Posts

গল্প

ছোট গল্প "ছদ্মনাম"

January 2, 2025

Nasima Khan

51
View

ছদ্মনাম
------নাসিমা খান ।।
হাত থেকে পড়ে গেলো চিনা মাটির প্লেটটা । মেঝের উপর পড়ে রইল ছয় টুকরো হওয়া অংশগুলো । উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো পুষ্প । ভীষণ বিরক্ত হলো নামটার উপর !পুষ্প সেতো ফুলদানিতে থাকে , সে মেঝেতে পাটির উপর হাত পা মেলে দিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে পড়ে থাকে। কে রেখেছিলো এই উৎকট উদ্ভট নামটা ।ভাঙ্গা প্লেটের উপর পা গলিয়ে চলে গেলো সে । কাটুক, রক্ত ঝরুক, তারপর তার এই পুষ্প নামের অবসান হোক ।
আজও টিউশনি রয়েছে। পায়ের নিচে যন্ত্রণা হচ্ছে। হয়তো কেটে গেছে। দেখলো না। আলনার উপর থেকে স্কার্ফটা টেনে আয়নার সামনে দাঁড়ালো । ঠোঁটটা শুকনো ।লিপজেল বের করে রেখে দিলো । না থাক । সাজতে ভালো লাগছে না । ব্যাগটা ঘাড়ে নিয়ে বের হলো । মনে হলো হয়তো দরজায় তালা দেওয়া হয়নি। এরকম প্রায় মনে হয় তার। কিন্তু কোনোদিন ফিরে আসে না। ভালো লাগে না তার । কী আছে যা চোরে নেবে !
ঐ দুএকটা থালা প্লেট, একটা খাট, লেখার টেবিল, ছোট্ট একটা টিভি ।
একগাদা পুরনো লেখা । এইতো সম্বল।পরোয়া করে না পুষ্প।
বেশ কয়েকটি টিউশনি রয়েছে । সপ্তাহে তিনদিন করে। টূকটুককি প্রথম শ্রেণিতে পড়ে । ভীষণ দুষ্টু । টুকটুকির মা ব্যাংকার । বাসায় থাকে ওর বাবা । হারুন সাহেব । ব্রকার । টুকটুকিদের বাসায় ঢুকতেই মুখোমুখি হারুন সাহেবের। প্রশ্ন করলেন,- কেমন ছিলেন মিস পুষ্প ?
পুষ্প বিরক্ত সূচক শব্দ করে বললো,- কতদিন বলেছি, আমি মিস নই ।
তাহলে আপনার হাসবেন্ডে নেই কেনো, আপনি কী ডিভোর্সী অথবা বিধবা ?
আপনাকে বলেছি এরকম প্রশ্ন করবেন, না ?
বলেছেন, কিন্তু ...
দ্বিতীয় দিন করলে আমি পড়াতে আসবো না ।
সরি, টুকটুকি পড়ার টেবিলে বসে আছে !
পুষ্প টুকটুকির পড়ার টেবিলে যায় । চেয়ার টেনে বসে । মন তার ভারাক্রান্ত । সত্যি তো । স্বামী ছাড়া একজন মহিলা মিস, বিধবা, অথবা ডিভোর্সী হতে হবে । সে কোনটা ? 
সমাজ জানতে চায় পুষ্প, মিস, বিধবা, নাকী ডিভোর্সী !
উঠে দাঁড়ায় পুষ্প । টুকটুকি বলে,-টিচার, আজ আমার ছুটি ?
ক্লান্ত ঠোঁটে হাসি এনে বলে,- হা, আম্মু সোনা, আজ তোমার ছুটি ।
টুকটুকি লাফাতে থাকে,-পাপা, পাপা আজ আমার ছুটি ।
হারুন সাহেব সামনে দাঁড়ায়,-রাগ করেছেন?
না।
চলে যাচ্ছেন ?
শরীরটা ভালো নেই ।
চা, খেয়ে যান ।
না, আজ থাক ।
