পর্ব ২
কলির পুরো নাম “হুমায়রা খানম কলি”। তার বাবা কামরুল আলী ছাগল জবাই দিয়ে মেয়ের আকিকা দিয়েছিলেন। যদিও নামের সাথে কলির গায়ের রং এর খুব একটা সামন্জ্ঞস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। কলি তার বাবার প্রতিচ্ছবিই বলা যায়। কামরূল আলী গ্ৰামে পরিচিত ছিলেন “কালু” নামে, গায়ের রং চাপা। তবে রোদে পুড়ে পুরোপুরি কয়লা বর্ণ ধারণ করেছিলো। অবশ্য কনিষ্ঠ সন্তান কামরুল ছিলেন মা জুলেখা বানুর সবচেয়ে আদরের পুত্র। স্নেহ করে ডাকতেন"মানিকচাঁন্দ"। বিবাহযোগ্য কামরুল আলী প্রথম দেখাতেই কাকলি বেগমকে বিয়ে করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। ফর্সা, ছোটখাটো কাকলি বেগমের শান্তভাব আর স্নিগ্ধতা খুব টেনেছিলো কামরুল আলীকে। বাবাহীন কাকলি বেগমদের চার বোন আর তাদের মায়ের সংসারে বেশ টানাপোড়েন ছিলো বলেই হয়তো জুলেখা বানু এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না। তবে ছেলের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন তিনি।কামরুলের কালো রং হলেও বেশ লম্বা আর মুখের অবয়ব, সরল ব্যবহার যে কারো থেকে আলাদা করতো। কামরুল আর কাকলির ছোট্ট সংসারে ভালোবাসার কমতি ছিলো না। বছর দুয়েক পর সন্তানের মুখ না দেখতে পারাটা তাদের দুজনের মাঝে যতটা না প্রভাব ফেলেছিলো তার অধিক প্রভাব ফেলেছিলো জুলেখা বানু ও প্রতিবেশীদের ওপর। জুলেখা বানু প্রায় সময় কামরুল আলীকে ডেকে বলতেন - “ মানিকচাঁন্দ, এই বাজা মাইয়া মানুষ নিয়্যা সংংসার করার দরকার নাই। আমি তো আগেই এই বিয়াতে মত দিছিলাম না। এহন দেখলি তো!”
কামরুল আলী মাকে প্রতিউত্তরে বলতো-"আম্মা, বাচ্চা কাচ্চা দেওনের মালিক আল্লাহ। এহনো সময় তো শ্যাষ হয় নাই!" বলে দ্রুতপদে সরে আসতো। আড়াল থেকে কাকলি আঁচলে মুখ লুকাতো। আরো বছরখানের পরে পরিস্থিতি অসহনীয় ঠেকলো। প্রায় রাতে কান্নার গোঙানির শব্দে ঘুম ভাঙতো কামরুলের। স্বভাববশত পাশে হাত দিয়ে শূণ্য বিছানা দেখতে পেতো। মাথা ঘুরিয়ে ফেছনে তাকালেই নামাজরত কাকলিকে দেখতো। বন্ধ চোখ থেকে অঝোর ধারায় রংহীন নোনতা তরল গড়িয়ে পড়তো মোনাজাতরত দুহাতের তালুতে। দীর্ঘ মোনাজাত শেষে কাকলি পেছনে তাকিয়ে দেখতো কামরুলকে। প্রাণপ্রিয় সহধর্মিনী কে বাহুডোরে আবদ্ধ করে কামরুল বোঝাতে থাকে কাকলিকে,
“বউ, আমি তোমারে মানা করছি না? তুমি ক্যান বোঝো না, আল্লাহ চাইলে ঠিক তিনি আমাগো ঘর আলো কইরা সন্তান দিবেন। আমি জানি, আম্মা, আশেপাশের মানুষজন তোমারে নানান কথা কয়, সবুর করো বউ। তোমার চোক্ষের পানি আমার কইলজায় লাগে!”
কান্নার মাঝেও মুচকি হাসে কাকলি। এই মানুষটা এতো কীভাবে বোঝে তাকে!
হয়তো সৃষ্টিকর্তা তাদের অপেক্ষার ফল দিয়েছেন। বিয়ের চার বছরের মাথায় কাকলি বুঝতে পারে, তার অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। একটা নতুন প্রাণের অস্তিত্ব টের পায় নিজের মাঝে। সেদিন মাঠের কাজ সেরে স্থানীয় হাট থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায় কামরুলের। ঘরে ঢুকেই স্ত্রীর ঝলমলে মুখ দেখতে পায়। কিছু বুঝে উঠতে পারে না। তবে হাট থেকে কিনে আনা জলপাই রঙের শাড়ি কাকলির হাতে ধরিয়ে বলে - “ তুমি ক্যামনে জানলা যে আমি শাড়ি আনছি তোমার লাইগ্যা? ”
কাকলি উত্তরে বলে, “ আমি ক্যামনে জানমু? মাত্র তো দিলেন!”
কামরুল বলে, “তাইলে এতো খুশি! তোমার হাসি আমি তো ভুইলা ই গেছিলাম”
বেশ অনেকক্ষণ ইতস্তত করে অবশেষে কাকলি বলতে পারে কামরুলকে। অনাগত সন্তানের খবর পেয়ে বাকরুদ্ধ কামরুল জড়িয়ে ধরে কাকলিকে। কাকলি তার পিঠে হালকা তরলের অস্তিত্ব পায়। এ সুখের কান্না!
কামরুলের আনা জলপাই রঙের শাড়ি পরে আরশির সামনে দাঁড়ায় কাকলি। ঘোলাটে আয়নায় স্নিগ্ধ মুখের আড়ালে জননীর প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় কামরুল। নয় মাস পর জন্ম নেয় “কলি”।