Posts

গল্প

জুলাইয়ের গল্প: রক্তের ছাপ হয়ে ফেরা

December 31, 2024

মুহসীন মোসাদ্দেক

22
View

জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহের কোনো একদিন, ২০২৪। বাজারের ব্যাগটা রান্নাঘরে রেখে এসেই ঘামে ভেজা বিরক্তিমাখা চেহারা নিয়ে মুগ্ধর ঘরে উঁকি দিলেন বাবা। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছেলের কাজকারবার দেখে বিরক্তি তার আরও বাড়ল।
‘সারাদিন মোবাইল নিয়েই পড়ে থাক। তোদের তো দিন-দুনিয়া সব এখন ওই যন্ত্রটাই। আসল দিন-দুনিয়ায় কী চলছে, কেমন চলছে তা নিয়ে তোদের আর মাথাব্যথা কী!’
রাগে গজরাতে গজরাতে বাবা চলে গেলেন ড্রয়িংরুমে। মোবাইলে গেম খেলা থেকে মুগ্ধর মনোযোগ সরাতে পারল না বাবার বিরক্তি।
ড্রয়িংরুম থেকে ডাক দিলেন বাবা, ‘মুগ্ধ⸺পানি দিয়ে যা আমাকে।’
বাবা অপেক্ষা করতে পারলেন না কয়েক সেকেন্ড। আবার ডাক দিলেন, ‘মুগ্ধ⸺কথা কানে গেল না!’
মুগ্ধ পানির সাথে একটু লেবু মিশিয়ে এনে দিলো বাবার হাতে, ‘এত অস্থির হওয়ার কী আছে, বাবা? বাজার থেকে এলে, একটু শান্ত হয়ে বসবে তো আগে!’
‘তোরা কি আর শান্তির কিছু রেখেছিস! যখনই দেখি তোদের, দেখি মুখ ডুবিয়ে আছিস মোবাইলে। এমনভাবে ডুবে থাকিস যে মুখই দেখা যায় না তোদের!’ বাবা বিরক্তি নিয়ে পানিতে চুমুক দিয়ে চমকে গেলেন, ‘লেবু দিয়েছিস কেন? শুধু তো পানি চাইলাম।’
‘বাজার থেকে ঘেমে এসেছো, লেবু-পানি দ্রুত সতেজ করে তুলবে। খাও।’
‘এত দরদ! সারাদিন ঘরে বসে মোবাইল না টিপে নিজে তো একটু আমার সাথে বাজারে যেতে পারিস। বাজারের হালচাল বুঝতে হবে না? আমি না থাকলে কী করবি?’
‘এত ইমোশনাল হওয়ার মতো কিছু হয়নি, বাবা। আর মোবাইলের ব্যাপারে এত নেগেটিভ ধারণা নিয়ে বসে থাকা তোমাদের জেনারেশনের সবচেয়ে বড় বোকামি। এই মোবাইল অনেক কাজের জিনিস। তোমরা সেটা উপলব্ধি করতেই পারলে না! এই মোবাইলের মাধ্যমেই বাজারের জিনিসপত্রের দরদাম সম্পর্কে ধারণা আমরা ঘরে বসেই রাখতে পারি।’
‘ওই মোবাইলের ডেটা আর বাজারের আসল ডেটা এক নারে, বাবা। কবে আর বুঝবি! এই তোদের দিয়ে আর কিচ্ছু হবে না!’
বাবা উঠে গোসলে চলে গেলেন। বাবার কথা পাত্তা না দিয়ে মুগ্ধ আবার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল।

