ফকির লালন শাহ (১৭৭৪ - ১৮৯০) বাংলার একটি অতি বিখ্যাত সাধক, দার্শনিক, আধ্যাত্মিক গুরু ও কবি ছিলেন। তিনি 'লালন ফকির' নামেও পরিচিত। লালন শাহের জীবন কাহিনী অনেকটাই রহস্যময় এবং তাঁর আধ্যাত্মিক দর্শন আজও অনেক মানুষের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
প্রাথমিক জীবন:
লালন শাহের জন্ম ১৭৭৪ সালের ২৪ অক্টোবর (১৮৭৭ সালের লিপি অনুসারে) বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার চরমপন্থী গ্রামে। তবে তাঁর জন্ম এবং শৈশব নিয়ে নানা মতবাদ আছে। অনেকের মতে, তিনি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, আবার কিছু গবেষক বলেন যে তিনি হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবে তাঁর বয়ঃসন্ধির সময়ই ধর্ম ও জাতি নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করেছিলেন, এবং তিনি সমাজের প্রচলিত ধর্মীয় গণ্ডির বাইরে এসে আধ্যাত্মিকতা এবং মানবতার পথে চলতে শুরু করেন।
আধ্যাত্মিক জীবনের সূচনা:
একটি সময় লালন শাহের শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। তাঁর শরীরের জন্য কোনো চিকিৎসা কার্যকর হচ্ছিল না। তখন তিনি এক আধ্যাত্মিক গুরু চাঁদ আলী ফকিরের কাছ থেকে শিক্ষা নেন এবং তাঁর অধীনে আধ্যাত্মিক সাধনা শুরু করেন। চাঁদ আলী ফকির তাঁকে ঔষধী গুণাবলী, অন্তর্দৃষ্টি ও সত্যকে উপলব্ধি করার উপায় সম্পর্কে শিক্ষা দেন। এর পর লালন ফকির 'ভিক্ষু' বা সাধু জীবন গ্রহণ করেন এবং তাঁর দর্শন ও গীতিকাব্যের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জ্ঞান প্রচার করতে শুরু করেন।
দর্শন ও মতবাদ:
লালন শাহের দর্শন ছিল অত্যন্ত উদার এবং মানবতাবাদী। তাঁর মতে, মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তা বা "আত্মা" কোনো ধর্ম, জাতি বা সমাজের গণ্ডি মেনে চলতে পারে না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, আধ্যাত্মিক মুক্তি বা মুক্তির পথ আসলে মানবতার মাঝে। তাঁর গানের মাধ্যমে তিনি সমাজের নানা অযথা পার্থক্য, ভেদাভেদ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। তিনি বলতেন, "মানুষ ভবে বেদে তারে হারাইছে, সে তো দেখি নিজেকে আর অপরকে খোঁজে" অর্থাৎ, মানুষ নিজেকে জানলে এবং আত্মজ্ঞান অর্জন করলে তখন সমস্ত পৃথিবী তার কাছে এক হয়ে যাবে।
লালন ফকিরের গান:
লালন ফকিরের গান আজও বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রত্ন। তাঁর গানে সমাজের অসঙ্গতি, ধর্মীয় কুসংস্কার এবং মানবতার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গানগুলোর মধ্যে প্রায়শই আধ্যাত্মিকতা, প্রেম, প্রকৃতি এবং মানবতার নিখাদ সুর ফুটে ওঠে। তাঁর গানে বৈষম্য, হিংসা, এবং সকল সামাজিক বাধা দূর করার আহ্বান রয়েছে।
একটি উদাহরণ হিসেবে তাঁর বিখ্যাত গান: "অসংখ্য পথ বেঁধেছে ভেদ, অভ্যন্তরে পথ এক"।
মৃত্যু:
ফকির লালন শাহ ১৮৯০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর শিক্ষা এবং গানগুলি আজও মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলছে। তাঁর পুণ্যভূমি, কুষ্টিয়ার আখড়াবাড়িতে ভক্তরা প্রতিদিন আসেন এবং তাঁর গানের মাধ্যমে তাঁর দর্শনের অনুশীলন করেন।
উপসংহার:
ফকির লালন শাহ ছিলেন একজন মহামানব, যিনি সমাজের বিভাজন, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় ভেদাভেদকে অগ্রাহ্য করে একীভূত মানবতার সন্ধান করেছিলেন। তাঁর জীবন ও দর্শন আজও বাংলা সংস্কৃতি এবং সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ।