Posts

প্রবন্ধ

চা গুপ্তচর-ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘দ্য গ্রেট টি হাইস্ট’

January 2, 2025

সামিউল ভূঁইয়া

24
View

১৮৪৮ সাল

ওয়ু শিন মাউন্টেন রেঞ্জ, ফুজিয়ান প্রদেশ, চীন। 

শরৎকাল। চতুর্দিকে ঘন সবুজ গাছে আবৃত সারি সারি পাহাড়। সেই বিস্তৃর্ণ পাহাড়ি এলাকা ভেদ করে প্রায় ৬০ কিলোমিটার জুড়ে জিউকু নদী; যাকে নয়-বাঁক নদীও বলা হয়। প্রায় জনবিচ্ছিন্ন এই পাহাড়ি অঞ্চলে হঠাৎ এসে পড়লে যে কেউ এটাকে ভূ-স্বর্গ বলে ভুল করতে পারে। তবে পাহাড়ি রাস্তা ধরে এগোতে থাকা রহস্যময় মানুষটির আপাতত সেদিকে নজর নেই। মানুষটি পুরো দস্তুর একজন মংক বা বৌদ্ধভিক্ষু সেজেছে। পরনে বড় আলখেল্লা ও হাতে লাঠি। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ওঠার অনভ্যাসের কারণে একটু বেগ পেতে হচ্ছে তাঁর। তবে লাঠিটা ভালো কাজে দিচ্ছে। একটু সামনে লম্বা লম্বা পা ফেলে তাঁর আগমনের খবর দিতে এগিয়ে যাচ্ছে তাঁর সহচর ওয়াং। কিছু সময় পর সেই রহস্যময় ভিক্ষুটি এসে উপস্থিত হয় বিশাল কাঠের দরজায় ঘেরা একটি কারখানার সামনে। এমন শ্বাপদসংকুল পাহাড়ি এলাকায় কারখানা স্থাপনের ঘটনা যদিও চীনে নতুন নয় তবে তার মতো ভিনদেশীর কাছে এটা বিস্ময়কর। ভেতরে যাবার অনুমতির জন্য ওয়াং মূল ফটকে কারখানার প্রধানের সাথে কথা বলে। কারখানা প্রধান লক্ষ্য করে ভিক্ষুটিকে। ভিক্ষুটি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে তাকে অবিকল চৈনিক কনফুশিয়ান ভিক্ষুই মনে হচ্ছে। তবে কারখানা প্রধান আলখেল্লায় ঢাকা সে রহস্যময় মানুষটির আসল পরিচয় জানেন না। সেই রহস্যময় মানুষটির নাম রবার্ট ফরচুন। আর তিনি কোনো বৌদ্ধভিক্ষু নন; তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন গুপ্তচর। 

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি

উদ্ভিদবিজ্ঞানী থেকে গুপ্তচর 

উদ্ভিদবিদ,উদ্ভিদ শিকারী এবং ভ্রমণপ্রেমী রবার্ট ফরচুনের জন্ম ১৮১২ সালে বর্তমান স্কটল্যান্ডের এরডোমে। ছোটবেলা থেকেই উদ্ভিদের প্রতি ব্যাপক ঝোঁক ছিলো তাঁর। উদ্ভিদ সংগ্রহের নেশায় মত্ত ছিলো গ্লাসগো শহরের আশপাশে বেড়ে ওঠা তরুণ রবার্ট। সে নেশাই শেষমেষ তাকে লন্ডনের হর্টিকালচারাল সোসাইটিতে একটি উচ্চপদে পাইয়ে দেয়। সেখানে কর্মরত অবস্থায় ১৮৪২ সালের নানকিং চুক্তির (প্রথম আফিম যুদ্ধ শান্তি চুক্তি) পর ১৮৪৩ সালের শুরুর দিকে হর্টিকালচারাল সোসাইটি তাকে তিন বছরের জন্য দক্ষিণ চীন থেকে উদ্ভিদ সংগ্রহের এক অভিযানে পাঠায়।  

