পথের ‘পরে পায়ের চিহ্ন
আবদুল খালেক
প্রকাশক: মুহাম্মদ আলমগীর রহমান, কালিকলম প্রকাশনা
ফোন: +৮৮০১৯৭৭৩৭৯৭৩৬, +৮৮০১৫৫৮১৩০৪৯৪
http://rokomari.com/kalikolom, e-mail : kalikolomprokashona@gmail.com
পরিবেশক: (১) রকমারি, ঢাকা।
(২) মুক্তধারা, জ্যাকসন হাইট, নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।
(৩) সঙ্গীতা লিমিটেড, ২২ ব্রিক লেন, লন্ডন, যুক্তরাজ্য।
প্রথম পর্ব: বিন্নাফৈর
অধ্যায়-১: টুলু
টুলুর ঘুম ভাঙলো গাই দোয়ানোর শব্দ শুনে। ঘুম ভাঙার পর শুয়েশুয়েই সেই গাই দোয়ানোর চিরৎ চেরৎ চিরৎ চেরৎ শব্দটা শুনতে পাচ্ছে। বাড়ির হাইল্যা রবিউল প্রতিদিন এই সময়তাদের বাড়ির দুটো গাভী গরুর দুধ দোয়ায়। আর প্রতিদিন ঠিক এই সময়েই টুলুর ঘুম ভেঙে যায়।হয় সে ঘুমভেঙে গাই দোয়ানোর শব্দ শোনে, অথবাগাই দোয়ানোর শব্দ শুনেই তার ঘুমটা ভেঙে যায়। আজও তেমনি একটা সকাল।প্রতিটি সকালই টুলুর কাছে নতুন বলে মনে হয়। মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। এখন সে বিছানা থেকে নেমে পড়ল।তারপর এক দৌড়েঘর থেকে বের হয়ে উঠানের পাশে যেখানে রবিউল গাই দোয়াচ্ছিল সেখানে গিয়ে তার গাই দোয়ানো দেখতে লাগল।সময়টা পঞ্চাশ দশকের মাঝামঝি। টুলু এখনও বেশ ছোটো। তাই এখনও এই দুনিয়ার অনেক কিছুই সে জানে না।সে ছোটোবলে তার ঘুরে বেড়াবার পরিধিটাও খুব ছোটো। অথচ তার জানার আগ্রহ সবসময় তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।বাইরের জগতের আকর্ষণ সবসময় তাকে টানে। বাইরের পৃথিবীটা কত বড়ো তা সে জানেনা।কিন্তু এই সুন্দর পৃথিবীটাকে ভালো করে দেখার জন্য সবসময় সে উদগ্রীব হয়ে থাকে। এ নিয়ে তার আগ্রহ আর কৌত‚হলের শেষ নেই।খেলার সাথিদের সাথে সে এ নিয়েকথা বলে। কিন্তু কেউ তাকে সঠিক ধারণা দিতে পারে না।তার খেলার সাথি বলতে পাশের দুই বাড়ির হানি ও কাসু। এরা দু’জনই টুলুর সমবয়সি।অবশ্য টুলুর ছোটো ভাই দুলুও এখন তার খেলার সাথিই বটে।
আকাশটাকে দেখে টুলুর মনে হয় দূরদিগন্ত সীমার কাছে গিয়ে ওটা মাটির সাথে এসে মিশেছে।মনে হয় যেনএকটা মস্তবড় নীল রঙের গোলাকার বাটি দিয়ে দুনিয়াটাকে ঢেকে রাখা হয়েছে।ওখানে গিয়ে আকাশটাকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে তার।প্রায়ই তার মনে হয়, সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলেই এক সময়ওই আকাশটাকে সে ছুঁতে পারবে।তার এই ইচ্ছার কথাটা একদিন সে তার মা’কে বলেই ফেলে।
- “আচ্ছা মা, বলো তো, আমি যদি সামনের দিকে হাঁটা শুরু করি আর হাঁটতেই থাকি, হাঁটতেই থাকি, তাহলে কি কোনোএক সময় আমি ওই আকাশটার কাছে গিয়ে ওটাকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে পারব?”
