"কেমন মেয়েরে তুই? তোর বিয়ে ভেঙে গিয়েছে এতেও তোর কোন হেলদোল নেই। আজ তোর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল জায়িনের সাথে, সেই জায়িন তোর ছোট বোনকে নিয়ে পালিয়েছে। হায় আল্লাহ এ কেমন মেয়ে পেটে ধরেছি আমি, যার মন বলতে কিছু নেই। "
রাজশাহী শহরের বুকে রাজকীয় ডুপ্লেক্স বাড়িটি কাঁপিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন শাহিদা বানু।তার আহাজারিতে থমকে গিয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিবৃন্দ। এ এক মায়ের আহাজারি তার মেয়ের জন্য। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা যে তার মেয়েকে কলঙ্কিত করছে। বিয়ে ভেঙে যাওয়া কোন মেয়েকে এই সমাজে এখনও ভালো নজরে দেখে না। তার মেয়ের জীবনটা যে নষ্ট হয়ে গেল, এখন এই সমাজ তার মেয়ের চরিত্রে কালি লাগাবে। এজন্যই তো মায়ের মন ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। কিন্তু যার জন্য কাঁদছে সে মেয়েই যেন বুঝতে পারছে না তার সাথে কি ঘটবে ভবিষ্যতে।
মায়ের কথাগুলোকে পাত্তা না দিয়ে নায়রা ভারি কারুকাজ করা লাল রঙের লেহেঙ্গা টা মতো চলার সুবিধা মতো উঁচু করে নিয়ে রিমিঝিমি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে ক্যাটারিং এর লোকদের কাছে। এ যেন তার জীবনে সবচেয়ে বড় সুখের দিন। ক্যাটারিং লোকদের বলে নিজের পছন্দমত খাবার নিয়ে রওনা হলো দোতলায় কামরার উদ্দেশ্যে। হ্যাঁ, নায়রা ছুটল পরিবারের সকলকে অবজ্ঞা করে তার গন্তব্যে, উপস্থিত সকলে শুধু চেয়ে দেখলো তার কান্ড কারখানা কিন্তু একটা টু শব্দও করার সাহস পেল না। নায়রা একেবারে শান্ত হয়ে রয়েছে এটা ঝড় আসার পূর্বাভাস।
শাহিদা বানু তখনো কাঁদছিল, মেয়ের এমন কৃতকর্ম স্বচক্ষে দেখে কান্না থামিয়ে দিল সে। ফ্লোর থেকে উঠে রাগ মিশ্রিত কন্ঠে তার ছোট বোনকে বলল_
"দেখেছিস সোহেলী এই মেয়ের কোন হুসবোধ আছে? এখন সে খাবার নিয়ে ছুটল গান্ডে পিন্ডে গেলার জন্য। এখন কি ওর গেলার সময়? "
শেষের কথাটি বলে আবার ফুপিয়ে কাঁদা আরম্ভ করল শাহিদা বানু। সোহেলী বড় আপাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য বলল _
"কি করবে এ ছাড়া আর?না খেয়েদুয়ে পড়ে থাকবে। এতে কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বল? আর তুই যে এভাবে কাঁদছিস তাতেও কি কোন সমাধান হবে? "
কিনযা নামের উনবিংশ বছরে পদার্পণরত মেয়েটা এপর্যায় এগিয়ে আসলো তার খালামনিদের কাছে, বড় খালার উদ্দেশ্যে বলল _
"খালামণি যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে বাইরের লোকজন কিন্তু আমাদের নিয়ে সমালোচনা করছে। তুমি এবার একটু শান্ত হও। "
শাহিদা বানু তবুও শোনেন না তার কারোর কথা নেত্রযুগল অশ্রুতে সিক্ত হয়ে রয়।শাহিদা বানু তবুও কাঁদছে কিন্তু বাকি তিনটে মানুষ নায়রার বাবা জাহিদুল ইসলাম সেই কখন ঘরে গিয়েছে আর নিচেআসেননি জায়িনের বাবা-মা তো লিভিং রুমে নিষ্প্রাণ হয়ে বসে রয়েছে এখন অব্দি তাদের কণ্ঠস্বর লোকজনের কানে পৌঁছায়নি। লিভিং রুমে এত মানুষের ভিড় ঠেলে প্রবেশ করলো লম্বা, সুঠামদেহী এক পুরুষ।কন্ঠে যথেষ্ট গম্ভীর্য এনে পুরুষ অবয়বটি বললো_
"বাড়িতে ভিড় কেন? এত হট্টগোল,কান্নাকাটি কিসের?"
