🍁.
খাবার টেবিলে উপস্থিত আছে ভুঁইয়া বাড়ির তিন কর্তা, সিজান ভুঁইয়া, নাবিল ভুঁইয়া, নাহিদ ভুঁইয়া এবং তাদের একমাত্র বোন নাবিলা ভুঁইয়া ও তাদের ছেলে মেয়েরা সকলে। আজ শুক্রবার সবাই বাড়িতে উপস্থিত। প্রতি শুক্রবারেই ভূঁইয়া বাড়িতে বড় সড় আয়োজন করা হয়। এইদিনে সবাই উপস্থিত থাকে। মিজান ভুঁইয়ারা তিন ভাই এক বোন। বোন ও এইদিনে এই বাড়িতে আসে স্বামী সন্তান নিয়ে৷ শুধু শুক্রবারেই না হুটহাট রাতের তিনটা বা চারটা বাজেও উনাকে পরিবার নিয়ে ভূঁইয়া বাড়িতে হাজির হতে হয়। ঐ যে ভাই, ভাতিজারা পার্টির আয়োজন করে যে।
...
খাওয়া দাওয়া শেষে ঊষা নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ওভেনের উপরে বড় আব্বুর চার্জে দেওয়া ফোন টা বেজে উঠে।
সিজান ভুঁইয়া ও ঊষাকে বললেন,
ঊষা আমার ফোনটা দিয়ে যা তো মা।
ঊষা ও ডান দিকে গেলো, ফোনটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই চোখ গেল স্ক্রিনে ভেসে উঠা নামটার দিকে। কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো সেদিকে। মনে কেমন চিনচিন ব্যাথা অনুভব করলো ঊষা।
কিরে ফোনটা নিয়ে আয়।(সিজান ভুঁইয়ার ডাকে ধ্যান ভাঙলো ঊষার)
ততক্ষণে ফোনটাও কেটে গেছে। হাতে ফোন নিতে নিতে আবারো কল আসলো।
তাড়াতাড়ি ফোন টা এনে বড় আব্বুর হাতে দিলো ঊষা। ফোন দিয়েই চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে রইলো ঊষা।
পাশে থেকে ঊষার বাবা নাহিদ ভুঁইয়া জিজ্ঞাসা করলেন," কিরে মা কে ফোন দিলো?"
সাগর ভাই....
কথাটা বলেই মাথাটা নিচু করে নিলো ঊষা। এই নামটা নিতে গেলেও তার অন্তর আর শরীর জুড়ে অন্যরকম এক যন্ত্রণা অনুভব হয়। শরীর টা কেমন অষার হয়ে আসে।
সিজান ভুঁইয়া বললেন, তা রিসিভ করলেই পারতে৷
ঊষা মাথাটা নিচু করেই আছে। বড় আব্বুর কথার প্রতিত্তোর করলো না।
ফোনটা রিসিভ করেই লাউড স্পিকারে দিলেন সিজান ভুঁইয়া।
আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছো আব্বু? বাড়ির সবাই ভালো আছে?
আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আমরা । তুমি কেমন আছো? শরীর কেমন আছে তোমার? তোমার খালা খালু কেমন আছেন?
আলহামদুলিল্লাহ সকলেই ভালো আছি।
আব্বু...
হ্যাঁ, কিছু বলবে তুমি সাগর?
হ্যাঁ বাবা বলবো৷ তুমরা সবাই কি এখন একসাথে? মানে এখন তো খাওয়ার সময়।
হ্যাঁ বাবা সবাই আছে। সবাই খাবার খাচ্ছি। শুধু ঊষার খাওয়া শেষ।
.
উষার কথা বলায় সাগর খুব বিরক্ত বোধ করলো। সে কি তার কথা জানতে চেয়েছে? যত্তসব ফালতু....
আব্বু একটু স্পিকার টা অন করে দেও সবাই যেন শুনতে পায়৷ আমি কিছু বলতে চাই।
তুমি বলো ফোন স্পিকারেই আছে।
আব্বু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখানেই স্যাটেল হবো।
কথাটা শুনা মাত্র সকলের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেলো। বিশেষ করে নাহিদ ভুঁইয়া আর ঊষার। ঊষার মনে হচ্ছে কেউ খঞ্জর দিয়ে অবিরত তার বুকে আঘাত করছে।
আমাদের ব্যাবসা টা কে দেখবে সাগর? তুমি পরিবারের বড় ছেলে তোমার ই তো দায়িত্ব বেশি তুমি দেশে না আসলে কিভাবে কি হবে?