১৫ জুলাই, ২০২৪। ঢাকার রাস্তায় ঠিকমতো গাড়ি চলছে না। যা-ও চলছে, তীব্র যানজটে স্থবির হয়ে আছে। এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশ আর লাঠিয়ালদের গণ্ডগোল চলছে, গোলাগুলি হচ্ছে। অফিস থেকে ফিরতে তাই বাবাকে বেশ ঝক্কি পোহাতে হলো, ঝুঁকি নিতে হলো। এসেই আবার দেখলেন মুগ্ধ বরাবরের মতোই মোবাইল নিয়ে বসে আছে। বাবা এসেছেন, তার চেহারায় কী অভিব্যক্তি ফুটে আছে সে ব্যাপারে মুগ্ধর কোনো আগ্রহ নেই। বাবা বিরক্তি আড়াল করলেন না বরাবরের মতো, ‘তোর মতো বয়সি ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নেমেছে, আন্দোলন করছে নিজেদের অধিকার আদায়ের দাবিতে। আর তুই পড়ে আছিস তোদের সেই মহাকাজের যন্ত্র নিয়ে! কী যে হবে তোর জীবনে!’
মুগ্ধ বিরক্ত হলো, ‘কথায় কথায় মোবাইল নিয়ে খোঁটা দেয়া আর কোথায় কে কী করল তা নিয়ে তুলনা দেয়া ছাড়া তোমাদের আর কথা বলার ধরন নাই, বাবা?’
‘সত্যি কথা বললে তো জ্বলবেই! এটাই নিয়ম।’
‘এটা কোনো লজিক্যাল কথা না।’
‘তো, লজিক্যাল কথা কোনটা?’
‘তুমি আমাকে বোঝাও, যাদের আন্দোলনের কথা তুললে তারা কারা? তাদের এজেন্ডা কী?’
‘কেন? তারাও তোর মতো ছাত্র। সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছে তারা।’
‘তো, এই আন্দোলনের সাথে আমার সম্পর্ক কী? আমি কি কোনোদিন সরকারি চাকরি করব? কোটা থাকা না থাকায় আমার কী আসে যায়!’
‘এইতো, সারাদিন যে মোবাইল নিয়ে খোঁটা দিই তা একারণেই। আন্দোলনটা যখন ছাত্রদের আর তুই যখন একজন ছাত্র এবং আন্দোলনটা যদি যৌক্তিক হয় তখন তোকে অবশ্যই সে আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করতে হবে। এটাই মানবিকতার ধর্ম। এ শিক্ষাটা তোর মোবাইল মহারাজ দিতে পারেনি তোকে।’
মুগ্ধ কিছু বলে না। এভাবে সে ভেবে দেখেনি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বলে এড়িয়ে গিয়েছে সে।
‘তোমার অ্যাঙ্গেলে চিন্তা করলে বলা যায় আমার থট প্রোসেস স্বার্থবাদী। এমন স্বার্থপর হওয়া ঠিক নয়।’ একটু ভেবে মুগ্ধ বলল, ‘কিন্তু আমি তো কোনোদিন বাজারের ব্যাগ পর্যন্ত টানলাম না, কোনো দায়িত্ব নেয়ার মতো কাজ করলাম না, রাস্তায় নেমে আন্দোলনে কি আমি কিছু করতে পারব?’
‘আন্দোলন কি শুধু রাস্তায় হয়? এই যে তোর হাতের ডিভাইসটাকে এতদিন বলে এসেছিস যে, সব কাজ ওতেই হয়, সব খবর নাকি ওখানেই থাকে। ওটাকেই কাজে লাগা। বিপ্লবে শামিল হয়ে কত মানুষই তো দেখছি সোশ্যাল মিডিয়ায় সোচ্চার। এগুলোও আন্দোলনকে বেগবান করে।’
গেম থেকে বেরিয়ে ফেসবুক ও পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে মনোযোগী হলো মুগ্ধ। গত কয়েকদিন সে ঠিক সেভাবে খোঁজ রাখেনি বৈষম্যবিরোধী এ ছাত্র আন্দোলনের বিষয়ে। কিন্তু কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করে আজকের যে পরিস্থিতি উপলব্ধি করল তাতে সে শিউরে উঠল।
চীন সফর থেকে ফিরে সাংবাদিক সম্মেলনে স্বৈরাচার নেন্ত্রীর একটি মন্তব্যে উচ্চারিত ‘রাজাকার’ শব্দটি উসকে দেয় শিক্ষার্থীদের। এমন মন্তব্য করতে স্বৈরাচার নেন্ত্রীকে আবার উসকে দিয়েছিল এক সাংবাদিক। ফলে শিক্ষার্থীরা রাতভর স্লোগানে স্লোগানে কাঁপিয়ে তোলে ক্যাম্পাস এবং সোশ্যাল মিডিয়া।
‘তুমি কে? আমি কে?
রাজাকার! রাজাকার!
কে বলেছে? কে বলেছে?
