জেরুজালেমের রাজা তৃতীয় বল্ডইনের মৃত্যুর পর রাজ্যের পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। রাজ্যে অভ্যন্তরীণ বেশকিছু সমস্যার সূত্রপাত হয়। ক্ষমতার মসনদ নিয়ে ক্রুসেডারদের মাঝে মতানৈক্য তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে ইসলামের ইতিহাসে এক মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে। তিনি ছিলেন গাজী সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী। তিনি ১১৩৭ সালে ইরাকের তিকরিত শহরের বিখ্যাত কুর্দি বংশে জন্মগ্রহণ করেন, যার আসল নাম ছিল ইউসুফ।
সালাহ উদ্দিন আইয়ুবির জন্মের পাঁচ বছর আগে ইমামুদ্দিন জঙ্গি এক যুদ্ধে পালিয়ে যাওয়ার সময় টাইগ্রিস নদীর পাড়ে আটকে যান। নদীর উল্টো পাশে তিকরিত দুর্গের রক্ষক ছিলেন সালাহুদ্দিন আইয়ুবির বাবা নাজিমুদ্দিন আইয়ুব। তখন তিনি ইমামুদ্দিনকে নদী পার করে এনে তিকরিতে আশ্রয় দেন। ইমামুদ্দিনকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে ১১৩৭ সালে আইয়ুব পরিবারকে তিকরিত থেকে বহিষ্কার করা হয়। যে রাতে তারা তিকরিত ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন সে রাতেই জন্ম হয় সালাহুদ্দিন আইয়ুবির। পরবর্তী সময়ে ইমাদুদ্দিন জঙ্গির একান্ত অনুরোধে পরিবারটি মসুলে বসতি স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
ইমামুদ্দিনের সৈন্য শিবিরেই তাদের পরিবারটির দিন কাটতে থাকে। এখানে ইমামুদ্দিনের মত একজন বিদগ্ধ সমরবিদের সান্নিধ্য লাভ ও শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন সালাহ উদ্দিন। ফলে তিনি নিজেও একজন দক্ষ সেনানি হয়ে ওঠেন। যুবক হওয়ার পর দামেস্কে সালাহ উদ্দিন আইয়ুবির বসবাস শুরু হয়। তিনি দামেস্ক শহরকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। এখানে তিনি অল্প বয়সেই ইউক্লিড জ্যামিতি, গণিত ও আইন শিখে ফেলেন। কোরআন, হাদিস ও ধর্মতত্ত্বও শেখেন। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার চেয়ে ধর্মকর্ম নিয়ে লেখাপড়া করার ইচ্ছা বেশি ছিল তার। এ ছাড়াও ইতিহাসের ওপর তার গভীর পাণ্ডিত্ব ছিল। তিনি কুর্দি ও আরবি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।
১১৪৬ সালে ইমাম উদ্দিন জঙ্গির মৃত্যুর পর তার ছেলে নুরুদ্দিন জনকি দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নুরুদ্দিনের সেনা কমান্ডার ছিলেন আসাদুদ্দীন শিরকোহ। তখন মিসরের ফাতেমি খলিফার এত ক্ষমতা ছিল না যে, তিনি মিসরে ক্রুসেডারদের হামলা একা প্রতিহত করবেন। তার মন্ত্রী শাদের সাদী ক্রুসেডারদের আসন্ন আক্রমণ ঠেকাতে নূরুদ্দীন জঙ্গিকে সাহায্য করার আহবান জানালেন। নুরুদ্দিন জনগি আসাদ উদ্দিন শিরকোহকে পাঠান ফাতেমি খলিফাকে সাহায্য করার জন্য। আসাদ উদ্দিন সেই অভিযানে সালাহ উদ্দিন আইয়ুবিকে সঙ্গে নিয়ে যান। মূলত তিনিই সালাহ উদ্দিন আইয়ুবির সামরিক ক্যারিয়ার শুরু করিয়ে দেন। সালাহ উদ্দিনের প্রথম এই সামরিক অভিযান ছিল ২৬ বছর বয়সে।
আসাদ উদ্দীন মিসরে প্রবেশ করে ক্রুসেডারদের প্রতিহত করেন। আলেকজান্দ্রিয়া দখলের পর তিনি মিসরের অধিকাংশ এলাকা করায়ত্ত্ব করেন। এই অভিযানে সালাহ উদ্দিন আইয়ুবির বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ, দক্ষতা, সৈন্য পরিচালনার পারদর্শিতা নুরুদ্দিন জনকির নজর কাড়ে। মিশরের খলিফা আসাদ উদ্দীন শিরকোহকে মন্ত্রী নিযুক্ত করেন এবং সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী আসাদ উদ্দিনের স্থলাভিষিক্ত হন। মিশরের খলিফা তাকে আল মালিকুন নাসির উপাধী দেন। তখন থেকে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী ক্রুসেডারদের হাত থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস উদ্ধার করাকে নিজ জীবণের লক্ষ স্থির করেন।
সালাউদ্দীন আইয়ূবীর জেরুজালেম উদ্ধার
ক্রুসেডারদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের মোক্ষম এই সুযোগ সালাহ উদ্দিন আইয়ুবি হাতছাড়া করতে চাইলেন না। পরিকল্পনা করে তিনি ১১৮২ সালের মধ্যে সিরিয়া, মসুল, আলেপ্পো ক্রুসেডারদের দখলমুক্ত করে নিজ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করেন। তখন ক্রুসেডারদের সাথে তার এই মর্মে শান্তি চুক্তি হয় যে, খৃষ্টানরা মুসলমানদেরকে হজ্জে যেতে বাধা দেবেনা এবং ধর্মীয় ও ব্যাবসায়ী কাফেলার কাজে বিঘ্নতা সৃষ্টি করবেনা। কিন্তু এই চুক্তি কাগজ কলমেই সীমিত থেকে যায়।