হর্টিকালচারাল সোসাইটির অংশ হিসেবে; রবার্ট দূরপ্রাচ্যে ভ্রমণ করেছিলেন সেখানের উদ্ভিদজগত সম্পর্কে জানার জন্য। তিনি তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেতেন। যার মধ্যে ছিলো নতুন উদ্ভিদ সন্ধানের দিনলিপি এবং জলদস্যু ও ডাকাতদের সাথে লড়াই করার লৌমহর্ষক কাহিনী। তাঁর এই লেখা নজরে আসে তৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। এর কারণ অবশ্য ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুরপ্রাচ্যকে জানার আর প্রভাব বিস্তার করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক প্রতিনিধি রবার্টকে খুঁজে বের করেন এবং ১৮৪৮ সালে তাকে চীনের অভ্যন্তরে একটি গোপন মিশনে পাঠানোর জন্য রাজি করান। রবার্ট ফরচুনের মিশনটি ছিলো চীনের পাহাড়ি অঞ্চল ফুজিয়ান প্রদেশে এবং অঞ্চলটি ছিলো সকল ভিনদেশীদের জন্য নিষিদ্ধ। রবার্টের মিশন ছিল: চা তৈরির প্রক্রিয়া শেখা এবং চায়ের চারা ও বীজ চুরি করা। মিশনটি বেশ বিদপজনক হলেও এটিকে সহজেই অস্বীকার করতে পারেননি রবার্ট ফরচুন। কারণ এই মিশনের জন্য তাকে বছরে ৫০০ পাউন্ড প্রস্তাব করা হয়–যা ছিলো রবার্টের তৎকালীন বেতনের পাঁচগুণ। তাই অর্থলোভে কিংবা উদ্ভিদ সংগ্রহের নেশায় অথবা দুই কারণেই রবার্ট ফরচুন এই গুপ্তচরবৃত্তিতে রাজি হন।

রবার্ট ফরচুন 
 
 

চীন ও চা 

চীনে চায়ের ইতিহাস প্রায় কয়েক হাজার বছরের। ধারণা করার হয় চা সর্বপ্রথম ব্যবহার হয় হলুদ নদী (হুয়াং হি) উপত্যকার শাং সাম্রাজ্যে (খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ বছর)। তবে চা ব্যবহারের প্রামাণিক দলিল পাওয়া যায় তৃতীয় শতাব্দীতে (চীনা চিকিৎসক হুয়া তুয়ার লেখা চিকিৎসা গ্রন্থে উল্লেখিত)। ১৬শ শতাব্দীর শুরুর দিকে চীনে আগত পর্তুগিজ পাদ্রী ও ব্যবসায়ীরা চা কে ইউরোপে জনপ্রিয় করে। এর ফলে ১৭শ শতকে ব্রিটেনেও চা তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তৎকালীন ব্রিটিশ রাজবংশ ও ধনীক শ্রেনীর কাছে খুব জলদি পানীয় হিসেবে পছন্দের শীর্ষে চলে আসে চা। হু হু করে বাড়তে থাকে চায়ের চাহিদা। এর ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে তা লাভজনক ব্যবসা হয়ে দাঁড়ায়। 

টি সেরেমনি 
 

তবে চা উৎপাদন ও একে ঘিরে আন্তজার্তিক বাজারের নিয়ন্ত্রণ পুরোটাই ছিলো চীনের হাতে। চীনের সেই একচেটিয়া আধিপত্যের কাছে কোনোভাবেই পেরে উঠছিলোনা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। চীন তাদের এই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য তাদের ব্যবসায়ীদের জন্য ভিনদেশীদের কাছে চা গাছের কোনো অংশ এমনকি বীজ বিক্রিও নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো। এর ফলে চীন চায়ের মূল্য এবং মানের উপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। দুই সাম্রাজ্যের মাঝে সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটায় প্রথম আফিম যুদ্ধ। চীন ব্রিটেনকে তাদের সাম্রাজ্যে আফিম পাচার বন্ধ করতে বললেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তা করতে অস্বীকৃতি জানায়। চীনের সম্রাট এই বিষয়টি নিয়ে রানী ভিক্টোরিয়াকে চিঠিও লিখেছিলেন। তবে ব্রিটেন আপোস না করায় দু দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও খারাপ হতে থাকে।

রবার্ট ফরচুনের মিশন 

ফিরে আসি রবার্ট ফরচুনের গল্পে। প্রথম আফিম যুদ্ধের পর চীনের চায়ের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ভাঙার পরিকল্পনা করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ভারত বর্ষের ক্ষমতা তখনও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে (১৮৫৭ সালের পর তা চলে যায় ব্রিটিশ রাজবংশের হাতে)। মূলত চা শুধু চীনেই জন্মাতো না। ভারতবর্ষের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলেও জন্মাতো। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আসামেও এর প্রচলন ছিলো। তবে আসাম উৎপাদিত চায়ের মান চীনের সমপর্যায়ের ছিলো না। এদিকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বোনা অধিকাংশ চা-ই নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো সঠিক প্রক্রিয়ার অজ্ঞতার কারণে। অন্যদিকে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাহিদা ছিলো উন্নত জাতের গাঢ় স্বাদের চা। এছাড়া চা তৈরির প্রক্রিয়াও বেশ জটিল ছিলো। চায়ের উন্নত বীজ, চারা, প্রক্রিয়াজাত কারখানা এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ শ্রমিক সবকিছুরই অভাব ছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। তবে চা উৎপাদনের উপযুক্ত জমির অভাব ছিলো না তাদের। উত্তর-পূর্ব ভারতের ভূমি ও আবহাওয়া তাদের চা উৎপাদনের সম্ভাবনা জোরালো করছিলো। তবে এর আগে দরকার ছিলো উন্নতমানের চায়ের বীজ ও এর প্রক্রিয়াজাতের কৌশল শেখা।

