হ্যাপি নিউ ইয়ার ২০২৫। যে যেখানে যেভাবেই থাকি সবার সর্বোত মঙ্গল কামনা করি। সবাই কেমন মুখিয়ে ছিল এই ভাবনায় যে, সবখানে সবকিছু আমূল পরিবর্তন হয়ে যাবে। জুলাই বিপ্লবের রিসেট বাটন সব কলুষ, সব ক্লেদ, চারিধারের সব অন্ধকার দূর করে দেবে। পাবলিকের মুখ হয়ে কথা বলবে সরকার। পুরাণকথার নিয়ম মেনে আমরা আমাদেরকে পরিবর্তন করি আর না করি, কোনো এক অচিনপুর থেকে মহামহিম জাদুকর এসে আমাদের দুঃখ ঘুচিয়ে দিয়ে যাবে। বিষন্নতায় আমরা আর মুষড়ে পড়ব না। বিবশ বেদনায় কুঁকড়ে যাবো না। কিছুতেই হতাশ বা নিরুদ্যম হবো না। বিভেদকে জলাঞ্জলি দেব। ঘৃণা ও প্রতিহিংসাকে পাঠাবো গহিন নির্বাসনে।
এখানে বৃষ্টি হবে বজ্র বা শিলাপাত হবে না। এখানে রোদ ঝলমল করবে খরায় পুড়বে না। বর্ষা হবে বাণ ডাকবে না। ফুল ও ফসলে ভরে উঠবে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, আগাছা হারিকেন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ডিএল রায়ের গান, 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি'র অধিক প্রশংসা প্রাপ্য হবে আমাদের এই দেশমাতা। 'মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি'র রাবীন্দ্রিক আকুতি সত্যিকার অর্থেই আমাদের সবাইকে স্পর্শ করবে।
কিন্তু না! কিছুই যেন হয়ে উঠল না। নিজের মেরুদণ্ডে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেশটার এখনও অনেক বাকি। ৫৪ বছরের বাংলাদেশে ২০২৪ মনে রাখবার মতো বছর। ডামি নির্বাচনে একটা সরকার এল। সেই সরকারকে হঠিয়ে দিল ছাত্র-জনতা। রীতিমতো গণভবন, সংসদ ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দখলে নিল বীর জনতা। উপায়ান্তর না দেখে 'পদত্যাগ ও প্রতিশ্রুতি' না রেখেই ভেগে গেল ১৫ বছরের স্বঘোষিত শক্তিমান সরকার।
চব্বিশে যারা হেরে গেছে তাদের বিরুদ্ধে 'দুর্নীতি ও দুঃশাসন'সহ বিস্তর অভিযোগ। তার ওপর জুলাই আন্দোলনে হাজারখানেক প্রতিবাদী মানুষের প্রাণহানির কঠোর বিচারের তাড়না।
আচ্ছা শাস্তি নিশ্চিত দূরে থাক, ৫ মাস বয়সী অন্তর্বর্তী সরকার আগের রেজিমের অভিযুক্ত কয়টা কর্তাব্যক্তিকে ধরে আইনের আওতায় আনতে পেরেছে? বিদেশে পাচার হওয়া কয়টাকা দেশে ফেরত এনেছে। মাত্র দু একজন বাদে সবাই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। বিপাকে পড়েছে প্রান্তিক কর্মীরা। তারা এখন প্রতিপক্ষের মামলার জালে আটকা পড়ে বাণিজ্যের রসদ হয়ে উঠেছে। পরিবারের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে।
আগে মিডিয়া স্বাধীন ছিল না। এখন দেশের কয়টা মিডিয়া নিরপেক্ষ অনুসন্ধানের মাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সত্য প্রকাশ করতে পারছে? কেউ পারবে না। এই দেশের গণমাধ্যমের কোনোকালেই স্বাধীনসত্তা বলে কিছুই ছিল না, এখনো নেই। সরকারের তল্পিবাহক না হলে তাদের দম থাকে না।
