চলে।"
"তা বেশ।"
"তাহলে মাসিমা ওই কথাই রইলো।পূজোয় সপরিবারে আসতে হচ্ছে কিন্তু"
"ঠিক আছে বউমা।মায়ের দর্শনলাভ করে আসবো এবার সে যত দুরেই হোক না কেন।"
অসীম রায় সাইকেল নিয়ে উঠোনে থামলেন।বীণাবউদি আর লক্ষ্মীবউদি অসীম রায়কে নমস্কার করে মাথায় আঁচল টেনে বিদায় নিলেন।
অঙ্গনা শিউলি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ মা-কাকিমাদের কথা শুনছিল আর টপাটপ ফুল কুড়োচ্ছিলো,এখন শিউলি ফুলে তার কোল ভর্তি।বাবাকে দেখে এখন উঠোনের দিকে পা দিলো সে।
"এতক্ষণে বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়লো বুঝি?" সুললিতা মেয়ের দিকে তাকালেন।
"আমি বাড়িই ছিলাম, শিউলি গাছের নিচে, এই দেখোনা কতগুলো! আমি না তুললে বিনীদের গরুটা সব পাড়িয়ে ফেলতো"
মনোরমা মোড়া হাতে নিয়ে ঘরে চললেন।সুললিতা মেয়েদের পড়তে বসার কথা বলে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন।অঙ্গনা হাত মুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলের সামনে এলো।অবলাও অঙ্গনার পাশে এসে বসলো।টেবিল থেকে বিজ্ঞান বইটা হাতে নিয়ে খুললো সে।তখনই তার মনে পড়লো সত্যনারায়ণ মাস্টারমশায়ের কথা।আজ স্কুলে সাম্নাষিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার সময় অবলার নাম ছিল প্রথমে।সত্যনারায়ণ অবলার নাম পড়ার সময় তার চেহারায় অবাক হওয়ার একটা ব্যাপার লক্ষণীয় ছিল।সামান্য থেমে অবলাকে তিনি বললেন ছুটির পর তার সাথে দেখা করতে।তখন থেকে অবলার মনে তোলপাড় শুরু হলো।সে কি ভুল করলো কিছু?নাহলে মাস্টারমশায় কেন আলাদা করে দেখা করতে বললেন?এরপর অবলা যখন দেখা করতে গেল সত্যনারায়ণ তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
"তুমি অসীম রায়ের বড় মেয়ে না?"
অবলা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। সত্যনারায়ণ টেবিলে টোকা মেরে বললেন,
"তোমার বাবা মেয়েদের পড়ালেখার বিষয়ে এত সিরিয়াস অথচ নিজের বড় মেয়ের নাম রাখলেন অবলা...!!!না,না এটা কেমন কথা বলোতো!!"
অবলা কি বলবে বুঝতে পারছিলো না।অগত্যা চুপচাপই দাড়িয়ে রইলো।
"তুমি হয়তো ভাবছো আমি সামান্য একটা নাম নিয়ে কেন এত কথা বলছি।আসলে এর পেছনে কারণ আছে।কারণটা হলো এই যে,মানুষের নাম তার চিন্তা ভাবনা এমনকি জীবনেও অনেক বড় প্রভাব ফেলে।যেমন ধরো,তোমার নাম অবলা। এখন তুমি নিজেকে একজন নারী ভেবে নিজেকে দুর্বল আর অসহায় মনে করতে পারো।কিন্তু মনে রেখ,নারীরা মোটেই দুর্বল না।একদিক থেকে ভাবলে তারা ঈশ্বরের থেকেও শক্তিশালী। "
"ঈশ্বরের থেকেও! " অস্ফুটস্বরে শব্দ দুটি বেরিয়ে এলো অবলার মুখ থেকে।
"হ্যা।ঈশ্বরের থেকেও।অবাক হচ্ছো শুনে?অবাক হওয়ারই কথা। আচ্ছা, ভেবে দেখোতো,ঈশ্বর কি তার অলৌকিক ক্ষমতার ব্যবহার না করে আরেকজন ঈশ্বর সৃষ্টি করতে পারবেন?কিন্তু দেখো,নারীরা কোনো অলৌকিক শক্তি ছাড়াই সন্তান জন্ম দিতে পারে।নারীদের অপার ক্ষমতা যা তারা নিজেরাও জানে না।জানলে তারা কখনোই নিজেদের দুর্বল মনে করতো না আর সমাজে তাদের অবস্থান এতো নীচে হতো না"
সত্যনারায়ণ মাস্টারের প্রতিটি কথা অবলা যেন হৃদয় দিয়ে শুনছিলো।তার প্রতিটি কথায় অবলার মাথা থেকে পা পর্যন্ত যেন শীতল একটা স্রোত বয়ে যাচ্ছিলো।একজন পুরুষ হয়েও সমাজে নারীদের অবস্থান নিয়ে তিনি এত সচেতন!