 
১৯ শতকের চা বাগান

১৮৪৮ সালের শরতের সেদিন রবার্ট ফরচুন তাঁর সহচর ওয়াং এর সাহায্যে ঠিকই চা কারখানায় ছদ্মবেশে ঢুকতে পেরেছিলেন। সহচর ওয়াং এর সহযোগিতায় রবার্ট বৌদ্ধভিক্ষু ও চা-প্রেমী পরিচয়ে চা বাগানে প্রবেশ করার পর জানতে পারে চা উৎপাদনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঠিক কী ভুল করেছিলো। মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে জাতের চা উৎপাদন করতে চেষ্টা করেছিলো তা ছিলো চৈনিক জাত ক্যামেলিয়া সিনেনসিস  এর একটি উপজাত। হুবহু চৈনিক জাতের চা নয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চা উৎপাদনের দুর্বলতা ছিলো মূলত প্রক্রিয়ায় ও উন্নত বীজ আহরণে। আর সেই কাজটাই করেছেন–রবার্ট ফরচুন। 

ভিনদেশীদের জন্য নিষিদ্ধ কারখানায় প্রবেশ করে রবার্ট চা প্রস্তুতের জটিল প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারলেন। এর মধ্যে ছিল চা গাছগুলো কোন পরিবেশে সংগ্রহ করতে হয়, সেগুলো কীভাবে রান্না এবং শুকানো হয়। তাকে খুব সতর্ক থাকতে হয়েছিল যাতে কেউ তার ওপর সন্দেহ না করে। তাই কারখানায় ঘুরে বেড়ানোর সময় তিনি গোপনে সব কিছু নোট করছিলেন। তবে এই জ্ঞান শুধু অর্ধেক মিশনই সম্পূর্ণ করেছিল। কারণ তিনি চায়ের কিছু বীজ নিয়ে ভারতে ফিরতে না পারলে ব্রিটেন তখনও চায়ের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতো।

তবে সেটা রবার্ট করেন ধাপে ধাপে। উৎপাদন প্রক্রিয়া জানার পর এ পর্যায়ে তার মিশন ছিলো চা গাছের বীজ চুরি করা এবং সেগুলো চীন থেকে ভারতের উষ্ণ আবহাওয়ায় পৌঁছে দেওয়া। এটি বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় সফল হয়েছিল; কারণ অনেক সময় বীজ পরিবহনের সময় নষ্ট হয়ে যেত। তবে পরবর্তীতে রবার্ট বীজ ও চারা পরিবহনের জন্য তিনি ন্যাথানিয়েল বাগশো ওয়ার্ডের পোর্টেবল ওয়ার্ডিয়ান কেস (টেরারিয়াম) ব্যবহার করতে শুরু করেন।  

সাংহাই বন্দর

বীজ চুরি করার পাশাপাশি রবার্টকে চীনের কালোবাজারেও ঝুঁকি নিয়ে বিচরণ করতে হয়েছিল। কঠোর নিরাপত্তায় ঘেরা এক চা বাগানের বেড়া টপকে চারা ও বীজ সংগ্রহ করতে বন্দুকযুদ্ধের সম্মুখিনও হন তিনি। ধারণা করা হয় রবার্ট ফরচুন তাঁর গোপন মিশনের ফলস্বরুপ প্রায় ২০,০০০ বীজ সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। সেই সাথে চীন থেকে বহু দক্ষ চা শ্রমিকদের ভারতবর্ষেও নিয়ে আসেন তিনি। 

রবার্ট ফরচুনের এই সফল গুপ্তচরবৃত্তিই ভারতবর্ষ ও শ্রী লংকায় চা উৎপাদনের সূচনা করেছিলো। আর এর ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আন্তজার্তিক বাজারে চীনের চায়ের একচ্ছত্র আধিপত্য শেষ করে। পরবর্তীতে এই চায়ের ওপর ভর করেই ভারতবর্ষ তথা গোটা ইউরোপ ও আফ্রিকায় নিজেদের টিকিয়ে রাখে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।      


 

Comments

    Please login to post comment. Login