লিভিং রুমে উপস্থিত সবাই কণ্ঠস্বরটির উৎপত্তি স্থলে উৎসুক হয়ে তাকায়।
___________
দরজার নব ঘুরিয়ে ধীর পদযুগলে কক্ষে করল নায়রা, এগিয়ে গেল বিছানার সজ্জারত বৃদ্ধার নিকট।বেডসাইট টেবিলে খাবার থালাটি রেখে একটি কাঠের চেয়ার নিয়ে বসলো বিছানার পাশে, কাউকে উদ্দেশ্য করে কণ্ঠটি আওয়াজ তুলল _
"কে যেন বলেছিল খাবারের উপর রাগ করতে নেই? কে বলেছিল? "
খুবই ভাবুক ভাবে কারো কাছে জানতে চাইলো নায়রা।
বৃদ্ধা মহিলাটি পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো রোশনাইয়ের মত ঝলমল করতে থাকা মুখ পানে। বধূ সে যে একেবারে সাক্ষাৎ রাজরানী লাগছে তার নাতনিকে। এত সুন্দর মেয়েকে বিয়ের আসরে রেখে কিনা অন্য একটি মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যায় তারই আরেক নাতনি! এই নিয়েই আত্মগ্লানিতে ভুগছে জুলেখা বেগম।
জুলেখা বেগম তার মৃত স্বামীর ইচ্ছা পূরণ জন্য করার জায়িন ফরহাদ শুভ্র আর ইয়ানাত আফরিন নায়রার বিয়ে দিয়ে চান বলা যায় কিছুটা তাদের মতের বিরুদ্ধে। ইখতিয়ার ইসলাম খুব শখ করে তার মেঝো নাতির সাথে নাতনির বিয়ে ঠিক করছিলেন। স্ত্রী ও দুই ছেলেকে বলেছিলেন সে বেঁচে না থাকলেও যেন তাদের দুজনের বিয়ে দেয়। সে তারনাতেই জুলেখা বেগম এ কাজ করে বসেছেন। সে কি জানত যে জায়িন এমন নির্বোধের মত কাজ করবে? জয়িনতো রাজী হয়েছিল, প্রথমে না করেছিল কাজিন বলে কিন্তু পরে তো রাজি হয়েছিল, নায়রাকেও অনেকবার বোঝানোর পর রাজী করেছিলেন । তাহলে জায়িন কেন এমন করলো?তার যদি বিয়ে না করারই থাকতো তাহলে রাজি কেন হল? কেন বলেনি সে উপমা কে পছন্দ করে?শুরুতে বলতে পারতো সে উপমাকে পছন্দ করে তাহলে তো এত জটিলতায় সৃষ্টি হত না আর না পরিবারের সবাইকে আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে অপদস্ত হতে হতো। জুলেখা বেগম নিজে তাহলে তাদের বিয়ে ব্যবস্থা করত তাদের অভিভাবকদের বুঝিয়ে। ভাবনা ছেড়ে উঠে বসলেন জুলেখা বেগম। এমন বিপর্যস্ত ঘটনার পর তার প্রেসার ফল করেছিল। ঘন্টাখানেক আগে ডাক্তারটা চেকআপ করে গিয়েছেন।
আপনমনে খাবার থালাটা তার দিদার সামনে নিয়ে ধরল।
"এই যে বুড়ি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। সে কখন থেকে না খেয়ে আছো খানিকক্ষণ বাদেই মাগরিবের আজান দেবে। "
"তুই খেয়েছিস? "
নায়রা খাবার মাখাতে মাখাতে বলল _
"খেতে আর দিল কই তোমার বড় ছেলের বউ।যা শুরু করেছে! "
কথাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণতার সাথে বলল নায়রা।