পুষ্প বেরিয়ে আসে । রাস্তায় নেমে হাঁটতে থাকে। বাসাবো তার দ্বিতীয় টিউশনীটা রয়েছে । রেলক্রসিং পার হলেই শারমিনদের বাসা । শারমিন এস এস সি পরীক্ষার্থী । ডিসেম্বর মাস, শীতের প্রকোপ খুব বেশি নেই। তবু পুষ্পর গা শিরশির করতে থাকে। ঠাণ্ডা অনুভূতি জাপ্টে ধরেছে মনেও । বরফের মত শীতল হয়ে যাচ্ছে সে ।
শারমিনদের বাসায় ঢুকেই পুষ্প বললো,-এক কাপ চা দেবে শারমিন, খুব শীত লাগছে !
শারমিন অবাক হয়ে তাকালো, ম্যাম কখনও এক গ্লাস পানিও চেয়ে খান না ।
আপনি ঘামছেন,ম্যাম !
কী বলো, আমার তো শীত লাগছে !
আচ্ছা, আপনি বসুন আমি চা করে নিয়ে আসি।
তোমাদের বুয়া নেই ?
আছে, কিন্তু আজ আমি নিজে হাতে করে আনি ?
আচ্ছা, যাও ।
শারমিনের ছোট চাচা রুমে ঢুকলো ।এক নজরে সুপুরুষ । মুখে চাপ দাঁড়ি । কান্তিময় শান্ত চেহারার মানুষ ।মৃদু কণ্ঠে বললো-কেমন আছো ?
পুষ্প তুমি শব্দটাকে যথেষ্ট ঘৃণা করে ।পর পুরুষের মুখে সে শুনতে চায় না ।
দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলো,-কেমন আছো,পুষ্প ? ভেবে দেখেছো কিছু ?
পুষ্প ক্লান্ত কণ্ঠে বললো,- প্লিজ চুপ করুন ।
একটা মিথ্যে প্রহসনে জড়িয়ে থেকে কী লাভ বলো ?
চা নিয়ে শারমিন ঘরে ঢুকলো ।
ম্যাম 
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পুষ্প তাকালো শারমিনের দিকে,- তোমাকে কষ্ট দেবার জন্য দুঃখিত শারমিন, আমি চা খাবো না।
শারমিন তার ছোট চাচা বিল্লালের দিকে তাকালো,- চাচ্চু, তোমাকে দিই !
না ,তুই খা ।
শারমিন নীরবে চায়ের কাপ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে ।
পুষ্প হাত বাড়িয়ে বলে, দাও, আমিই খাই ।
শারমিন হেসে ফেলে। অনেক তৃপ্তি তার মুখে ।
খাবেন , ম্যাম ।
হু , দাও ।
ম্যাম একটা প্রশ্ন করবো ?
চায়ের কাপ দিতে দিতে শারমিন বললো,-ছোট চাচ্চু আপনাকে খুব লাইক করে ।
পুষ্প চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,- আজ তোমার সেটের অংক করার কথা ছিলো। বই বের করো শারমিন ।
পূষ্প হাঁটছে । ক্লান্ত অবসন্ন পা দুটি অবশ হয়ে আসছে । ছোট বেলা থেকে পুষ্প মঞ্চের অভিনেত্রীদের মত অভিনয় করে এসেছে । উলঙ্গ বিলের মাঝে দাঁড়িয়ে শ্বাস নিতে বড় সাধ হতো তার, পারিনি। খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করতো পারিনি । গরিবের মেয়ে । তার উপর গায়ের রঙ কালো । এরকম বেলাল্লাপনা করলে কেউ বিয়ে করবে না । আইবুড়ো থাকবে ! মাটির সোঁদা গন্ধ নিতে ইচ্ছে করেছে পারিনি, সময় নেই হৈ হল্লা করার, প্রকৃতির কাছে যাবার সাধ মাঠে মারা গ্যাছে ।প্রচুর টিউশনি । নিজের পড়া । সময় নেই । সময় হয়নি তার অবসরের গন্ধ নেবার ।অবসারের আমেজ জিরিয়ে জিরিয়ে নেবার সময় হয়নি তার। একগাদা ভাইবোনের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবার বিকল্প ছিলো সে। 