দেশে আসবো আব্বু। এক বছরের সময় নিয়ে আসবো। ঊষাকে মুক্তি দিতে হবে তো! অর আঠারো বছর পূর্ণ হলেই আসব। আমি এখানেই নতুন করে নতুন কারো সাথে নিজের জীবন শুরু করতে চাই। আর ঊষার নিজের লাইফ টাকেও তো গুছাতে হবে। একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর আশায় বসে থেকে তো লাভ নেই? আমি চাই সে ভালো থাকুক। হাজার হোক সব কিছুর উর্ধ্বে সে আমার ছোট বোন।
কথাটা শুনা মাত্র এখানে উপস্থিত প্রত্যেকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো৷ নাহিদ ভুঁইয়ার অন্তর টা ধক করে উঠলো। কলিজাটা কেঁপে উঠলো৷ নিজের চোখে নিজের মেয়ের এই করুণ পরিণতি সে দেখতে চায়না৷ মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ঊষার পানে।
ঊষার মনে হচ্ছে তার পায়ের নিচে মাটি সরে গেছে। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো পরে যাওয়ার আগেই একজন হাত বাড়িয়ে কোমড় জড়িয়ে ধরলো। ঊষা ডানে তাকিয়ে দেখলো আলিফ ভাইয়া ধরে আছে ওকে।
কোনো কথা না বলেই মাথা এলিয়ে দিলো আলিফের বুকে। আলিফ ও হাত বাড়িয়ে বোন কে ধরলো।
সিজান ভুঁইয়া একবার তাকালেন ঊষার দিকে। ভিতরে অপরাধবোধ কাজ করছে ফুলের মতো সুন্দর আর পবিত্র মেয়েটা এখন বিনা অপরাধে কেমন শাস্তি ভোগ করছে।
লিপি বেগম তেতে উঠলেন ছেলের কথায়। রেগেমেগে বললেন, সাগর অনেক শুনেছি তোর কথা। গত পাঁচ বছর ধরে তুই যা বলেছিস তাই শুনেছি আমরা৷ অনেক শুনেছি তোর কথা। বাড়াবাড়ি করবিনা এর ফল ভালো হবেনা।
বাড়াবাড়ির কি আছে আম্মু? তখন তো আমার অনুমতি নিয়ে কিছু করোনি! আমিও তোমাদেরর অনুমতি নিবো না এখন।
পাশে থেকে সাগরের চাচী মারিয়া রহমান বললেন, "দেখো সাগর কেন এমন করছো? যা হবার তা তো হয়েই গেছে বলো? আমাদের মেয়ের কি কোনো কমতি আছে? বদনাম হলে তো এ বাড়ির ই হবে৷ এই বাড়ির মেয়ের ই হবে। আর ওকে ডিভোর্স দেওয়ার একটা যুক্তিযুক্ত কারণ তো বলো"!
ডিভোর্স শব্দ এটা কর্ণকুহর হতেই বাবা মেয়ে দুজন দুজনার দিকে তাকায়। বাবার দৃষ্টিতে ছিল অপরাধবোধ। আর মেয়ের দৃষ্টিতে ছিল অসহায়ত্ব!
সাগরের চাচা নাবিল ভুঁইয়া বলেন, "দেখো সাগর এতো ফার্স্ট চিন্তা না করে দেশে আসো তারপরে দেখা যাবে"।
সাগর কোনো প্রতিত্তোর করলোনা সময় দিচ্ছে যার যা বলার বলুক.....
নাবিলা ভুঁইয়া জিজ্ঞাসা করলেন, "বাবা সাগর তুই কি চাচ্ছিস ক্লিয়ার করে বলতো"!
আমি সংসার করবো না ওর সাথ....
আর বলতে পারলো না তার আগেই সিজান ভুঁইয়া টেবিলে পরে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে কল কেঁটে দিলো।
আলিফ ঊষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
~দেখ বোন আমার এসব নিয়ে ভাবিস না। ও কেমন সেটা তো আমরা সবাই জানি। একবার দেশে আসুক তোকে একবার দেখলেই দেখবি মনে কেমন লাড্ডু ফোঁটে!
আলিফের কথা শুনে সবার অন্ধকার মুখে হাসি ফোঁটে উঠে। মনে মনে সবাই আওড়ায় তাই যেন হয়।
~বাবা আমি সত্যি কথা বলছি ভাইয়া যদি বোনুর সাথে এমন কিছু করে বিশ্বাস করো আমি ওকে উচিত শিক্ষা তো দিবোই। সাথে আমি সহ আমার বোনকে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো৷ আমার বোনের জন্য ছেলের অভাব হবেনা। আমার বোন যদি দশ বাচ্চার মা ও হয়ে যায় তবুও তার জন্য ছেলের অভাব হবেনা। (রাফিদ সিজান ভুঁইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো কথাটা)
রাফিদ কথাটা ভুল বলেনি সত্যিই ঊষা অনেক বেশি সুন্দরী! তার মায়ের থেকেও দুই গুণ সুন্দর সে৷ ঊষার মা অনেক বেশি সুন্দরী ছিলেন। ঊষাকে যে একবার দেখবে সে তাকে দেখার জন্য দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাতে বাধ্য!
...
