রাজনৈতিক অঙ্গনে তলাবিহীন ঝুড়ি বা Basket case শব্দটি বেশ আলোচিত একটি বিষয়। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের দুর্বল আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বিদেশি সাহায্যের উপর অধিক নির্ভরতা ও ভবিষ্যৎ উন্নতির ক্ষীণ সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তখন বাংলাদেশকে এই তলাবিহীন ঝুড়ি হিসাবে ডাকা হতো। তবে প্রশ্ন জাগে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও বাংলাদেশ কি সেই আগের অবস্থানেই আছে না কি পরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে টেকসই উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দুরন্ত গতিতে। এই প্রশ্নের উত্তর বের করতে বিশ্লেষণ করা যায় রস্ট্রোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্তর তত্ত্বকে। এর মাধ্যমে বের করা সম্ভব বাংলাদেশ তথা সমপর্যায়ের উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নতির কে কোন পর্যায়ে আছে।
সময়টা তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকাল। এশিয়া ও আফ্রিয়ার অসংখ্য দেশ তখন দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হতে শুরু করেছে। তবে দীর্ঘ দুঃশাসনকাল ও দুর্বল আর্থ-সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কারণে দেশগুলোতে উন্নয়নের গতি আঙ্ক্ষিত মাত্রায় উঠতে পারছিল না। ফলে গবেষণা শুরু হয় কিভাবে নিশ্চিত করা যায় উন্নয়ন। এগিয়ে আসেন বহু অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ। বেরও করেন বহু উন্নয়ন সম্পর্কিত তত্ত্ব। ফলে অর্থনীতিতে প্রচলণ হয় নতুন একটি শাখার যার নাম "উন্নয়ন অর্থনীতি"। তেমনই একটি বিখ্যাত তত্ত্ব হলো মার্কিন অর্থনীতিবিদ Walt Whitman Rostow এর "অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্তর তত্ত্ব"। এই তত্ত্বে তিনি একটি দেশের অর্থনীতিকে পাঁচটি স্তরে ভাগ করেন এবং চেষ্টা করেন কোন দেশের অবস্থান কোন পর্যায়ে সেটি বের করতে।
এই তত্ত্বের প্রথম স্তরে রয়েছে traditional society বা গতানুগতিক অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা। এই স্তরে সমাজ মূলত কৃষিনির্ভর ও সেখানে ব্যবহৃত প্রযুক্তিও অনুন্নত। এক্ষেত্রে মধ্যযুগের ইউরোপীয় সমাজের ১০০০-১৫০০ খ্রিস্টাব্দের সময়কাল উল্লেখকরা যায় যখন সেখানের সমাজ মূলত কৃষি, মৎস্য ও চারণভিত্তিক শিল্পের উপর নির্ভর ছিলো। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মুঘল ও ঔপনিবেশিক আমল বেশ প্রাসঙ্গিক। কারণ তখন এদেশে অনুন্নত কৃষিই ব্যবস্থাই ছিলো অর্থনীতির প্রধান মেরুদণ্ড।
আর দ্বিতীয় স্তরে বলা হয়েছে Pre-condition for take off অবস্থা কে। অর্থাৎ একটা দেশের অর্থনীতি উন্নয়নের পথে যাত্রা করার জন্য প্রস্তুত বা প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই স্তরে একটি দেশের অর্থনীতি আধুনিকায়নের দিকে যায়। তাছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য ও আধুনিক শিল্পের বিকাশ ঘটে। ১৮ শতকে ব্রিটেনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে বিকাশ দেশটিতে শিল্প বিপ্লবের পথকে সুগম করে৷ এই পরিবর্তনের পথকে তরান্বিত করতে কিছু সামাজিক মূলধনও অবদান রাখে। যেমন বাংলাদেশে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে রেললাইন, বন্দর ও ঢাকা- চট্টগ্রামের মাঝে যোগাযোগ সহজতর হয়। ফলে দেশে পাট ও চিনি শিল্প বিকশিত হয়।
এর পরের স্তরটি হলো Take-Off যার বৈশিষ্ট্য হলো জাতীয় আয়ে বিনিয়োগের হার ১০% শতাংশ বা তার বেশি হবে। তাছাড়া দেশে গড়ে উঠবে এক বা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ শিল্প যেগুলো জাতীয় আয়ে উল্লেখযোগ্য হারে অবদান রাখবে। মূলত আঠারো শতকে ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব ও দক্ষিণ কোরিয়ায় অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক অগ্রগতি এই স্তরেই সংগঠিত হয়েছিল। তাছাড়া বাংলাদেশেও ৯০ এর দশক থেকে তৈরি পোশাক শিল্প ও রেমিটেন্স খাত উল্লেখযোগ্য ভাবে জাতীয় আয়ে অবদান রাখতে শুরু করে।