দীর্ঘ সময় চলে গেছে । ভাই বোনেরা বিয়ে সদী করে চলে গেছে যার যার সংসারে । বাবা মা মরে গেছেন । খোঁজ রাখেনি কেউ পুষ্পর ।
পুষ্প নিজ শহর ময়মনসিংহ ছেড়ে চলে এসেছে ঢাকাতে । কেউ রাখিনি খবর । দায়িত্ব শেষ হয়েছে পুষ্পর । কিন্তু নিজের দায়িত্ব নেবার জন্য ছিলো না কেউ ।
একদিন এক ঝড়ো হাওয়ার মত তার জীবনে চলে এলো মোহন ।
প্রতিদিন এই বাসেই যান ?
আমাকে আগে দেখেছেন ?
হা, প্রতিদিন ।
কী বলেন !
আমি   একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকুরী করি , আপনি ?
টিউশনি।
সংসার ?
হয়নি ।
বাবা মা ?
নেই ।
ভাই বোন ?
খোঁজ রাখেনি ।একা ?
হুম।
কোথায় থাকেন ?
হোস্টেল ।
মোহন বলেই চললো-আমার বউ ছেলে মেয়ে রয়েছে , সংসার সব ।
চলুন সামনে নেমে এক কাপ চা খাই, গল্প করি ।
পুষ্প সাধারণত পুরুষদের উপেক্ষা করে । তারপর গায়ে পোড়ে চা খাওয়া । চোখের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস করতে পারলো না । এই প্রথম শরীরে অনুভব করলো শিহরণ । মনে মনে বললো, এ পাপা
, এ অন্যায় ।
মোহন বললো, কী ভাবছেন ?
পুষ্প বললো- কিছু না ।
কিছুতো বটেই, আপনার চোখে এক ধরণের মায়া আছে ।
মায়া ?
হেসে উঠলো পুষ্প।
সেই হাসি তার জীবনে নেমে এলো একরাশ বর্ষা ।
সে ভিজে গেলো, দূরন্তপ্না, আহ্লাদ, আবদার, ঝগড়া খুনসুটি সব ।
কিন্তু কী বিভ্রান্তি । মোহন বিবাহিত । সংসার সব ঠিকঠাক চালায় সে । কী হবে তাদের পরিণতি ।
প্রেম পরিণতি চায়, মোহন ?
জানি ।
তুমি জেনে শুনে বিষ পান করেছো ।
তুমি করোনি ?
হুম , আমিতো বলেছি, আগুনে পুড়তে হবে ।
আমি তোমার বউ হতে চাই, মোহন ?
কিন্তু ?
চলো বিয়ে করি ।
তারপর ?
এভাবেই, গোপনে, সারাজীবন ।
অসম্ভব, তা হয় না।
মোহন আমি পারছি না ।
তারপর একদিন, ওরা রেজিস্ট্রিও সেরে নিলো । সমাজের কেউ জানলো না। কিন্তু মুসলিম বিবাহের শর্তইতো স্বীকৃতি !
সামাজিক স্বীকৃতি ।
পুষ্প একদিন নীরবে ঠিকানা ফেললো পালটে। মোবাইলের সিম দিলো বন্ধ করে । স্বীকৃতিহীন সম্পর্কে সে পুড়ে যাচ্ছে । সে জ্বলে যাচ্ছে ।
সে হাঁটছে । হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে শাহাবাগ মোড়।
সে স্থির সিদ্ধান্ত নিলো সে কাল অন্য শহরে চলে যাবে । তার ঠিকানা কাউকে দেবে না। তার নাম পালটে দিবে । তার নতুন নাম হবে ।
হয়তো সেখানে একজন করে হারুন সাহেব, ছোট চাচ্চুরা থাকবে ।
সে উলটো পথ ধরলো। রাতের শেষ ট্রেনটা হয়তো পেয়ে যাবে । কমলাপুর রেল ষ্টেশনে ঢূকলো। দৌড়ে টিকিট নিলো ।
টিকিট মাষ্টার জানতে চাইলো-নাম কী হবে ?
পুষ্প বললো-অনামিকা !

Comments

    Please login to post comment. Login