সিজান ভুঁইয়ার ছোট ভাই নাহিদ ভুঁইয়ার একমাত্র মেয়ে আরিহা ভূঁইয়া ঊষা। আর কোনো ছেলে মেয়ে নেই তার। সামিন ভূঁইয়া, রিফতিহাদ ভূঁইয়া সাগর এবং রাফাত ভূঁইয়া রাফিদ এই তিনজন হলো মিজান ভুঁইয়ার ছেলে-মেয়ে। নাবিল ভূঁইয়ার দুই ছেলে আরাফ ভূঁইয়া আর সাদাফ ভূঁইয়া। নাবিলা ভুঁইয়ার দুই ছেলে এক মেয়ে, ওয়ালিদ খান আলিফ আর ওয়াহিদ খান নেহাল এবং আরিশা বিনতে রুহি।
_____
ঊষা কারো সাথে কথা না বলেই নিজের রুমে চলে আসে। রুমে আসার একটু পরেই ঊষার ফোন টা বেজে উঠলো। বেড থেকে উঠে টেবিলের উপর বইয়ের ভিতরে রাখা ফোনটা হাতে নেয়।
সামিনাপু কল করেছে। অমাবস্যার মতো অন্ধকার মুখটায় হাসি ফোঁটে উঠে। এখনই সকল বিষাদ দূর হয়ে যাবে। সামিনের মন ভুলানো কথায় মন খারাপ জানালা দিয়ে পালাবে।
ঊষা ফোন টা রিসিভ করলো,
আসসালামু আলাইকুম আপু কেমন আছো? আমার বাবাটা কেমন আছে?
আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আমরা। তা আমার ভাইয়ের একমাত্র মিষ্টি ঊষাবউ টা কেমন আছে? কি করছে এখন? খেয়েছিস?
-"হাহ! আপুউউ, ভাইয়ের একমাত্র মিষ্টি ঊষাবউ ডাকটা এবার বাদ দিয়ে আগের মতো ঊষিবুষি ডাকা শুরু করো তো"।
সামিন ভ্রুজোড়া কুঁচকে ফেলে মুহিবের হাতে থাকা ফোনটার দিকে তাকায়। মুহিব ও ঊষার কথা শুনে ছেলের মুখ থেকে চোখ সরিয়ে তাকায় প্রথমে বামে বসে থাকা বউয়ের দিকে। সামিন আর মুহিবের চোখাচোখি হয়। তার ভাই বিয়েটা না মানলেও ঊষা কখনো এমন কথা বলেনা। আজই প্রথম তাই দুজনেই অবাক।
-"সামিন চিন্তিত ভঙ্গিতে সুধায়, কেন রে কি হয়েছে? হঠাৎ এমন কথা বলছিস কেন"?
-বলবো না? তোমার ভাই তো ডিভোর্স দিবে আমাকে! একটু আগেই জানালো দেশে আসবে এক বছরের জন্য। আমাকে মুক্তি দিবে।(কথাটা বলতে বলতে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে ঊষার চোখ থেকে। গলা টাও ধরে যায়, কাঁপা কাঁপা গলায় কোনোমতে বলে কথাটা)
-মুহিব ক্ষীপ্ত চোখে তাকায় সামিনের পানে। সামিনের উত্তরের আশায় আছে সে।
সামিন রাগী এবং তেজী কণ্ঠে বলে, "ঊষা একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে রাখ এই পৃথিবীতে তুই ই আমার ভাইয়ের বউ। আল্লাহ না চাইলে এই বিয়ে কখনোই ভাঙ্গবে না, ভাঙ্গতে দিবো না আমরা! তুই নাকে তেল দিয়ে ঘুমা বদমাইশের কথা কানে নিবিনা৷ আর কোনো ছাগলের জন্য চোখের পানিও ফেলবি না, এই আমি বলে দিলাম তোকে।
-ঊষা তোমার জন্য সাগরের থেকেও কিউট একটা জামাই নিয়ে আসবো। এতো ভেবোনা তুমি। এসব কলার বেহারীর জন্য কান্নাকাটি করোনা তো। তুমি তো আমাদের প্রিন্সেস তুমি এসব কলার বেহারী ডিজার্ভ করোনা। তোমার জন্য একটা প্রিন্স নিয়ে আসব আমরা।(মুহিব)
ঊষা খুব ভালো করেই জানে ভাইয়া তাকে হাসানোর জন্য এসব বলছে।
-হ্যাঁ হ্যাঁ ভাইয়া আমিও তাই বলি। তুমি আছোনা তোমার মতো হ্যান্ডসাম হাঙ্ক থাকতে এসব কলার বেহারী বা অন্য কোনো ছেলের জন্য বসে থাকবো কেন? বলো?
-হাহাহা, শালিকা রেডি থেকো আমি বর সেজে এসে নিয়ে যাবো।
-তোমার মতো বিয়াইত্তা আর এক বাচ্চার বাপের কাছে কি আমার বোন বিয়ে দিবো?
-ঝগড়া বাদ দেও দুজনে। দেশে কবে ফিরবে? কতদিন হলো বাচ্চাটাকে দেখিনা৷ আর হ্যাঁ আমার জন্য কিন্তু তেল, ক্রিম, শ্যাম্পু এসব আনতে ভুলো না বলে দিলাম।
-অলরেডি কিনে ফেলেছি৷ তোকে হোয়াটসঅ্যাপ এ ছবি পাঠিয়েছি দেখিস তো সব ঠিক আছে কিনা?
চলবে....
#আমার_প্রণয়িনী (কাজিন রিলেটেড)
নুসাইবা নূর
#সূচনা_পর্ব