এই তত্ত্বে চতুর্থ স্তরটি হলো Drive to Maturity। এই স্তরে মূলত একটি দেশের অর্থনীতি আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উঠে। তাছাড়া অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মাত্র বৃদ্ধি পায় ও উৎপাদন বৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে যায়। তাছাড়া পুরোনে নেতৃস্থানীয় শিল্পের সাথে নতুন নতুন শিল্প গড়ে উঠবে ও বিকশিত হবে। এর বাইরে অর্থনীতিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হবে। ফলে ই-কমার্স ও এফ কর্মাসের মতো খাতগুলোর বিকাশ হবে ব্যাপকভাবে। তবে এই স্তরের কিছু শর্ত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও তা পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ বাংলাদেশ আইসিটি খাত বিকশিত হচ্ছে এটা যেমন সত্য তেমনি দুর্বল ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্কও একটি করুণ বাস্তবতার চিত্র। তাছাড়া এ স্তরে অর্থনীতিতে কোনো একক খাতের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস বরং বহুমুখী খাতের বিস্তার লক্ষনীয় হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশ এখনও দুটি প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প ও রেমিট্যান্স খাতের উপর ব্যাপক মাত্রায় নির্ভরশীল। তাই বাংলাদেশ এই স্তরে পুরোপুরি পর্দাপন করেছে তা বলা যাচ্ছে না।
সর্বশেষ স্তরটি হলো Age of High Mass Consumption। এই স্তরে অর্থনীতিতে মূলত সেবা খাতে ভূমিকাই থাকে মূখ্য। এখানে মানুষের আয় এমন পর্যায়ে পৌছায় যে তারা মৌলিক চাহিদা পূরণ করে বিলাসবহুল ভোগ্যপণের প্রতিও ব্যাপক মাত্রায় ঝুঁকে পড়ে। তাছাড়া রাষ্ট্রের উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রধান্য পায় সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ। তবে বাংলাদেশ এখনও স্তরের দিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে আছে। কারণ এখনও এদেশে শ্রমের বড় একটি অংশ গ্রামীন কৃষির সাথে সম্পৃক্ত। তাছাড়া শহরে বসবাসকারীর সংখ্যা দিনদিন বাড়লেও শহরের জীবনযাত্রার মান যে তেমন একটা বেড়েছে তাও নয়। এমনকি স্বাধীনতার এতো বছর পরেও এদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান বৈশ্বিক তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে আছে।
সর্বোপরি বলা হয় রস্ট্রোর এই অর্থনৈতিক স্তর তত্ত্ব অনুযায়ী বাংলাদেশ Take-Off এর স্তর পুরোপুরি পার করে এখন Drive to Maturity স্তরের কিছু শর্তও পূরণ করেছে। কিন্তু পঞ্চম স্তর তথা age of high mass consumption স্তর থেকে বেশ খানিকটা দূরেই আছে বাংলাদেশ। তবে আশা করা যায় উন্নয়নের এই গতি বজায় থাকলে বাংলাদেশ শীঘ্রই পঞ্চম স্তরে পৌছে যেতে পারবে।
তথ্যসূত্রঃ
1. Dhar, S. (2021, May). Rostow's Stages of Growth and Bangladesh: To Which Stage Does Bangladesh Belong. British Journal of Arts and Humanities, 3(5), 74–85. Retrieved from https://www.researchgate.net/publication/357990341_Rostow's_Stages_of_Growth_and_Bangladesh_To_Which_Stage_Does_Bangladesh_Belong
2. Islam, R. (2023, February). উন্নয়নের অর্থনীতি (2nd ed.). Chapter 2: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন তত্ত্বসমূহ (pp. 29–33).
3. Learnera Academy. (2023, October 19). Rostow Stages of Economic Growth Theory. Retrieved from https://learneraacademy.com/blog/communication/development-communication/rostow-stages-of-economic-growth-theory/
4. Parr, J. (1998). On the regional dimensions of Rostow's theory of growth. ERSA Conference Papers, ersa98p109, European Regional Science Association. Retrieved from https://ideas.repec.org/p/wiw/wiwrsa/ersa98p109.html
5. Pennsylvania State University. (n.d.). Rostow’s Stages of Economic Growth. Retrieved from https://www.e-education.psu.edu/geog128/node/719
6. Wikipedia contributors. (2024, December 16). Rostow's stages of growth. Retrieved from https://en.m.wikipedia.org/wiki/Rostow%27s_stages_of_growth