স্বৈরাচার! স্বৈরাচার!’
মুগ্ধ অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, কোনো গণমাধ্যমেই এই স্লোগানের পরের দুই লাইন উল্লেখ নেই। ক্ষমতাসীন সরকারি দলের কোনো মন্ত্রী-এমপি-সমর্থকও তাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে পরের দুই লাইনকে আমলে নিল না। কেবল প্রথম দুই লাইনকে আমলে নিয়ে শিক্ষার্থীদের ঢালাওভাবে রাজাকার উপাধি দিয়ে তাদের দেশের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করা হলো। অথচ ওই স্লোগানের ভেতর যে শ্লেষ-ক্ষোভ দানা বেঁধে আছে তা তারা উপলব্ধি করল না।
শিক্ষার্থীদের স্লোগানের প্রথম দুই লাইনকে ফোকাস করে দেশের কাকা মন্ত্রী ঘোষণা করল, ‘এর জবাব আমাদের লাঠিয়ালরাই দিবে!’
ফলশ্রুতিতে আজ দিনভর সরকারের লাঠিয়ালরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিয়ালরা লাঠিসোটা, চাপাতি এমনকি পিস্তল নিয়ে হামলা করে। পুলিশ শিক্ষার্থীদের পাশে না দাঁড়িয়ে লাঠিয়ালদের সাথে হামলায় যোগ দেয়। অনেক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়ানো আহত শিক্ষার্থীদের কিছু ছবি দেখে চমকে ওঠে মুগ্ধ। এত বর্বরোচিত হামলা, এমন অমানুষিক আঘাত! একটি দেশের সরকারদলীয় কোনো রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করার অধিকার কোথায় পেল? কোন আইনে তারা এ ক্ষমতা পেল? একজন মন্ত্রী কীভাবে নিজ দলীয় রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনকে এভাবে উসকে দেয়ার, ব্যবহার করার বৈধতা পেল? প্রশ্নগুলো ঘুরতে থাকে মুগ্ধর মাথায়। উত্তরটা সহজ⸺স্বৈরতান্ত্রিক কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থায় এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়। মুগ্ধর মেজাজ খারাপ হয়ে যায় ভাবতে গিয়ে। আরেকটা ব্যাপার দেখা গেল, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি স্থানে সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারদলীয় রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের এমন হামলার পর বেশিরভাগ শিক্ষক নীরবতা পালন করলেন, পাশে দাঁড়ালেন না শিক্ষার্থীদের। অল্প কিছু শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পাশে থাকতে চেষ্টা করেছিলেন, তারাও হেনস্তা-লাঞ্ছনার শিকার হলেন। যে শিক্ষকেরা নীরব থাকলেন, আড়াল হয়ে থাকলেন, কেউ কেউ ইনিয়ে বিনিয়ে শিক্ষার্থীদেরই দোষ দিলেন⸺নিয়োগপ্রক্রিয়া খতিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে তাদের এমন নীরবতার কারণ। ব্যাপারটা বুঝে গেল মুগ্ধ।
এর মাঝে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি হয়ে ভেসে বেড়ানো আহত কয়েকজনকে চিনতে পারে মুগ্ধ, তারই একসময়ের সহপাঠী, যাদের কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, কেউ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
রক্ত যেন টগবগ করতে থাকে মুগ্ধর। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বলে আবার আলাদা কী! বন্ধুর ওপর আঘাত এসেছে, বন্ধুর পাশে তাই দাঁড়াতে হবে, একাত্ম হতে হবে বন্ধুর সাথে। বন্ধুরা যদি অন্যায়ের পক্ষের দোসর হতো তাহলে তা ভিন্ন, কিন্তু বন্ধুরা তো ন্যায়ের পক্ষে লড়ছে। বন্ধুদের পাশে না থাকাটা এখন পাপ।

১৬ জুলাই, ২০২৪। লাঠিয়ালদের হামলার পর আন্দোলন আরও ফুঁসে উঠেছে। ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। পাবলিক-প্রাইভেট-জাতীয় সব ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই একাত্ম হয়েছেন আন্দোলনে। এমনকি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ছে আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ হামলা চালাচ্ছে শিক্ষার্থীদের ওপর। রাবার বুলেট-টিয়ারসেলের মুহুর্মুহু হামলার পাশাপাশি চলছে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। 
সারাদেশেই অস্থিরতা। শিক্ষার্থীদের অবরোধে ঢাকা শহরের রাজপথ অচল। বিভিন্ন শহরের প্রবেশমুখ অবরোধ করে রেখেছেন শিক্ষার্থীরা। দুপুরের পর পর একটা খবর এল। আবু সাঈদ নামের রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন। পুলিশের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন তিনি। পুলিশের মুহুর্মুহু রাবার বুলেটে ঝাঝরা হয়ে যায় আবু সাঈদের বুক। রাস্তাতেই লুটিয়ে পড়েন তিনি।
এ খবরে শিক্ষার্থীরা আরও জ্বলে ওঠে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে একাত্ম হতে শুরু করেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। স্লোগান ওঠে, ‘আমার টাকায় কেনা গুলি, আমার ভাইয়ের বুকে কেন!’
আবু সাঈদের মা আর্তনাদ করেন, ‘আমার বেটাক চাকরি না দিলে না দিবু, মারলু ক্যানে!’
এই আর্তনাদ সাধারণ জনতাকে নাড়া দিতে শুরু করে। রাস্তায় নেমে আসতে শুরু করে তারা, শিক্ষার্থীদের পাশে জনবল বাড়তে থাকে। আর তাতে আরও মরিয়া হতে থাকে পুলিশ ও লাঠিয়ালরা।

১৭ জুলাই, ২০২৪। পুলিশের হামলা ও গুলি বর্ষণ বেপরোয়াভাবে চলতে থাকে। শহীদ হন আরও কয়েকজন যুবক-জনতা। আহত হন হাজার হাজার, পঙ্গু ও অন্ধ হন শত শত। তারপরও দমে না শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতা। আন্দোলন থেকে ডাক আসে, আগামীকাল থেকে পুরো দেশ শাটডাউন করার। সরকারি প্রশাসন কঠোর অবস্থানে যায়। মোবাইলে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়, নেটওয়ার্কও দুর্বল করে দেয়া হয়। কারফিউ জারির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মিলিটারির বহর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসছে, এমন ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। মুগ্ধও ঠিক করে ঘরে বসে ভার্চুয়াল আন্দোলনের সময় আর নেই। এখন মাঠে নেমেই একাত্ম হতে হবে আন্দোলনের সাথে। আরও কিছু বন্ধুর সাথে কথা বলে পরদিন সকালেই তারা বেরিয়ে পড়বে বলে ঠিক করে।
বাবা-মাকে জানালে তারা বাধা দেয়। যে বাবা মুগ্ধকে উসকে দিয়েছিল, থট প্রোসেস পাল্টে দিয়েছিল, সে বাবাও চান না মুগ্ধ রাস্তায় নেমে আন্দোলন করুক। বলেন, ‘ঘরে বসেই তুমি ওদের পক্ষে থাকো।’
মুগ্ধ আশ্চর্য হয়ে যায়, ‘কী বলছো বাবা! ঘরে বসে ওদের পক্ষে থেকে কী ইমপ্যাক্ট হবে? দেশের অধিকাংশ মানুষ যদি ঘরে বসে থাকে, ওদের পক্ষে থাকা না থাকায় কোনো ইমপ্যাক্ট হবে? ধরো, যারা এখন রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছে, মার খাচ্ছে, পঙ্গু হচ্ছে, অন্ধ হচ্ছে, শহীদ হচ্ছে, তাদের বাবা-মা-পরিবার যদি এমন করে ভাবে, সবাইকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে কি আর আন্দোলন বলতে কিছু থাকবে? আন্দোলনের ফল কী হবে তখন?’
বাবা লজ্জা পেয়ে যান, আবার গর্বিতও বোধ করেন। সারাদিন মোবাইল গেমস নিয়ে পড়ে থাকা ছেলেকে নিয়ে তার যে ধারণা ছিল তা ভুল মনে হচ্ছে এখন। ঠিক একাত্তরের কথা মনে পড়ল বাবার। না, বাবা একাত্তরে যুদ্ধ করেননি। অনেক ছোট ছিলেন তখন। কিন্তু দেখেছেন, অনেকে যখন যুদ্ধে গেছেন, অনেকে আবার যেতে পারেননি পরিবারের বাধার কারণে। তখন থেকে এই উপলব্ধি জেগে ওঠে যে, সব বাবা-মা যদি তার সন্তানকে যুদ্ধে যেতে বাধা দিয়ে ঘরে বসিয়ে রাখতেন তবে এ দেশ আর স্বাধীন হতো না! তিনি আর বাধা দেয়ার ভাষা পেলেন না, সরাসরি অনুমতির সুরও তুলতে পারলেন না, শুধু বললেন, ‘দেখো, তোমরা যা ভালো মনে করো!’
কিন্তু মা মানলেন না, ‘পুলিশ যেভাবে হিংস্র হয়ে গুলি করছে, তোরা কীভাবে ওদের সাথে লড়বি? তোদের কী অস্ত্র আছে? আমি কিছুতেই তোকে ঘরের বাইরে যেতে দিব না!’
‘এটা কেবল অস্ত্রের মুখোমুখি অস্ত্রের যুদ্ধ না, মা। এটা এখন কেবল ন্যায্য দাবি আদায়ের যুদ্ধও না, এটা এখন মানবতা ও মানবিকতার যুদ্ধ। ধরো, এই গরমে রাজপথে লড়াই করে ক্লান্ত কোনো যোদ্ধার হাতে এক বোতল পানি তুলে দেয়া কিংবা আহত কোনো যোদ্ধার জন্য এক ব্যাগ রক্ত দেয়া অথবা শহীদ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা নিথর দেহটাকে যথাযথ সম্মানে কাঁধে তুলে নেয়াও বন্দুক-গোলা-বারুদের চেয়ে বড় অস্ত্র এখন।’
মা মানেন না, ‘না, যতই ভোলাতে চাস আমি মানবো না। আমি তোকে এসব গণ্ডগোলে যেতে দিব না!’
চোয়াল শক্ত করে বলল মুগ্ধ, ‘এটা গণ্ডগোল না মা, এটা আন্দোলন।’
মা ভাষা হারিয়ে ফেললেন, কেঁদে উঠলেন। সারারাত ঘুমাতে পারলেন না। একটু পর পরই উঁকি দিতে থাকলেন, কান খাড়া করে রাখলেন, যেন মুগ্ধ চুপি চুপি পালিয়ে যেতে না পারে! কিন্তু তিনি মুগ্ধকে আটকাতে পারলেন না। মায়ের নীরব পাহারা ডিঙিয়ে মুগ্ধ ঠিকই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