- “আমার পাগল ছেলের কথা শোনো! আকাশ কি কেউকোনো দিন হাত দিয়ে ছুঁতে পারে?” মা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন।
- “কেন মা, আকাশটা তো পৃথিবীর চারদিকে ঘিরে আছে। দুনিয়ার শেষ মাথায় তো সেটা মাটির সাথে এসে মিশেছে। তাহলে আমি সেটা ছুঁতে পারব না কেন?” টুলু তার নিজের যুক্তিটা মায়ের কাছে তুলে ধরে।
একথা শুনে তার মা উত্তর দেন,
- “শোন্রে খোকা, ওইআকাশটা কোথাও দুনিয়ার সাথে মেশেনি। ওরকম দেখা যায় সত্যি, কিন্তু এটা শুধুই চোখের ভুল। ওই আকাশটা এই পৃথিবী থেকে অনেক দূরে আছে। কেউ ওটাকে ছুঁতে পারবে না।”
মায়ের এই কথাশুনে টুলুর মনটা খারাপ হয়ে গেল।
তাহলে এতদিন সে যা ভেবেএসেছিল, তাআসলে মোটেই ঠিক নয়! সে তাহলে কোনোদিনই আর ওইআকাশটাকে ছুঁয়ে দেখতে পারবে না!
বাড়ি থেকে বের হয়ে বাইরের জগৎটাকে দেখার জন্য টুলু সবসময় উদগ্রীব হয়ে থাকে। তাই যখনই তার বাবা বাড়ি থেকে বের হয়ে বাইরে কোথাও যান, তখনি সে তারসাথে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বাবার সাথে বাইরে যাবার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। কিন্তু সেই সুযোগ বা সৌভাগ্য তার সবসময় হয় না। সে এখন ছোটো বলেই সেটা সম্ভব হয় না। শুধুমাত্র গ্রামের পশ্চিমের বড়ো নদী ও বিন্নাফৈর বাজার পর্যন্তই তার যাবার সীমা। তবে সেটা তখনই সম্ভব হয়, যখন তার বাবা তাকে সাথে করে নিয়ে যায়। এছাড়া অন্য সময় হানি ও কাসুর সাথে ওদের বাড়িতে অথবা খালের পাড়ে অথবা তার ছোটো ভাই দুলুর সাথে নিজেদের বাড়িতে খেলা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
টুলুর মনে মাঝে মাঝেই একটা প্রশ্নের উদয় হয়। প্রশ্নটা একদিন সে তার মা’কে করেই ফেলে।
- “আচ্ছা মা, বলো তো, আমি কীভাবে, কোথাহতে এলাম এই দুনিয়াতে? আমি কোথায় ছিলাম এর আগে? আমার তো কিছুই মনে পড়ে না।”
একথা শুনে তার মা হেসেউত্তর দেন,
- “শোন্রে খোকা, তুইতো এক সময়ছিলি ওই আকাশের গায়ে একটা তারা হয়ে। তারপর এক সময় আমার এই পেটের মধ্যে ছিলি। তারপর এই দুনিয়াতে এসেছিস।”
- “আচ্ছা মা, সব মানুষই কি এভাবে দুনিয়াতে আসে?”
- “হ্যাঁরে বাবা, সবমানুষই এভাবেই আসে। আমিও এভাবেই এসেছি দুনিয়াতে। এক সময়আমিও তোর নানির পেটের মধ্যে ছিলাম।”
একথা শুনে টুলু তো অবাক!