"অবলা মা, মনে রেখ,পৃথিবীর সমস্ত শক্তি তোমার ভেতরে আছে।নিজেকে সম্পূর্ণভাবে জানলে আলাদা করে পৃথিবীকে আর জানতে হবে না।অবলা থেকে সবলা হওয়ার জন্য প্রতিটি পদক্ষেপ সাফল্যের সাথে অতিক্রম করতে হবে তোমাকে " এই বলে সত্যনারায়ণ অবলার হাতে একটা বই উপহার দিলেন।অবলা তাকে প্রণাম করে বইটা হাতে নিলো।"লেটার ফ্রম এ ফাদার টু হিজ ডটার"
এখন তার বইটির কথা মনে পড়লো।ব্যাগ থেকে বইটা বের করে টেবিলে রাখলো সে।সুললিতা ঘরে প্রবেশ করলেন।
"এই যে তোমাদের খাবার" বলে সুললিতা ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন।এমন সময় তার চোখ পড়লো খাটের ওপর।সেখানে পুটলির মতো যেন কি একটা মনে হচ্ছে দেখে।তিনি হাত দিয়ে পুটলিটায় ধাক্কা দিলেন।ওমনি পুটলিটা নড়ে উঠলো।অবলা আর অঙ্গনা তো হেসেই খুন।
"এই তোমার পড়াশোনা হচ্ছে বুঝি?" সুললিতা অপালার দিকে তাকিয়ে হাসি চেপে রেখে বললেন।
"আমার যে খুব ঘুম পাচ্ছে" অপালা ঘুমজড়ানো গলায় বললো।
সুললিতার বড্ড মায়া হলো মেয়েটার জন্যে।কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারবেন না।অসীম রায় যদি একবার দেখেন তো অনেক রেগে যাবেন।মেয়েদের পড়াশোনার বিষয়ে তিনি অত্যন্ত সচেতন। প্রতিদিনই মেয়েদের পড়ার ঘরে একবার এসে মেয়েদের পড়াশোনার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে যান।আজ য়তো এখনো আসেনি।তাই ছোটো মেয়ের কান্ডটা দেখতে পায়নি।সুললিতা হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। অপালাকে বই নিয়ে বসতে বলে তিনি আবার রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। সুললিতা বেরিয়ে যাবার কিছু মুহূর্ত পরই অসীম রায় ঘরে প্রবেশ করলেন।তিনি মেয়েদের খাটে গিয়ে বসলেন।
"বড় মা, তোর না আজ রেজাল্ট দেবার কথা?"
"হ্যা বাবা, দিয়েছে।আমি প্রথম হয়েছি।" বলে অবলা সত্যনারায়ণ বাবুর দেয়া বইটা দেখালো।
অসীম রায় বইটা হাতে নিলেন।"বাহ্, দারুণ বইটা।পড়াশোনার পাশাপাশি এসব বই পড়াও ভালো।"
অঙ্গনা এক ধ্যানে অঙ্কের রাজ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে দেখে তাকে কিছু বললেন না অসীম রায়।পিছনে ফিরে ছোটো মেয়েকে দেখলেন।লেপ গায়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে।অসীম রায়ের বড্ড মায়া হলো মেয়েটার জন্যে।তিনি কাছে গিয়ে ছোটো মেয়ের কপালে একটা চুমু এঁকে দিলেন।তার দুচোখ ছলছল করে উঠলো মেয়েদের জন্যে।ছোটো থেকে তিন মেয়েকে কোলে পিঠে করে মানুষ করা! মেয়েদের জন্যে এত ভালোবাসা দেখে অনেকেই তাকে বলেছে,"মেয়েরা হলো ঘরের অতিথি।নির্দিষ্ট বয়স পেরোলেই তাদের বিদায় দিতে হয়।তাই মেয়েদের উপর অত মায়া রাখতে নেই।"
অনেকে আবার প্রথম মেয়ে হওয়ার পর বলেছে,"প্রথম সন্তান মেয়ে!এ যে নিস্ফল। উপার্জন করে সাহায্য তো করতে পারবে না"
আর তিন সন্তানই যখন মেয়ে হলো,তখন তো অসীম রায়ের চেয়ে পাড়া প্রতিবেশিদের বেশি চিন্তা তার বংশ রক্ষা নিয়ে।
তখনই তিনি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, মেয়েদের কে তিনি ঠিকই নিজের পায়ে দাঁড় করাবেন।এতে সমাজের রক্তচক্ষু সহ্য করতে হলে তাও করবেন।কিন্তু সমাজের প্রতিটি মানুষকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেবেন যে মেয়ে মানেই বাবা মায়ের বোঝা না।মেয়ে মানেই অবহেলিত না, মেয়ে মানে শক্তি।আর তারাও উপার্জন করতে পারে।তারা একাধারে দেশ,সমাজ,পেশা, সংসার আর সন্তান সামলাতে পারে।মেয়েদের কে মা দূর্গার প্রতীক মনে করা হয় ঠিকই, কিন্তু অবহেলা করতে তাদের ছাড়ে না কেউ।