আমার বউ জানথিপিকে খুব ভালো চেনে। জানথিপির ব্যাপারে ব্যাপক পড়াশোনা তাঁর। মহামতি সক্রেটিসের বউ ওই জানথিপিকে সবাই যখন বদমেজাজি ও কলহপ্রিয় বলে ভর্ৎসনা করত, সক্রেটিস তখন জবাব দিতেন, জানথিপির তর্ক করার স্পিরিটের জন্যই তাঁকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। আমিও তাই বলি, তর্কই জীবন, তর্ক না থাকলে জীবন পানসে।
আমার গুরুজি সক্রেটিস বলতেন, যে মানুষ খাওয়া-পরায় অল্পতেই সন্তুষ্ট, সহজভাবে সরল কথায় সৎচিন্তায় সময় কাটায়, সেই সুখী—আধপেটা খেয়েও সুখী; মানুষের নিন্দা অত্যাচারের মধ্যেও সুখী। সক্রেটিসের বউ সক্রেটিসকে খুব মেপে মেপে টাকা পয়সা খরচ করতে দিতেন। পুরুষ মানুষের মন, অতিরিক্ত টাকা পেলে কোথায় না আবার কী করে বসে। জানথিপির খাস শিষ্য আমাদের তিনিও এ কালের জানথিপি। তাই আমিও সক্রেটিসের মতো খাওয়া-পরায় অল্পতেই সুখী হওয়ার ভাণ করি।
সেকালের জানথিপি একবার উত্তেজিত হয়ে সক্রেটিসের মাথায় জল ঢেলে দিয়েছিলেন। সক্রেটিস তখন বলেছিলেন, গর্জনের পরেই নামে বারিধারা। কথিত আছে সক্রেটিসকে তাঁর বউ যখন ঝাড়ুপেটা করছেন, আর সক্রেটিস কিনা শান্তভাবে বই পড়ে যাচ্ছেন। এহেন জানথিপি'র কাছ থেকে উচিৎ শিক্ষা নিয়েই সক্রেটিস বলতেন, বিয়ে করবে, তোমার বউ ভালো হলে সুখী হবে, আর খারাপ হলে হবে দার্শনিক।
বউকে বললাম, তুমি আমার আধেক ভালো, আর আধেক খারাপ। তাহলে আমার দশা কী হয়েছে তুমিই বলো?
এই কথায় আমাদের মধ্যে লেগে গেল তুমুল ঝগড়া। এক পর্যায়ে আমার গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল বউ। কিছুই হয়নি, এমন ভাব করে বললাম,
: এই চড়টা কি তুমি ইয়ার্কি করে মারলে? না সত্যি সত্যি মারলে?
: সত্যি সত্যিই মেরেছি।
: ঠিক আছে, ইয়ার্কি আমি আবার একদম পছন্দ করি না।
ঝগড়ার ঝড়ো গতি আরও বাড়ল। বাজখই গলায় বউ বলে উঠল,
: আমি বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছি।
: এই নাও ভাড়া।
: অ্যা! এতে তো ফেরার ভাড়া নেই।
আমি হেসে দিলাম। রাগ কিছুটা নেমে এল। এবার বউয়ের গলায় খানিকটা আহ্লাদে সুর।
: হ্যাগো, আমি মরে গেলে তুমি কী করবে?
: তুমি মরে গেলে আমি পাগল হয়ে যাব! আমিও গদগদ হয়ে প্রত্যুত্তর করলাম।
: আর একটা বিয়ে করবে না তো?
: পাগল হলে মানুষ কত কী করে সে খেয়াল কি আর থাকে?
আমার বউয়ের বক্তব্য আমি নাকি লিখে লিখে দেশ উদ্ধার করি। কিন্তু ওইসব আউলফাউল লেখা কেউ একপলক চোখ বুলিয়েও দেখে না। সেদিন মেজাজ গেল বিগড়ে। ঘরের লোহার আলমিরা খুলে পুরনো ফাইল ঘাটতে লাগলাম। শশব্যস্ত হয়ে ও গলা ছাড়ল,
: এতক্ষণ ধরে ওই কাগজটিতে কী দেখছ তুমি?
: কই, কিছু না তো!
: আরে, এ যে দেখি ডাহা মিথ্যে কথা বলছ। তুমি প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে আমাদের কাবিননামা এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছটা কী, শুনি?
: না, তেমন কিছু না। অনেকক্ষণ ধরে খুঁজেও কেন জানি কাবিননামার মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখটা বের করতে পারলাম না!
তার পরে কী কী ঘটল সেটা জানে আমার প্রাণের বন্ধু। ওইদিন বন্ধু বলছিল,
: তুই তোর বউর সাথে ঝগড়া করিস?
: হ্যাঁ, করি তো। তবে প্রতিবার ঝগড়ার শেষে বউ এসে হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসে পড়ে।
: বলিস কী! তারপর?
: তার আর পর কী? মাথা ঝুঁকিয়ে বলে, ‘খাটের তলা থেকে বেরিয়ে আসো সোনা। তোমায় আর মারব না।’
হাতে ভার্চুয়াল কলম থাকলে কতকিছু লিখে ফেলে যায়। আমিও থার্টিফার্স্ট রঙ্গটা লিখে ফেললাম। আজ দুইজনের মন একসাথে ভালো ছিল। তাই বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সেখানেও দুদণ্ড শান্তি নেই। পুরনো অভ্যাস বকবক চলতেই থাকল,
: কী ব্যাপার, আগের সরকারের আমলে তো খুব কলমবাজি করলা! এখন চুপচাপ বিষয় কী? নাকি ডিগবাজি দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করছ?
: ডিগবাজি আমরা দেব না, আফটার অল আমরা বুদ্ধিজীবী... ডিগবাজি দেবে আমাদের কলম!’
লেখক: সাংবাদিক
৩১ ডিসেম্বর ২০২৪