ধূমায়িত পথ
ঝিনুকপুর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটা লাল মাটির পথ। এই পথ দিয়ে দিনের আলো ফুটে উঠলে পল্লীজীবনের কোলাহল শুরু হয়। কেউ ক্ষেতমাঠে যায়, কেউ বাজারে। সন্ধ্যার পর সেই পথ আবার নীরব হয়ে যায়, শুধু মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাকে ভরে ওঠে। তবে, এই পথের আরেকটি নাম আছে—"ধূমায়িত পথ"। কারণ, শীতকালে পথটা এমনভাবে কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যে মনে হয় ধোঁয়ার মতো কিছুর ভেতর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে।
এ গ্রামেরই এক কিশোর ছিল—নাম তার আরিফ। আরিফ ছিল প্রচণ্ড কৌতূহলী আর দুঃসাহসী। সে প্রায়ই মুরুব্বিদের মুখে শোনত, ধূমায়িত পথের গভীরে এক রহস্যময় পুকুর আছে। সেই পুকুরে নাকি রাতের বেলায় একটি দীপ্তি দেখা যায়। তবে পুকুরের কাছে কেউ যেতে পারে না। কারণ, যারা সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করে, তারা আর ফিরে আসে না।
এই গল্প শোনার পর থেকেই আরিফের মনে অদ্ভুত কৌতূহল জন্মাল। কী এমন রহস্য আছে পুকুরে? গ্রামের সবাই ভয় পায় কেন?
একদিন সন্ধ্যায় আরিফ তার বন্ধু রাকিবকে বলল,
“চল, আমরা ধূমায়িত পথ ধরে সেই পুকুর দেখতে যাই। যদি কেউ কখনো ফিরে না আসে, তবে সেটা জানার দরকার। হয়তো এটা মিথ্যে।”
রাকিব ভয় পেয়ে বলল,
“তুই পাগল নাকি? এমন ঝুঁকি নেবি কেন? পুকুরে যদি সত্যিই কিছু থাকে?”
আরিফ মুচকি হেসে বলল,
“ভয় পাস কেন? যদি কিছু থাকে, আমরা একসাথে থাকব। আর যদি কিছু না থাকে, তবে গ্রামের সবাইকে সত্যিটা জানাব।”
অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাকিব রাজি হলো। তারা ঠিক করল, পূর্ণিমার রাতে বেরোবে।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, পূর্ণিমার রাতে তারা দুজন গায়ে চাদর জড়িয়ে ধূমায়িত পথ ধরে হাঁটতে শুরু করল। পথটা যেন আরও বেশি ধোঁয়াটে হয়ে উঠেছে। চাঁদের আলো ঠিকমতো প্রবেশ করতে পারছে না। কুয়াশার ভেতর দিয়ে পথ যেন অদ্ভুত আর ভৌতিক দেখাচ্ছিল।
হাঁটতে হাঁটতে তারা দেখল, পথের এক পাশে বড় বটগাছ। গাছের নিচে এক বৃদ্ধ বসে আছেন। তার পরনে লুঙ্গি আর মাথায় পাগড়ি। বৃদ্ধের চোখমুখ দেখে মনে হলো তিনি যেন তাদের অপেক্ষায় আছেন।
বৃদ্ধ হেসে বললেন,
“তোমরা কি ধূমায়িত পথের রহস্য দেখতে যাচ্ছো?”
আরিফ সাহস করে জবাব দিল,
“হ্যাঁ, চাচা। কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন?”
বৃদ্ধ বললেন,
“যারা সাহস করে এই পথে নামে, তাদের পথের দিকনির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্ব আমার। তবে সাবধান, যা দেখবে তা সবাইকে বলার দরকার নেই। পুকুরের সত্যিটা বুঝতে পারলে সেটা তোমাদের মাঝেই থাকুক।”
আরিফ কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বৃদ্ধ আর কথা না বলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
পথ আরও গভীর হলো। কুয়াশা এতটাই বেড়ে গেল যে হাতের সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। একসময় তারা শুনল পানির মৃদু ঢেউয়ের শব্দ। শব্দের দিক ধরে এগোতে এগোতে তারা এক পুকুরের ধারে পৌঁছাল। পুকুরটি ঘন অন্ধকারে ডুবে আছে। শুধু মাঝখানে হালকা নীল আলো জ্বলজ্বল করছে।
আরিফ বিস্ময়ে তাকিয়ে বলল,
“দেখলি, বলেছিলাম এখানে কিছু আছে। কিন্তু ওটা কী আলো?”
