শূন্যের কারাগারে
মো: আশিকুর রহমান (শুভ)
====================
শহরের পুরনো এক বহুতলের এক কোণে বসবাস করত আরমান। তার ঘরটি ছিল ছোট্ট, নিঃসঙ্গতা আর স্থবিরতার প্রতীক। একটি টেবিল, একটি চেয়ার, আর দেয়ালে ঝুলে থাকা একটি ছোট্ট সাদা বোর্ড, যেখানে চক দিয়ে অঙ্কের সমীকরণ লিখতে লিখতে দিন কেটে যেত তার। দেওয়ালে কয়েকটি পুরনো ক্যালেন্ডার, তবে ক্যালেন্ডারের তারিখগুলোতে আরমান কখনো চোখ রাখত না। সময় তার কাছে হারিয়ে গিয়েছিল, যেমনটি হারিয়ে গিয়েছিল তার জীবনের আনন্দ।
আরমানের প্রতিদিনের জীবন কাটত ছাত্রছাত্রীদের বাসায় গিয়ে অঙ্ক শেখানোর মাধ্যমে। সকালে ব্যাগে কয়েকটি বই নিয়ে সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত। ক্লাসগুলোতে সে শুধু অঙ্ক শেখাত না, বরং শেখাত গভীরভাবে চিন্তা করার কৌশল। তার কথায় ধরা পড়ত এক ধরনের দার্শনিকতা—“অঙ্ক কেবল সূত্র নয়, এটি জীবনের সমীকরণ মেলানোর একটি উপায়।”
তবে নিজের জীবনের সমীকরণ যেন আরমান কখনো মেলাতে পারেনি। দিনের শেষে, যখন ক্লান্ত শরীরে সে নিজের ছোট্ট ঘরে ফিরত, নিঃসঙ্গতার এক গভীর শূন্যতা তাকে গ্রাস করত। দেয়ালের চারপাশে থাকা নীরবতা যেন তার জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়াত।
একসময় ভালোবেসে বিয়ে করেছিল রুমানাকে, কিন্তু আরমানের অদ্ভুত আচরণে ক্লান্ত হয়ে সে তাকে ছেড়ে চলে যায়। জীবন তখন থেকে হয়ে ওঠে আরও বেশি শূন্য আর অসংগতিপূর্ণ। তার বন্ধু বলতে ছিল সংখ্যা। সংখ্যা তার কাছে শুধুই গাণিতিক প্রতীক ছিল না, ছিল জীবন্ত চরিত্র। সে রাতে সংখ্যার সাথে কথা বলত, তার কাছে ১ ছিল তার কাছে একাকিত্বের প্রতীক, যেন একটি বিচ্ছিন্ন মানুষ। ২ ছিল বন্ধুত্ব, যা সে খুঁজেও পায়নি। ৩ ছিল ঝগড়া, যা তার জীবনে জায়গা নেয়নি। আর শূন্য? শূন্য ছিল ভয়ঙ্কর। “শূন্য হলো সব কিছুর শেষ, আবার সব কিছুর শুরু। এটা সবচেয়ে শক্তিশালী,” সে নিজেকে বলত।
এক রাতে শহরে একটি ভয়াবহ গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে—কয়েকজন মানুষ হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। কেউ তাদের আর খুঁজে পায় না। শহরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে ভয়ের গন্ধে। কিন্তু আরমান এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। তার নিজের জীবনই যেন এক অদ্ভুত রহস্যময়তার আবরণে ঢাকা।
শহরের ব্যস্ততার মধ্যে সে নিঃসঙ্গতার চাদরে মোড়া। প্রতিদিনের মতো সেদিনও ক্লান্ত শরীরে রাতে ঘরে ফিরে আসে আরমান। টেবিলের সামনে তার পুরনো চেয়ারে বসে। তার চোখ টাঙানো বোর্ডটির দিকে। সেই বোর্ড, যা প্রতিদিন নতুন কোনো সমীকরণের চিহ্ন ধারণ করত, আজ একেবারে ফাঁকা। ঘরের নীরবতা যেন একটা অদৃশ্য ভার চাপিয়ে রেখেছে।
বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়। জানালার কাঁচে ঝরে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা তার নিঃসঙ্গতা আরও জোরালো করে তোলে। চারপাশের গুমোট নীরবতায় বৃষ্টির শব্দ একমাত্র সঙ্গী। ঠিক তখনই দরজায় ধীর, ভারী কড়া নাড়ার শব্দ হয়।
আরমান চমকে ওঠে। এত রাতে কে হতে পারে? তার তেমন কোনো বন্ধু নেই, আর কেউ তাকে দেখতে আসে না। ভয় আর কৌতূহল নিয়ে সে দরজার কাছে যায়। দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকে এক যুবক। যুবকের বয়স বড়জোর ২৫ বা ২৬। লম্বা গড়ন, ফ্যাকাশে চেহারা। তার গভীর চোখদুটো যেন আরমানের ভেতর কিছু খুঁজে দেখছে।
“আপনি কি আরমান স্যার?” যুবকটি ধীর, ঠান্ডা স্বরে প্রশ্ন করে।
“হ্যাঁ। কিন্তু এত রাতে?”