এমন একটা দেশে বিচার, সংস্কার, স্বপ্ন, পরিবর্তন, প্রত্যাশা, নির্বাচন, গণতন্ত্র; স্রেফ অলীক কল্পনা। গত ১৫ বছরে প্রশাসন, পুলিশ, বিচার ও ব্যবসাসহ রাষ্ট্রের নানা ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। এটাকে স্বাভাবিক জায়গায় আনার ব্যাপারে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রথম আলোর সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এটার জন্য রাজনৈতিক দল ও সরকার লাগবে, রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসতে হবে, রাজনীতি ছাড়া ও রাজনৈতিক সরকার ছাড়া এটা সম্ভব নয়।
অপরদিকে সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে হস্তক্ষেপ করতে দেবেন না বলে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন সেনাপ্রধান।
তাহলে রাজনৈতিক সরকার আসার আগে যে সংস্কারের বয়ান দিচ্ছে ইন্টেরিম গভমেন্ট তা কেমনে বাস্তবায়ন হবে এবং সংস্কার প্রস্তাবনা আনা হলেও সেটি পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার যে মেনে চলবে তার ওয়ারেন্টি বা গ্যারান্টি কে দেবে?
বস্তুত বাংলাদেশের যে সংস্কৃতি দাঁড় করানো হয়েছে সেখান থেকে বের হতে কয়েক যুগ নয় কেবল শতাব্দিও লেগে যেতে পারে। কাজেই আমাদের জীবদ্দশায় অন্তত দেখব না, এই দেশটা সিঙ্গাপুর বা জাপান না হোক; অন্তত মালদ্বীপ হয়েছে।
যে রক্ত জুলাইতে ঝরেছে। তার দাম এই জাতি দিতে পারবে না। একাত্তরের লাখো বীরের প্রাণের মূল্য যেমন চুকায়নি বাঙালি জাতি। কিছু গালগল্প আমরা শুনব। আত্মপক্ষ সমর্থকেরা নিজেদের গুণকীর্তন করে যাবে; স্রেফ এইটুকুই। সাধারণ মানুষের ভাগ্য বদলাবে না। কারণ আমরা নিজেদের বদলাবার মনস্তত্ত্ব অর্জন করতে চাই না। আমরা চাই বিভাজন, ঘৃণা ও প্রতিহিংসা জিইয়ে রেখে অপরকে ঘায়েল করতে। অন্যে ভালো থাকবে এই প্রতীতি আমাদের মধ্যে নেই। সততা, সৌন্দর্য আর ঔদার্যে আমরা চরম উদাসীন। আমাদের ভালো লাগে ক্ষেপে গিয়ে অন্যের কবর খুঁড়তে।
ধরুন অন্তর্বর্তী সরকার শেষে আরেকটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ করল, তারা কি ভিনগ্রহ থেকে উদয় হবে? হঠাৎ করে সাধুসন্তুর পদ গ্রহণ করে ফেলবে? এক কথায় উত্তর হলো না। এই যেমন এখন দেখেন এক দল রাস্তার লুটপাট ও চাঁদাবাজির দখল নিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে, আরেকদল প্রশাসনিক পদদখলে মরিয়া। রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলবেন? একদল এখনি নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসতে চাইছে। আরেকদল শক্তি সঞ্চয় করে শক্তপোক্ত হয়ে আটঘাট বাঁধতে চাইছে। একদল সংবিধান সংস্কার করে বাহাত্তরকে বাতিলের খাতায় রাখছে। আরেকদল ২০২৪ দিয়ে একাত্তরকে ঢাকতে বারণ করছে। এই যে এতোসব অমিল, অনৈক্য ও মতভিন্নতা; এরপর এদের কাছ থেকে সমন্নিত দেশপ্রেম আশা করা বাতুলতা। এরা সবাই ক্ষমতায় আরোহণ করবার বিষয়ে কেবল একমত, দেশ গঠন নিয়ে কারো কোনো চিন্তা নাই। কার্যত নির্বাচনের মাধ্যমে যেই দলই ক্ষমতা আসুক, তাদের নেতারা হয় ভ্লাদিমির পুতিন হয়ে উঠবেন, আদারওয়াইজ হয়ে উঠবেন কর্ণেল গাদ্দাফি। শাসন ক্ষমতায় কচ্ছপের আয়ু নিয়ে কীভাবে সারভাইব করতে হয় তা শিখিয়ে গেছে লাস্ট রেজিম। আমরা ওই রেজিমের কড়া সমালোচনা করব, কঠোর শাস্তি দাবি করব; কিন্তু লাস্ট রেজিমের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখবার তরিকা ও ফন্দিফিকিরগুলোকে খুব আন্তরিকভাবেই আত্মস্থ করে নেব।
এখন কী হচ্ছে? কোন সরকার ক্ষমতায় আছে বলে মনে হয়? ভূমি অফিস, জুডিশিয়ারি, পুলিশিং কিংবা অন্যান্য সেবাসংস্থায় আপনার প্রাধিকারে থাকা ন্যায্য সেবা পেতে বাড়তি অর্থ লাগে তো? এইদেশে কারা কারা ঘুষ খায় না। রাজউক ভালো হয়ে গেছে? বিএসটিআই বা দুদক সাধু হয়ে গেছে? পরিবহন সেক্টরে আলগা বাণিজ্য হয় না? ভোগ্যপণ্যে সিন্ডিকেট উঠে গেছে? গণমাধ্যমের জোরে হেডম দেখানো মালিকেরা সংবাদকর্মীদের ন্যায্য বেতনভাতা দেয়? ঋণখেলাপিরা ব্যাংকের টাকা ফিরিয়ে দিচ্ছে? আসলে কিছুই এক ইঞ্চিও বদলায় নাই। এবং বদলাবেও না। জাতিগতভাবেই আমরা দুর্নীতিপরায়ণতাকে স্বাভাবিক কর্মকান্ড বলে মেনে এবং মনে নিয়েছি। সাধুগিরি আর আমাদের রোচবে কেন?
এই দেশে সবাই স্বাধীন। দুই হাজার চব্বিশের পর খানিকটা বেশিই স্বাধীন। যে যা যেখান থেকে পারছে বাগিয়ে নিচ্ছে। রাতারাতি ধনিকশ্রেণির হাইব্রিড আওয়ামী লীগ জামায়াত-বিএনপি বনে যাচ্ছে। সরকারে থাকা তরুণ মুরুব্বিরা মুখে যা আসছে তাই বলে চলেছে। কারো কোনো ধৈর্য্য নেই। ভারিক্কি নেই। এত রক্তপাতের যে ট্রাজিক অনুভূতি বা কারুণ্য থাকবার কথা সেই ভাবগাম্ভীর্য তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সবাই কেমন আত্মস্বার্থনিমগ্ন হয়ে পড়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে অর্থগৃধ্নুতার অভিযোগ আসছে। মুরুব্বিরা যাদের প্রাণ, চোখ, হাত, পায়ের বিনিময়ে তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা পেল, ওই আমজনতার কথাই ভুলে যাচ্ছে তারা। অযোগ্যতায় উপহাস্য আমরা যে কেবল প্রতিহিংসাপরায়ণ ও জিঘাংসু এমন নয়, আমরা সমানভাবে ভুলভুলাইয়া জাতি। এখন ভালো বুঝি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কণিকায় 'স্বাধীনতা' কাব্যটি বৃথাই লিখে রেখেছিলেন।
শর ভাবে, ছুটে চলি, আমি তো স্বাধীন,
ধনুকটা একঠাঁই বদ্ধ চিরদিন।
ধনু হেসে বলে, শর, জান না সে কথা--
আমারি অধীন জেনো তব স্বাধীনতা।
লেখক: সাংবাদিক
০১ জানুয়ারি ২০২৫