রাকিব ভয় পেয়ে বলল,
“আমার মনে হয় ফিরে যাই। এখানে কিছু একটা অস্বাভাবিক আছে। হয়তো এটা ভূতপ্রেতের কাজ!”
আরিফ শোনার মতো নয়। সে ধীরে ধীরে পুকুরের ধারে গিয়ে আলোটা দেখতে চেষ্টা করল। পুকুরের পানিতে হালকা ঢেউ উঠছে, আর আলোটা যেন তাদের ডাকছে।
হঠাৎ পুকুরের মাঝখান থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এলো,
“তোমরা কি সত্যিই এই রহস্য জানার জন্য প্রস্তুত?”
কণ্ঠটা এত গভীর আর শান্ত ছিল যে আরিফ ভীত না হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কে? তুমি কি এখানে থাকো?”
কণ্ঠটি বলল,
“আমি এই পুকুরের অভিভাবক। এই আলো আমার দেওয়া। এই পুকুর এমন এক জায়গা যেখানে সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য বোঝা যায়। কিন্তু তোমাদের প্রমাণ করতে হবে যে তোমরা সত্য জানার যোগ্য।”
কণ্ঠটি বলল,
“তোমাদের দুজনকে তিনটি প্রশ্ন করব। সঠিক উত্তর দিলে তোমরা এখানে থাকার রহস্য জানতে পারবে। না পারলে, তোমাদেরও এই পুকুরে থেকে যেতে হবে। প্রস্তুত?”
আরিফ সাহস নিয়ে বলল,
“আমরা প্রস্তুত।”
প্রথম প্রশ্ন এলো,
“পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্য কী?”
রাকিব কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আরিফ বলল,
“আমার মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্য হলো মৃত্যু। কেউ তা এড়াতে পারে না।”
পুকুর থেকে কণ্ঠ ভেসে এলো,
“সঠিক উত্তর। দ্বিতীয় প্রশ্ন: জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস কী?”
এবার রাকিব বলল,
“ভালোবাসা। কারণ ভালোবাসা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না।”
কণ্ঠটি বলল,
“সঠিক। শেষ প্রশ্ন: মানুষ কখন সঠিক পথে থাকে?”
আরিফ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“যখন সে তার হৃদয় ও বিবেককে অনুসরণ করে।”
কণ্ঠটি হাসল।
“তোমরা সঠিক উত্তর দিয়েছ। তাই তোমাদের সত্য জানার অধিকার আছে। এই পুকুরে কোনো ভূত নেই, কোনো অলৌকিক শক্তি নেই। এই পুকুর এক প্রতীক। যারা সাহস করে এখানে আসে, তারা জীবনের গভীর সত্যগুলো জানতে পারে। এই আলো তোমাদের মনকে আলোকিত করার জন্য।”
পুকুরের আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে গেল। আরিফ আর রাকিব দেখল, তারা আবার ধূমায়িত পথে দাঁড়িয়ে আছে। সেই বৃদ্ধ আবার তাদের সামনে। তিনি হেসে বললেন,
“তোমরা যা শিখেছ, সেটা মনে রেখ। সত্যকে সম্মান করো। এখন বাড়ি ফিরে যাও।”
আরিফ আর রাকিব গ্রামের দিকে হাঁটতে শুরু করল। ধূমায়িত পথ তখনও কুয়াশায় ঢাকা। কিন্তু তাদের মনে যেন আলো জ্বলে উঠেছে। তারা বুঝতে পেরেছে, জীবনের রহস্য শুধু ভয়ের মধ্যে নয়, সাহসের মধ্যে লুকিয়ে আছে।