১৮ জুলাই, ২০২৪। সারাদেশে রীতিমতো তোলপাড় চলছে। অনেক মানুষের মৃত্যুর খরব আসছে। টিভির সামনে বসে এসব দেখতে দেখতে কেঁদে উঠছেন মা। মুগ্ধর সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না বাবা। বারবার ফোন করছেন, মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। ওয়াইফাই চললেও মোবাইলে নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট না থাকায় অনলাইনেও পেলেন না মুগ্ধকে। বাবা বিচলিত বোধ করলেও বুঝতে দিলেন না। মাকে বুঝ দিলেন, ‘চিন্তা করো না, মুগ্ধ নিজেকে সামলে রাখবে নিশ্চয়ই।’
মায়ের মন সান্ত্বনা পেল না।
সন্ধ্যার পর থেকে সব ধরনের ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হলো। অস্থিরতা বাড়তে থাকে মুগ্ধর বাবা-মায়ের। কোনো যোগাযোগ করা যাচ্ছে না মুগ্ধর সাথে। রাত বাড়তে থাকে। অপেক্ষায় অপেক্ষায় অস্থিরতা আরও বাড়তে থাকে বাবা-মায়ের।
অনেক রাতে অবশ্য মুগ্ধ ফিরে আসে। মুগ্ধকে প্রথমে চেনাই যায় না। ফ্যাকাশে হয়ে গেছে চেহারা। সারাদিন না খাওয়া, রোদে পুড়ে ঘুরে বেড়ানো, স্লোগান দেয়া মুখ⸺একদম যেন বলিষ্ঠ যোদ্ধার মতো লাগে। সারাদিনের রোমহর্ষক ঘটনার অল্প কিছু গল্প করে মুগ্ধ। বাবা-মা চোখ বড় বড় করে শোনেন। শিহরিত হন। তারপর শুতে যাবার আগে মা মিনমিন করে বলেন, ‘আজ যেটুকু হয়েছে ও পর্যন্তই থাক, কাল থেকে আর যাওয়ার দরকার নাই, বাবা।’
মুগ্ধ কথাটা কানে তুলল বলে মন হলো না। মা-ও ভরসা পেলেন না। বুঝতে পারলেন, ছেলে কথা শুনবে না!

