পারিপার্শ্বিক নানা তথ্য অপতথ্যের বেড়াজালে পড়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যারিয়ার বাছাইয়ে বিভিন্ন ভুল করে থাকেন । জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো অপচয়ের মাধ্যমে এই ভুলের মাশুল দিতে হয় । অনেক ক্ষেত্রে সারা জীবন সেই ভুলের গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয় । কাজেই ক্যারিয়ার চয়েজ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত । আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন একবার বলেছিলেন – একটি গাছ কাটার জন্য যদি আমাকে যদি ছয় ঘণ্টা সময় দেওয়া হয় তাহলে আমি প্রথম চার ঘণ্টা সময় ব্যয় করব কুড়াল ধারালো করার জন্য আর বাকি দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় করব গাছ কাটার জন্য । ক্যারিয়ার প্ল্যানিং টাও অনেকটা এরকম । পর্যাপ্ত বিচার বিবেচনা করে ক্যারিয়ার প্ল্যানিং করতে হয় । এবার আসি মূলকথায় । আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা ক্যারিয়ার চয়েজে যে প্রধান ভুলগুলো করে থাকেন তার মধ্যে পাঁচটি ভুল আমি তুলে ধরছি:
১. সরকারি চাকরিকেই শ্রেষ্ঠ ক্যারিয়ার হিসেবে মনে করা : জব সিকিউরিটি, সামাজিক সম্মান, মোটামুটি হ্যান্ডসাম স্যালারি এসব দিক বিবেচনায় সরকারি চাকরি একজনের পছন্দের তালিকায় থাকতেই পারে। কিন্তু সবকিছুরই ভালো মন্দ আছে। সরকারি চাকরিজীবীরাও হতাশ হতে পারেন। পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হওয়া, পছন্দমতো জায়গায় পোস্টিং না পাওয়া, পরিবার থেকে দূরত্ব, মনমতো সহকর্মী বা বস না পাওয়া, মানসিক চাপ, রাজনৈতিক প্রভাব এসব কিছুই একজন সরকারি চাকরিজীবীর জন্য অশান্তির কারণ হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের কোচিং সেন্টারগুলো এসব কিছু সাধারণত তুলে ধরেন না। উপরন্তু সরকারি চাকরির বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে গণহারে এই সেক্টরে আসার জন্য উৎসাহিত করেন । ফলশ্রুতিতে তাদের কোচিং ব্যবসা রমরমা হয়। এসব কোচিংয়ে যারা সফল হন তাদেরকে দিয়ে আবার সেমিনার করিয়ে মোটিভেশনের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন । কিন্তু যারা ব্যর্থ হন তাদের কথা কেউ বলেন না। ব্যর্থতার পেছনে দুইটা কারণ থাকতে পারে – একটা হলো যিনি ব্যর্থ হন তার নিজের পরিশ্রমের ঘাটতি আরেকটা হলো সরকারি চাকরির বাছাই প্রক্রিয়া । আমরা জানি সরকারি চাকরির বাছাই প্রক্রিয়ায় বাংলা, সাধারণ জ্ঞানের মতো এমন সব জিনিস মুখস্থ করতে হয় যেগুলোর সাথে কর্মক্ষেত্রের খুব কম সামঞ্জস্য রয়েছে । ফলে একজন কর্মক্ষেত্রে দক্ষ হলেও নিয়োগের এই মাপকাঠিতে তিনি বাদ পড়তে পারেন। এভাবে নিজের স্ট্রং পয়েন্ট এনালাইসিস না করে এই মাপকাঠিতে নিজেকে পরিমাপ করে অনেকেই নিজের জীবন থেকে সময় হারাচ্ছেন । বেকারত্ব, নিম্ন পদের চাকরি নিয়ে এই দৌড় থেকে বিদায় নিচ্ছেন । অথচ এসব শিক্ষার্থীরা নিজের মেধাকে সঠিক কাজে লাগাতে পারলে এর চেয়ে ভালো কিছু অর্জন করতে পারতো ।
২. মানুষকে দেখিয়ে দেওয়ার মনোভাব : আমাদের দেশের মোটিভেশনাল স্পিকার রা প্রায়ই বলে থাকেন - অমুক আপনাকে এটা বলেছে তাকে এটা হয়ে দেখিয়ে দিন । এটা এক ধরনের আবেগপ্রবণ বোকামি । কেউ আপনাকে পরিমাপ করতে ভুল করে থাকলে এটা তার ব্যর্থতা । তার অজ্ঞতা দূর করার জন্য কেন আপনি নিজের লক্ষ্য থেকে বিচ্যূত হয়ে জীবনের সময় নষ্ট করবেন ? আপনি কি করলে সুখী হবেন সেটা আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিন। কারও কথায় আবেগতাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাবেন না। কয়েকটি বইয়ের কথা বলছি যেগুলো পড়লে আপনার কি কি বিষয় বিবেচনা করা উচিত সে সম্পর্কে ধারণা পাবেন – মোহাম্মদ ফারিসের প্রোডাক্টিভ মুসলিম, Stephen Covey র লেখা 7 Habits of Highly Effective People, ব্রায়ান ট্রাসির লেখা টাইম ম্যানেজমেন্ট, Thibaut Meurisse র লেখা আত্মোন্নয়নমূল বই সহ আরো অনেক বিখ্যাত বইগুলোর খোঁজ নিয়ে পড়তে পারেন ।
৩. অতিরিক্ত টিউশনি : আমাদের দেশের অনেক মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্র ছাত্রীদের টিউশনির মাধ্যমে নিজের ব্যয় অথবা পরিবারের ব্যয় সামলাতে হয় । এক্ষেত্রে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই টিউশনির পেছনে সময় ব্যয় করা প্রয়োজন । অনেকেই অনার্স মাস্টার্সের পর প্রতিদিন আট দশ ঘণ্টা টিউশনির পেছনে ব্যয় করেন। টিউশনির এই অভিজ্ঞতা সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কিছুটা কাজে লাগলেও চাকরি জীবনে খুব একটা কাজে লাগে না। তদুপরি সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা সাম্প্রতিক সময়ে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক হওয়ায় একজন আট ঘণ্টা টিউশনি করিয়ে যতটা শিখেন আরেকজন লাইব্রেরিতে অথবা ঘরে বসে সেই আটঘণ্টা পড়াশোনা করে তার চেয়ে বেশি কাজে লাগাতে পারেন । তাছাড়া অনার্সের পর কেউ যদি চাকরিতে জয়েন করেন তাহলে বেতন এবং অভিজ্ঞতা দুইটাই বাড়ে । টিউশনিতে সেটার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ । তাই নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের সম্ভব হলে অনার্স লাইফেই একটা ব্যাংকে ডিপিএস করে ভবিষ্যত সংগ্রামের জন্য অগ্রিম প্রস্তুতি রাখা উচিত । যাতে অনার্সের পরের সময়টুকু টিউশনির পেছনে নষ্ট না হয় ।
৪. ক্ষুদ্র সুযোগের বিনিময়ে বড় সুযোগ হাত ছাড়া করা : ধরুন আপনি ৫০ হাজার টাকা বেতনের এমন একটা চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন যেটা পেলে আপনি মানসিকভাবেও সন্তুষ্ট থাকবেন । হঠাৎ করে আপনি ৪০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি পেলেন কিন্তু আপনার যোগ্যতা থেকে সেটা কম। এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে আপনার যোগ্যতার সবটুকু ব্যবহার না করার জন্য আফসোস হতে পারে । তাই ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতার সবটুকু কাজে লাগানো উচিত । এতে করে ভবিষ্যতে আপনাকে আফসোস করতে হবে না ।
৫. অপমান হজম করো, আত্মীয় স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাও: পরিবার, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেই সফলতা আসবে এটা সবসময় ঠিক নয়। বরং অনেক সময় সামাজিক প্রোগ্রামে যোগদান করা, আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ রাখা প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে সাহায্য করে । তবে আপনার সমাজ যদি সত্যিই আপনার জন্য এবং ক্যারিয়ারের জন্য নেগেটিভ হয় তাহলে সে সমাজ এভয়েড করে আপনার জন্য হেল্পফুল এমন সমাজ বাছাই করতে পারেন । একাকীত্ব অনেক ক্ষেত্রে হতাশা বাড়াতে পারে ।
সর্বোপরি আবেগতাড়িত না হয়ে নিজের বিচার বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে , নিজের SWOT(streangth, Weakness, Opportunity, Threat) এনালাইসিস করে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ক্যারিয়ার বাছাইয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।