টুলুর বিস্ময় আর অবাক হবার পালা শেষ হতে চায় না। ভোরে পুবদিক হতে সূর্য উদয় হয়। আবার সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশের গা থেকে ওই গাঁয়ের পিছনে বড়ো গাঙের ওপারে সূর্যটা ডুবে যায়। সেটা তো দুনিয়ার শেষপ্রান্তের মাটির নিচে তলিয়ে যায়।
তাহলে আবার পরদিন সকালে মাটির নিচ হতে সেটা কীভাবে উঠে আসে? রাতের বেলা ওই সূর্যটা আসলে থাকে কোথায়? সূর্যটা যখন উদয় হয় তখনসেটা দেখা যায় কত্তো বড়ো! মনে হয় যেন লাল রঙের মস্তবড়ো একটা থালা। আবার সন্ধ্যার সময় যখন সেটা ডুবে যায়, তখনও সেটা ঐ একইরূপ ধারণ করে। অথচ দুপুর বেলা তার প্রচন্ড তেজ আর উত্তাপের জন্য তার দিকে তাকানো যায় না। এটা কীভাবে হয়? ওর ভিতরে কি আগুনআছে? যদি তাই থাকে, তবে তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে না কেন? এই প্রশ্নগুলো টুলুর মনে অনবরত ঘুরতে থাকে।
সে থাকতে না পেরে শেষ পযন্ত একদিন তার বাবার কাছে এই প্রশ্নগুলো করে বসে। উত্তরে তার বাবা তাকে বলেন,
- “শোন্ বাবা টুলু, তুই যে এইপৃথিবীটা দেখছিস, এটা তোর কাছে সমতল বলে মনে হলেও এটা আসলে মস্তবড়ো গোলাকার একটা বলের মতো। সূর্য যখন এই পৃথিবীর এক পাশ থেকে অন্য পাশে চলে যায়, তখন আর আমরা সেটাকে দেখতে পারি না, তখন আমরা বলি সূর্য ডুবে গেছে আর রাত হয়ে গেছে। তুই আগে আরও বড়ো হ, তখন সব জানতে পারবি, সববুঝতে পারবি।”
একথা শুনে টুলুর মনে হয়, ইস্! কবে যে সেবড়ো হবে!
বিকেলে বাবার হাত ধরে টুলু যখন নদীর পাড়ে বেড়াতে যায়, তখন সেই নদীটা দেখেও সে অবাক হয়ে যায়। এত্তো বড়ো নদী! এখান থেকে ওপারের গ্রামগুলোকে ঠিকমতো দেখা যায় না। কেবল কালো একটা রেখার মতো মনে হয়। যখন দখিনা বাতাস থাকে, তখন এই নদীরপানিতে বড়ো বড়ো ঢেউ ওঠে। টুলু বাবার সাথে নদীর পাড়ে এসে একদিন সেই ঢেউ দেখে দরুণ অবাক হয়ে গিয়েছিল। টুলু আরও দেখেছে, এই নদীর এতো পানি, সবই ¯্রােতের সাথে দক্ষিণ দিকে চলে যাচ্ছে। এতো পানি আসে কোথা থেকে, আরযায়ই বা কোথায়? এই সবপ্রশ্নগুলো তার মনের মাঝে অনবরত ঘুরপাক খেতে থাকে।
সে তার বাবাকে প্রশ্নটা করেই ফেলে,
- “আচ্ছা বাবা, এইনদীর এতো পানি, সবই¯্রােতের সাথে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে চলে যাচ্ছে। এতো পানি আসে কোথা থেকে, আর যায়ই-বা কোথায়?”
একথা শুনে তার বাবা উত্তরে বলেন,
- “এই নদীর যতো পানি দেখছিস, সবই আসে অনেক উত্তরের হিমালয় পর্বতের মানস সরোবর থেকে। আর সবপানিই দেশের দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগরের পানির সাথে গিয়ে মেশে। তুই আগে বড়ো হ, লেখাপড়া র্ক, তখন এ সব কিছুই তুই জানতে পারবি।”
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে টুলু দেখে, ওই যে কত নায়ের বহর লাল, নীল, হলুদ নানা রঙের পাল উড়িয়ে ভেসে যাচ্ছে নদীর বুক চিরে! টুলু ভাবে, ওই নৌকায় যারা আছে, তাদের বাড়ি কোথায়? ওরা কোথা থেকে এসেছে? আর যাচ্ছেইবা কোথায়? নৌকার মাঝিরা বৈঠা টানছে না, বাতাসে নায়ের পালগুলো ফুলে উঠেছে, আর নৌকাগুলো ¯্রােতের বিপরীত দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এসব দেখে টুলু শুধু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। তার ইচ্ছা হয়, সেও যদি ওই লোকগুলোর মতো নৌকা নিয়ে নদী দিয়ে উজান দিকে যেতে পারত সব ¯্রােতকে পিছনে ফেলে, তাহলে কতই না মজা হতো! কিন্তু সে তো এখনও একেবারেই ছোটো। সে যে কবে বড়ো হবে, আর কবে যে সে ওই রকম নৌকায় উঠে হাল ধরে বসে নৌকা চালাতে পারবে, কে জানে!