১৯ থেকে ২১ জুলাই, ২০২৪। আগের দিনের চেয়ে সংঘর্ষের খবর বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে মৃতের সংখ্যাও। বাবা-মায়ের শঙ্কাও বাড়তে থাকে। মুগ্ধ আবার চুপচাপ বের হয়ে গেছে। কখন, কেউ তা টের পায়নি। যোগাযোগও হয়নি একবারও। এর মধ্যে অবস্থা সরকারি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের আরও বাইরে চলে যেতে থাকে। কারফিউ জারি করা হয়। পুলিশের পাশাপাশি এখন মিলিটারি। দেশের পরিস্থিতি বেগতিক। সরকারি প্রশাসন সর্বোচ্চ পর্যায়ে কঠোর অবস্থানে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু দমে না শিক্ষার্থীরা, দমে না সাধারণ জনতা। ভাইয়ের লাশের হিসাব চুকাতে হবে সরকারকে। যতই দমননীতি অবলম্বন করুক, এত সহজে তারা দমবে না।
মুগ্ধ বাড়ি ফেরে না, ফোনে কথা হয় একবার। হন্তদন্ত ভঙ্গিতে কথা বলে মুগ্ধ, হট্টগোলের ভেতরে সব কথা স্পষ্ট বোঝা যায় না। তবু সে বোঝাতে চায়, সে ঠিক আছে, কোনো চিন্তা করতে হবে না। বাবা-মায়ের মন তাতে কিছুটা শান্ত হলেও আশ্বস্ত হতে পারে না। ঘুমাতে পারে না।
পরের দিন দুপুরে মুগ্ধ বাড়ি ফেরে। কোনোমতে একটু খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়ে। যাওয়ার সময় বলে, ‘অনেক গল্প আছে, একেবারে বলবো। তোমরা চিন্তা করো না।’
প্রতিদিন আগের দিনের চেয়ে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। ছাত্র, সাধারণ জনতা, এমনকি শিশু-কিশোর! আকাশে হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছে। গুলিও করছে সেখান থেকে। খবর পাওয়া গেল, ঘরের ভেতরে থাকা কয়েকজন শিশু-কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন। তাদের কেউ বাড়ির ছাদে, কেউ জানালার পাশে, কেউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এর মধ্যেই আচমকা গুলি এসে তাদের কারও মাথায়, কারও বুকে বিদ্ধ হয়। বাবা-মায়ের চোখের সামনেই তাদের ফুটফুটে সন্তান নিমিষেই নিথর হয়ে যায়। এ শিশুরা তো আন্দোলনে নামেনি, আন্দোলন বোঝার বয়সও তাদের হয়নি! অথচ রাষ্ট্রের বুলেট থেকে রেহায় পেল না তারাও! এ খবরগুলো সারাদেশের সাধারণ মানুষকে আরও বেশি নাড়িয়ে দিলো, আরও বেশি একাত্ম করল আন্দোলনের সাথে।
তড়িঘড়ি করে আদালতের রায়ের দিন ধার্য করা হলো। কোটাসংক্রান্ত বিষয়ে আগামী মাসে আদালতের যে রায় দেয়ার কথা, সরকারের হস্তক্ষেপে তা এগিয়ে আনা হলো। ২১ তারিখ আদালত রায় দিলেন, কোটা থাকবে মাত্র শতকরা ৭ ভাগ। সরকারি প্রশাসন মনে করল, শিক্ষার্থীরা এবার ঘরে ফিরে যাবে। তাদের দাবি মেনে নেয়া হয়েছে, এমন ছেলে-ভোলানো আয়োজনে শিক্ষার্থীরা শান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু তা হলো না। শুধু কোটার হার কমিয়ে দিলেই কি রক্তের হিসাব মিটে যায়! প্রতিটা ফোঁটা রক্তের হিসাব ছাড়া এ প্রজন্ম দমবে না! এ প্রজন্মকে এত সহজ ভাবলে তো হবে না! তবে, কারফিউ চলমান থাকায় আন্দোলন ৪৮ ঘণ্টার জন্য স্থগিত করে জানানো হলো, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কারফিউ তুলে নিতে হবে এবং প্রতিটি হত্যার বিচার হতে হবে। প্রতিটি হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত না হলে আন্দোলন আবার রাজপথে ফিরে আসবে।
এদিনও অসংখ্য ছাত্র-জনতা লাশ হয়ে ফিরলেন।
আন্দোলন স্থগিত হওয়ার খবরে মুগ্ধর বাবা-মায়ের জানে যেন পানি ফিরে এল! এ কয়দিন বুকের ওপর যেন পাথর চাপা দেয়া ছিল, এখন তা সরে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল বাবা-মা।
মুগ্ধ অবশ্য ফেরে না। অপেক্ষায় থেকে বাবা সন্ধ্যার পর বাইরের দিকে যান। কারফিউয়ের কারণে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় আজ রোববার অফিস যেতে হয়নি। গত দুইদিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় বাসা থেকে বের হননি বাবা। প্রায় তিনদিন পর বের হলেন। এ তিনদিন কেবল খবর দেখেছেন, বাইরে আসলেই কী চলছে তা আর দেখা হয়নি। হাঁটতে হাঁটতে মহাসড়কের দিকে গিয়ে তিনি চমকে উঠলেন। এখনও টিয়ারসেলের ঝাঁঝালো গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আগুন জ্বলছে কোথাও কোথাও। আর রাস্তার এখানে ওখানে পড়ে আছে রক্ত! একেবারে যেন তাজা রক্ত, কিছুক্ষণ আগেই হয়তো কারও বুক থেকে ঝরেছে এ রক্ত। রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে রাস্তার মাঝখান থেকে একপাশে এসে জমা হচ্ছে কোথাও কোথাও। বেখেয়ালে এরকম গড়িয়ে আসা রক্তে বাবা পা মাড়িয়ে যান, কিন্তু তিনি টের পান না। রক্ত-আগুনের দৃশ্যগুলো দেখতে ভালো না লাগায় বাবা বাড়ির দিকে ফিরে যান। বাবার জুতোর তলা থেকে রক্তের ছাপ পড়তে থাকে রাস্তায় রাস্তায়। সেভাবেই তিনি ফিরে আসেন বাসায়। বাসার দরজার সামনে রক্তের শেষ ছাপটি পড়ে, সবচেয়ে অস্পষ্ট ছাপ। কারও নজরে পড়ার কথা না, বাবারও তা পড়ল না। দরজার ভেতরের দিক থেকে জুতোটা হাতে নিয়ে ভেতরে সু-র‌্যাকে রেখে দিলেন। জুতোর তলার রক্তের ছাপও অন্ধকারে আড়াল হয়ে গেল।
বাসায় ফেরার পথে বাবা ভাবছিলেন, এসে দেখবেন মুগ্ধ তার ঘরে বসে আছে। কিন্তু তা সত্য হলো না। মোবাইলেও পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। পুরো দেশে ইন্টারনেট বন্ধ থাকলেও মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু আছে এখন। অথচ মুগ্ধর মোবাইলে ফোন যাচ্ছে না। হয়তো চার্জ নেই ফোনে, বাবা আশ্বস্ত হতে চেষ্টা করেন।
রাত বাড়তে থাকে, মুগ্ধ ফেরে না। মা অস্থির হয়ে পড়েন, বাবা সান্ত্বনা দেন, ‘বেশি চিন্তা করো না, সময় হলেই মুগ্ধ ফিরে আসবে। চলো, ঘুমিয়ে পড়ো।’
অথচ ঘুম আসে না কারও।
অপেক্ষার বলয়ে আটকা পড়ে থাকায় বাবা টের পান না, সেই সন্ধ্যায় মুগ্ধ ঘরে ফিরে এসেছে তার সাথেই, জুতোর তলায় রক্তের ছাপ হয়ে!

(বাস্তব জীবনের ‘মুগ্ধ’ ১৮ জুলাই শহীদ হয়েছেন। কিন্তু এ গল্পের বিস্তৃতি আরও কিছু দিন পর্যন্ত গিয়েছে। এখানে ‘মুগ্ধ’ নামটিকে আন্দোলনের রূপক একটি চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।)


১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

Comments

    Please login to post comment. Login