শিউলি ফুল
আমি শিউলি ফুল। আমি দেখতে অপরূপা সুন্দরী। আমার পাপড়িগুলো নির্মল সাদা, আর বৃন্তটা কমলা রঙের। এতো রূপ আমার, যে চাঁদ যদি আমাকে দেখতো, সে হয়তো হিংসে করতো। মানুষ কেন চাঁদকে সৌন্দর্যের প্রতীক মনে করে, বুঝি না। চাঁদে শুধুই জমকালো সাদা রং, তার উপর কালো কলঙ্ক। সূর্যের আলো ছাড়া তাকে দেখায় যায় না। চাঁদে কোনো ঘ্রাণ নেই, অথচ আমার গন্ধে ব্যকুল আকাশ-বাতাস।
থরে-থরে ফুটে আছে হাজারো শিউলি ফুল। হালকা বাতাসে ঝরে পড়ছে মুক্তোর মতো। হালকা কুয়াশায় ভেজা ফুলগুলো দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। তবে সবচেয়ে উপরের ডালে একটি ফুল একটু বেশি সুন্দর। বাতাসে দুলছে যেন নাচছে নুপুর পরে। ফোটা ফোটা কুয়াশার বিন্দু জড়ো হয়ে বড় পানির ফোটা হয়ে ঝরছে। আজই ফুটেছে। চারদিকে শোভা ছড়াচ্ছে। গন্ধে এতক্ষণে মৌমাছি চলে এসেছে। একটি মৌমাছি এসে বললো, "ভোঁ-ভোঁ-ভোঁ! আমি কি তোমার মধু পেতে পারি?" ফুলটি বিরক্তি প্রকাশ করলো। বাকি সব ফুল তাদের মধু দিয়ে মাটিতে ঝরে পড়লো, রইলো শুধু সেই ফুলটি, নামতার মালতি। সে ঝরছে না কারণ তার মধু এখনো ভরপুর।
বেলা বাড়তে থাকে, মৌমাছির দল চলে গেলো। আসলো একজন কবি। সে মালতির রূপে মুগ্ধ হয়ে কবিতা রচনা করলো। কিন্তু তাতেও মালতির প্রশংসা কম মনে হলো। মুখ ঘুরিয়ে নিল সে। কবি দুঃখ পেয়ে চলে গেলো। মালতি তার মধু দান করার উপযুক্ত পাত্র পেলো না। সূর্যের তাপ বাড়তে থাকে এবং তাপে মধু শুকিয়ে যায়। মালতি ঝরে পড়লো গাছের নিচে। এত এতো ঝরা ফুলের মধ্যে মালতি সবথেকে আকর্ষণীয়। একদল কিশোরী আসলো ফুল মালা গাঁথার জন্য। ঝুরি ভরে অনেক ফুল চলে গেল কিশোরীদের সাথে, কিন্তু মালতি গেলো না, কারণ তার মালাতে সূতো জড়িয়ে থাকা পছন্দ নয়। এরপর এলো প্রেমিক তার প্রেমিকার জন্য ফুল নিতে। যারা জায়গা পেল, চলে গেল প্রেমিকের সাথে, কিন্তু মালতি গেলো না। প্রেমিকের প্রেম নিবেদনের ফুল হতে তার নেকামো মনে হলো। প্রেমিক চলে গেল, আসলো মন্দিরের পূজারি। কিন্তু তার সাথেও মালতি গেলো না। মন্দিরে তাকে মানাবে না ভেবে। চার দেয়ালের মাঝে তার রূপ কেইবা দেখবে!
ছোট ছোট বাচ্চারা আসলো তাদের পুতুল বিয়ের বাসর সাজাতে। মালতি হাসে উড়িয়ে দিলো। বাকি সবাই চলে গেল বাচ্চাদের সাথে, পরে রইলো কেবল মালতি, তার অপরূপ শোভা নিয়ে। আর কেউ আসলো না ফুলের জন্য। শিউলি গাছটি এক তিন রাস্তার মিলনস্থলে। রাস্তায় লোক সমাগম বাড়তে লাগলো, বাড়তে লাগলো সূর্যের তাপ, শুকিয়ে গেল মালতির দুধের মতো সাদা পাপড়ি। এখন আর তার সেই রূপ নেই। রসহীন শুষ্ক পাপড়ি নিয়ে পড়ে রইলো মালতি। তার দিকে ব্যাকুল দৃষ্টিতে আর কেউ তাকাচ্ছে না। তারপর রাস্তায় বেরুলো হিংস্র কয়েকটি কুকুর। কুকুরগুলো মালতিকে পায়ের নিচে পিষ্ট করে দিয়ে চলে গেল।
বৃদ্ধ তার ছয় বছরের নাতনিকে বললো, "বুজলি টুসু? মেয়ে মানুষ ঠিক এমন, নির্দিষ্ট আশ্রয় গড়ে না তুললে পোকামাকড় এ বাসা বাঁধে, না হলে শৃগালে খায়, নয়তো কুকুর পায়ের নিচে পিষ্ট করে।"