রাতের আকাশে অসংখ্য তারা ছড়িয়ে আছে। নিচে বসে তারা গুনছে রিয়া। তার বয়স মাত্র তেরো, কিন্তু তার স্বপ্নের পাখা বিশাল। তার চোখে একদিন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন। গ্রামের মেয়েটি প্রতিদিন রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে, "আমি কি কোনোদিন এই তারাগুলোর কাছাকাছি যেতে পারব?"
রিয়ার বাবা দিনমজুর। তার মা গ্রামের অন্য মহিলাদের সঙ্গে কাজ করেন। বড় কোনো স্বপ্ন দেখার সামর্থ্য তাদের নেই। কিন্তু রিয়া ছোট থেকেই জানে, তার জন্য শুধু আকাশই সীমা নয়।
একদিন, স্কুলে একটি বিজ্ঞান মেলা হলো। সেখানে একটি প্রদর্শনীতে রিয়া দেখল, কীভাবে একটি রকেট মহাকাশে যায়। তার মনে হল, এই জগৎটা যেন তাকে ডাকছে। সেই দিন থেকেই রিয়া ঠিক করল, সে একদিন মহাকাশে যাবে।
গ্রামে এ কথা শুনে সবাই হাসল। কেউ কেউ বলল, “গ্রামের মেয়েরা আকাশে যায় না, তারা শুধু মাটির কাছাকাছি থাকে।” কিন্তু রিয়া হাল ছাড়ল না। প্রতিদিন স্কুলের পর সে লাইব্রেরিতে গিয়ে মহাকাশ ও রকেট সম্পর্কে পড়াশোনা করত। স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক মিসেস কিরণ তার এই আগ্রহ দেখে তাকে আরও উৎসাহিত করলেন।
রিয়ার জীবনে তখন একজন নতুন মানুষ এল – আরিয়ান। সে রিয়ার স্কুলের সিনিয়র এবং একই সঙ্গে বিজ্ঞান প্রেমী। আরিয়ান ছিল শান্ত, স্থির এবং গভীর চিন্তাশীল। স্কুলে বিজ্ঞান প্রজেক্টে কাজ করতে গিয়ে তাদের পরিচয়। ধীরে ধীরে তারা একে অপরের খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠল। রিয়ার স্বপ্নের প্রতি আরিয়ান সবসময় শ্রদ্ধাশীল ছিল। সে রিয়াকে বলত, "তুমি একদিন আকাশ ছুঁবে, আমি জানি।" আরিয়ানের এই বিশ্বাস রিয়াকে আরও শক্তি জোগাত।
বছর কয়েক পর, মাধ্যমিক পরীক্ষায় রিয়া প্রথম হলো। তার নাম পত্রিকায় ছাপা হলো। এই সাফল্য তার বাবার চোখে জল এনে দিল। তিনি রিয়াকে বললেন, “তোর স্বপ্ন পূরণ করতে যা দরকার, কর। আমি তোকে থামাব না।”
রিয়া সুযোগ পেল শহরের বড় এক কলেজে পড়ার। প্রথমে গ্রাম ছেড়ে যেতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু তার স্বপ্ন তাকে টেনে নিয়ে চলল। শহরের কলেজে এসে সে আরও অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে পরিচিত হলো। সবাই তাকে বলল, মহাকাশে যাওয়া সহজ নয়। কিন্তু রিয়া জানত, সহজ জিনিসের জন্য সে স্বপ্ন দেখেনি।
আরিয়ানও তখন অন্য শহরে পড়াশোনা করছিল। যদিও দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল, তাদের সম্পর্কের গভীরতা একই রয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিনের কথোপকথনে আরিয়ান তাকে সাহস দিত। একদিন রিয়া যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, আরিয়ান বলেছিল, "তোমার এই পরিশ্রম শুধু তোমার নয়, আমাদের স্বপ্ন পূরণের পথ।" রিয়া সেই কথা মনে রেখে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে চলল।
কলেজের শেষ বর্ষে রিয়া একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিল। প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল, “কীভাবে কম খরচে রকেট তৈরি করা যায়।” রিয়া নিজের মতো করে একটি পরিকল্পনা তৈরি করল। তার পরিকল্পনাটি বিচারকদের এত ভালো লাগল যে, সে প্রথম পুরস্কার পেল। সেই সঙ্গে পেল বিদেশে পড়াশোনার স্কলারশিপ।
রিয়া বিদেশে পড়াশোনা করতে গেল। সেখানে সে একের পর এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলো। কখনো অর্থের অভাব, কখনো প্রযুক্তিগত জটিলতা। কিন্তু তার ধৈর্য আর অধ্যবসায় তাকে সবকিছু মোকাবিলা করতে শিখিয়েছিল। আর প্রতিটি কঠিন সময়ে আরিয়ান তার পাশে ছিল, দূরে থেকেও। তার বার্তাগুলো রিয়ার মনোবল বাড়িয়ে তুলত।
অবশেষে, একদিন সেই মুহূর্ত এলো। রিয়া একটি গবেষণা দলের অংশ হিসেবে মহাকাশযানের নকশা তৈরি করল। নকশাটি সফল হলে, তাকে মহাকাশ অভিযানের জন্য নির্বাচিত করা হলো।
যেদিন রিয়া প্রথম মহাকাশে পা রাখল, সেদিন পৃথিবীর আকাশ থেকে সে তার গ্রাম নীলপুরকে খুঁজে দেখল। তার মনে পড়ল, সেই ছোট্ট ঘর, তার বাবা-মা, আর তারা গোনা রাতগুলো। সে মনে মনে আরিয়ানকে ধন্যবাদ জানাল, যিনি তার স্বপ্নের যাত্রায় অনুপ্রেরণা হয়ে ছিলেন।
মহাকাশের নিঃশব্দ শূন্যতায় রিয়া মনে মনে বলল, “আমার স্বপ্নের আকাশপথ আজ সত্যি হলো।”
রিয়া ফিরে এলো পৃথিবীতে। সে শুধু নিজের স্বপ্ন পূরণ করেনি, গ্রাম আর দেশের লক্ষ লক্ষ মেয়ের কাছে প্রমাণ করল, সাহস আর অধ্যবসায় থাকলে আকাশও সীমা নয়। আর সেই গল্পের প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল আরিয়ানের অবিচল সমর্থন।