“স্যার, আমি আপনার কাছে অঙ্ক শিখতে চাই।”
আরমান হতবাক। “এত রাতে? এখন?”
“হ্যাঁ। আমার সময় এটাই। অন্য সময় আমি পারি না।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আরমান তাকে ভেতরে আসতে বলে। যুবকটি ঘরে ঢুকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার ভেজা হাত থেকে জল ঝরছে মেঝেতে, কিন্তু সে সেদিকে নজর দেয় না।
“তোমার নাম কী?” আরমান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“জুবায়ের,” ছেলেটি জবাব দেয়।
“স্যার, আমি অঙ্কে ভালো হতে চাই। তবে আমি বই পড়ে শিখতে পারি না। আপনাকে আমাকে অন্যভাবে শেখাতে হবে।”
“অন্যভাবে মানে?”
“অঙ্কের গল্প বলুন, স্যার। সংখ্যা কীভাবে আমাদের জীবনের অংশ, সেটা বুঝিয়ে বলুন। আমি সূত্র মুখস্থ করতে চাই না।”
এমন ছাত্র আরমান আগে কখনো দেখেনি।
“তুমি কি ধাঁধার মতো অঙ্ক ভালোবাসো?”
“হ্যাঁ, স্যার। সংখ্যা নিজেই একটা ধাঁধা। আপনি কি কখনো শূন্য নিয়ে ভেবেছেন? শূন্য কীভাবে কিছু না হয়েও সবকিছু হতে পারে?”
প্রথমবারের মতো আরমান কথা হারায়। এই ছেলেটি যেন একেবারেই অন্যরকম। তার মনে হয়, অবশেষে সে এমন কাউকে পেল, যে তার মতোই অঙ্ক নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে পারে। তার ভেতর এক আনন্দের স্রোত বয়ে যায়।
জুবায়ের টেবিলে বসে বলে, “স্যার, আপনি কী মনে করেন, ১ থেকে ১০ পর্যন্ত সব সংখ্যার মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় কোনটা?”
আরমান হেসে বলে, “সব সংখ্যারই আলাদা গুরুত্ব আছে। ১ থেকে ১০ পর্যন্ত প্রতিটি সংখ্যা সমান গুরুত্বপূর্ণ।”
“তাহলে শূন্য কোথায়?”
“শূন্য?”
“হ্যাঁ, স্যার। শূন্য কি ১-এর আগে, নাকি পরে?”
এই প্রশ্নে আরমান থমকে যায়। এত সাধারণ এক প্রশ্ন, তবু উত্তর দিতে গিয়ে তার মুখ শুকিয়ে আসে। তার মনে হয়, এই ছেলেটির প্রতিটি কথা যেন কোনো গভীর, অজানা সত্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
শূন্য, যা সবকিছু শুরুর আগে, এবং সবকিছুর শেষে। এটি কি সত্যিই ধাঁধা? নাকি এক রহস্যময় শক্তি, যা সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে?
আরমানের ঘরে সেই রাতে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে। বৃষ্টির ফোঁটা জানালায় আছড়ে পড়তে থাকে। আর বাইরে, শহরের কোনো এক কোণে, আরেকটি মানুষ নিখোঁজ হওয়ার খবর আসছে।
প্রতি রাতেই জুবায়ের আসে। কিন্তু সে কখনো বই খুলে অঙ্ক শিখতে চায় না। বরং আরমানকে অদ্ভুত ধাঁধার মুখোমুখি করে। আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো আরমান এখনো জানে না জুবায়ের কিসে পড়ে, সবসময় মনে করে এটা জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু ভুলে যায়।
জুবায়ের বলে, “স্যার, ধরুন আপনি শূন্যের ভেতর হারিয়ে গেলেন। আপনি কীভাবে বের হবেন?”
“সংখ্যা মুছে ফেলব।”
“আপনি মুছে ফেলতে পারবেন না, কারণ শূন্য আসলে মুছে ফেলা যায় না।”
এরপর থেকে আরমানের মাথায় একের পর এক অদ্ভুত চিন্তা আসতে থাকে। সে তার টিউশনি বাড়ি গুলোতে যায় ঠিকই, কিন্তু ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে সব ভুলে যায়। একটি ছাত্রকে সে বলেছিল, “তোমার অঙ্কের খাতা খুলে দেখো, এখানে জীবন আর মৃত্যুর সমীকরণ আছে!” ছাত্রের মা তাকে সরাসরি বাড়ি থেকে বের করে দেয়।
এদিকে, আরেকটি রহস্যময় ঘটনা ঘটতে চলেছে। শহরের যে লোকজন হারিয়ে যাচ্ছিল, তারা সবাই ছিল আরমানের ছাত্রছাত্রী। এতদিন আরমান এসব ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব দেয়নি, তবে এখন সে লক্ষ্য করলো, কাকতালীয়ভাবে সবাই তার ছাত্রছাত্রী। বিষয়টি তার কাছে অস্বাভাবিক এবং রহস্যময় মনে হলো, কিন্তু সে এ বিষয়ে কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি।
এক রাতে, জুবায়ের আর ফিরে আসে না। আরমান অপেক্ষায় অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে, অথচ মনের কোণে একটা অজানা আতঙ্ক তাকে তাড়া করে বেড়ায়। জুবায়েরের ঠিকানা খুঁজতে সে শহরের এক অন্ধকারময় অঞ্চলে পৌঁছে যায়। এই রাস্তাটি যেন কোনো মানচিত্রেই নেই—চারদিকে শুধু নীরবতা আর অদ্ভুত কুয়াশায় ঢাকা পুরনো বাড়ি।
হঠাৎ, একটি বাড়ি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাড়ির দরজায় মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট ফেলে সে দেখে, গা শিউরে ওঠার মতো একটি লেখা:
“{0} এর কারাগার”।
জুবায়ের আগে এই বাড়ির কথাই বলেছিল। বাইরে থেকে সে ডাকতে থাকে, কিন্তু কোনো সাড়া মেলে না। মনে হলো, অন্ধকার যেন তাকে গ্রাস করে ফেলছে। দরজায় আলতো ধাক্কা দিতেই সেটি অদ্ভুতভাবে খুলে যায়।
ভেতরে প্রবেশ করতেই আরমানের নাকে লাগে তীব্র দুর্গন্ধ—কিছু একটা পচে গেছে, এমনই ভয়াবহ। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে সে দেখে, সারি সারি সমীকরণ আঁকা, সমীকরণ গুলো কি রক্ত দিয়ে লেখা! প্রতিটি সমীকরণ যেন এক একটি দুঃস্বপ্ন। এর মধ্যে একটি সমীকরণ তার চোখে পড়ে, যা দেখে তার মাথা ঘুরে যায়:
f(x) = ∫(sin(x)/x) dx + ∑(1/n^2) + ln(0) + √(-1) + e^(πi) + 0/0
সমীকরণটি যেন তাকে অভিশাপের মতো তাকিয়ে দেখছে। এর অর্থ খুঁজতে গিয়ে সে অনুভব করে, এটি কেবল গাণিতিক ধাঁধা নয়, বরং মৃত্যুর এক সিলমোহর।
ঘরের এক কোণে অন্ধকার আরও ঘন। সেখানে একটি দরজা। দরজাটি খুলতেই সে দেখে, একটি গভীর কূপ। কূপের চারপাশে চক দিয়ে আঁকা বিভিন্ন প্রতীক, যা কোনো তন্ত্র-মন্ত্রের মতো। কূপের দেয়ালে লেখা:
“শূন্যের কারাগার”।
কুয়োর সামনে লেখা দু'টি পঙক্তি যেন তার মস্তিষ্কে ছুরির মতো বিঁধে যায়:
“শূন্যেই আদি, শূন্যেই অন্ত,
শূন্য গিলে নেয় প্রাণের প্রতিটি স্পন্দ।
শূন্যের কারাগারে ধ্বংসের গান,
শূন্যই তোমার চিরস্থায়ী কফিনের প্রাণ।”
আরমান ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কূপের ভেতরে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট ফেলে। যা দেখে তার শরীর থেকে সমস্ত শক্তি হারিয়ে যায়—কূপের ভেতর অসংখ্য গলিত লাশের স্তূপ, যেগুলো থেকে বিষাক্ত ধোঁয়া বের হচ্ছে। তাদের বিকৃত মুখগুলো যেন আরমানের দিকে তাকিয়ে অভিযোগ করছে।
এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয়, কূপের গভীরতা যেন শূন্যের থেকে শুরু হয়ে অসীমে পৌঁছে যাচ্ছে। আরমান চিৎকার করে ওঠে। তার চিৎকার যেন সেই বাড়ির দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। সে বমি করতে করতে কুপথ ধরে দৌড়ে পালিয়ে যায়। তার মনে হচ্ছিল, কূপের ভেতরের ছায়ারা তাকে তাড়া করছে, তার শরীরের প্রতিটি কোষে ভয়ের চিৎকার।
কিন্তু সেই রাতের পর থেকে আরমান নিজেই নিখোঁজ হয়ে যায়। শহরজুড়ে এক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খবর বের হয়—আরমান হোসেন নামে এক সিরিয়াল কিলার, যে তার ছাত্রছাত্রীদের এক অসম্ভব সমীকরণের সমাধান করতে ব্যর্থ হলে তাদের হত্যা করত। তার ভিকটিমদের মরদেহ সেই অভিশপ্ত “শূন্যের কারাগার”-এর কূপে ফেলে দিত।
বছর পাঁচেক পর, এক সন্ধ্যায় রুমানা—আরমানের প্রাক্তন স্ত্রী—বাজারে একটি ভিক্ষুকের মুখোমুখি হয়। ভিক্ষুকটির গায়ে ছেঁড়া কাপড়, মুখে লম্বা দাড়ি, আর তার চোখে উন্মাদনার ঝলক। ভিক্ষুকটি রুমানার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনি যদি শূন্যে গুণ দেন, তবে কি সব মুছে যাবে, নাকি শূন্যটাই জিতে যাবে?”
ভিক্ষুকের কণ্ঠে আরমানের স্বর শুনে রুমানার হাত থেকে বাজারের ব্যাগ পড়ে যায়। রুমানাকে ভয় পেতে দেখে এক দোকানদার লাঠি নিয়ে, “গোলামের পুত, যাহ” বলে তাড়া দিলে ভিক্ষুটা মুহুর্তের মধ্যে ভীড়ের মধ্যে মিশে যায়। দোকানদার এবার রুমানাকে বলে, “যান আপা, পাগল ছাগল মানুষ, সবাই তারে অঙ্ক পাগলা অঙ্ক পাগলা।” রুমানা সেদিকে গুরুত্ব দিলনা, তার দৃষ্টি সেই পাগলের গন্তব্যের দিকে। তার গলাটা কেমন যেন জড়িয়ে আসছিল, বুকে যেন কেমন একটা ব্যাথা।
------------------------------------------------
(সমাপ্ত)