এই জেরুজালেমের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। রাজা ৪র্থ বল্ডউইন কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হন। সেকারণে ১১৮৬ সালে তিনি নিজ ভায়রা গাই অব লুসিগনান (Guy of Lusingnan)কে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেন। কিন্তু রাজ্য পরিচালনার মত যোগ্যতা লুসিগনানের ছিল না। তাই রেনল্ড(Reynold theChattilon) নামক বিশ্বস্ত একজন নাইট তার কাজে সহায়তা করতেন। এই রেনল্ড ছিলেন একজন রক্তপিপাষু। তিনি লুসিগনানের মাধ্যমে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিতেন। রেনল্ডের বিরুদ্ধে মুসলিম ব্যাবসায়ী কাফেলাকে ইতিপূর্বে হয়রানী করার অভিযোগ ছিলো।
এসময় পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুসলমানদের ঐক্য ও শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এটা ঠেকাতে রেনল্ড একটা জঘন্য পরিকল্পনা করেন। তিনি চুক্তি ভঙ্গ করে নিরস্ত্র হজ্জ কাফেলার উপর আক্রমণ করে বসেন। সেখানে খৃষ্টান বাহিনী ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও লুটপাট চালায়। ইতিহাসে আছে এই হামলায় একাধিক হজ্বযাত্রীকে ধারাল তলোয়ার দিয়ে দ্বিখন্ডিত করে ফেলা হয়। এই হামলার উদ্দেশ্য ছিলো সালাহ উদ্দীনকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা এবং পরাজিত করা। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী এই আক্রমনের কঠোর জবাব দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
হিত্তিন যুদ্ধ
অন্যতম ক্রুসেড নেতা গাই অব লুসিগনানের ভাই রিজিনাল্ড মদিনায় হামলার পরিকল্পনা করেন।এই উদ্দেশ্যে তিনি আরো কয়েকজন ক্রুসেড কমান্ডারকে সাথে নিয়ে হেজাজ অঞ্চল অভিযানে বের হন। সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী তাকে প্রতিহত করার উদ্যোগ নেন। তিনি রিজিনাল্ডকে ধাওয়া করে হিত্তিন নামক স্থানে ধরে ফেলেন। এই স্থানটি বর্তমানে অবৈধ ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের তাইবেরিয়াস অঞ্চলের নিকটবর্তী একটি শহর। ১১৮৭ সালের ৪ঠা জুলাই এই স্থানে সংঘটিত হয় ইতিহাসের ভয়াবহতম যুদ্ধ।
সালাহ উদ্দিন আইয়ুবির সৈন্য সংখ্যা ত্রিশ হাজার এবং খ্রিষ্টানদের সৈন্য সংখ্যা বিশ হাজার থাকলেও খ্রিষ্টানদের মধ্যে দুর্ধর্ষ নাইট বাহিনীর ১২শো সৈনিক ছিল। সালাহ উদ্দিন সেখানে শত্রুবাহিনীর ওপর এমন এক বিষ্ফোরক নিক্ষেপ করেন যাতে মাটিতে আগুন জ্বলে ওঠে। রাজা লুসিগনান, তার ভাই রিজিনাল্ড, রেনল্ড, হামফ্রে এবং বড় বড় নাইটদের গ্রেফতার করা হয়। ক্রুসেডার বাহিনীর অশ্বারোহী ও সাধারণ পদাতিক সৈন্য যারা জীবিত ছিল সকলেই মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়েছিলো। চুক্তি ভঙ্গ এবং নিরীহ মানুষ হত্যার অপরাধে সালাহ উদ্দিন নিজ হাতে তলোয়ার চালিয়ে দেহ থেকে রেনল্ডের মাথা বিছিন্ন করেন।
বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়
হিত্তিনেরর যুদ্ধে জয় লাভের পর সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে অগ্রসর হন। ২০ সেপ্টেম্বর রবিবার তিনি জেরুজালেম শহর অবরোধ করেন। অবরোধের ১২তম দিন ২রা অক্টোবর শহরের সব প্রতিরোধ ব্যূহ ভেঙে পড়ল। এক সপ্তাহ ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ক্রুসেডাররা অস্ত্র ফেলেদেয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে। ৯১ বছর পর বায়তুল মুকাদ্দাস আবার মুসলমানদের আয়ত্ত্বে আসে। বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয় ছিল সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।
জেরুজালেম বিজয়ের পর তিনি ক্রুসেডারদের মতো নিষ্ঠুর আচরণ করেননি। তিনি শহরের সাধারণ খৃষ্টানদের ওপর কোন প্রকার নির্যাতন হতে দিলেন না। নির্ধারিত মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের ৪০ দিনের মধ্যে জেরুজালেম ত্যাগের সুযোগ দেন সালাহ উদ্দীন আইয়ুবি। দরিদ্র খৃষ্টানদের মুক্তিপণ তিনি নিজের পক্ষ থেকে দিয়ে দিলেন। সালাহ উদ্দীন আইয়ুবী ঘোষণা করেন, যারা ক্রুসেডারদের দখলদারিত্বের পূর্বে এই শহরে বসবাস করতো তারা যেন ফিরে আসে। তিনি মসজিদুল আকসাকে পুনরায় নামাজের উপযুক্ত করে তোলেন এবং একজন ইমাম নিযুক্ত করেন। তিনি মসজিদে একটি মিম্বার স্থাপন করেন। তখন থেকে প্রায় ৭৬১ বছর পর্যন্ত বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের আয়ত্ত্বেই ছিল।