নায়রার মুখ হাসিখুশি যেন সে নিতান্তই আনন্দে রয়েছে। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার বিন্দুমাত্র দুঃখ বেদনা তার মধ্যে নেই,যা আর পাঁচটা মেয়ে অনুভব করত। জুলেখা সেটা পরখ করলেন অবশ্য সে ভালোভাবে জানে তার নাতনি সাধারণ মেয়েদের মত নয় তবুও বিয়ে ভাঙা যে কোন মেয়ের জন্য লাঞ্চনার এক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা গিয়েছে নায়রার আচরণে। জুলেখা বেগম নায়রা কে বললেন _
"সব দোষ আমার। আমার জন্যে সবাই তো এত কথা বলছে। "
"দোষ তোমার না এমনকি বর্তমান বাড়িতে উপস্থিত কারোরই নয়।দোষ যাদের তাদের তো আমি দেখে নেব। "
এরপর আবার বলল, "এখন নাও তো খেয়ে নাও। "
জুলেখা বেগমের কথা বাড়ালেন না, নাতনির হাতে চুপচাপ খেতে থাকেন। তার শরীরটা ভালো লাগছে না।
___________
"কি হলো, এখানে এসব কি হচ্ছে? অ্যানসার মি। "
সবাই অনিমেষ তাকিয়ে রইল জায়ানের দিকে। জাফর ইসলাম ছোট ছেলেকে দেখে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন কিন্তু তার স্ত্রী ভাবলেহীন হয়ে বসেই থাকে। সব ঘটনা বলার জন্য এগিয়ে যাই এর আগেই শাহিদা বানু জায়ানের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
"তোমার ভাই উপমাকে নিয়ে পালিয়েছে। "
"হোয়াট। "
জায়ান হতভম্ব।
"হ্যাঁ ভাবি ঠিক বলছে শুদ্ধ।শুভ্র উপমাকে নিয়ে পালিয়েছে।"
জাফর ইসলাম কন্ঠস্বরকে খাদে নামিয়ে বলে কথাটি।
জায়ান একে একে বাড়ির প্রত্যেককে অবলকন করতে থাকে। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, এমন একটা কাজ তার ভাইয়া করতে পারে।
বাড়িতে উপস্থিত মেহমানদের একাংশ জায়িন,উপমাকে নিয়ে সমালোচনা করছেতাদের এই সমালোচনায় বাদ যাচ্ছে না নায়রা ও। এক মহিলা ফিসফিসিয়ে অন্যদের বলল_
"একেই বলে মেয়ে মানুষ। বোন হয়ে কিনা আরেক বোনের হবু বর নিয়ে পালায়,। ছিঃ ছিঃ ছিহ।
আরেক মহিলা বলল _
"সবই হিংসারে, হিংসা। ওই ছেড়ি নাকি বউয়ের ফুপাতো বোন। শুনছিলাম ছেড়ির মা আর ছেড়িডাএই বাড়িতেই থাকে। জাফর সাহেবের বড় পোলাডা যার লগে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল এক্কেরে রাজপুতের লাহান পোলাখানা। এই লাইগা হিংসায় এই কামডা করছে ছেড়ি। "
মহিলাদের কথা প্রেক্ষিতে তৃতীয় আরেক মহিলা বলল _
"দোষ খালি ছেড়ির নাকি? পোলাডারও দোষ আছে। ওগো দুইটার মনে হয় আগে থেকে পেন্নাই ছিল কিন্তু কথা ওই ডানা, কথা হলো বিয়া করবে না তাইলে বিয়াতে রাজি হইছিল ক্যান? মাইয়াডার লাইগা দরদ লাগতাছে আমার, বিয়াডা ভাইঙা গেল। মাইয়াডার এখন কি হইব?"
প্রথম মহিলাটি আবার বলল_
"কি আর হবে? মেয়েটাকে তো খানিকক্ষণ আগে দেখলে তোমরা, বিয়ে ভাঙ্গার কোন প্রভাব তার উপর পড়েছে। ঠিকই থালা করে খাবার সাজিয়ে নিয়ে চলে গেল খেতে। কোন দুঃখ কষ্টের ছাপ নেই মেয়েটার মুখে। "
কিনযা তন্মধ্যে সেখানে উপস্থিত হয়। মহিলাগুলোর দিকে বিরক্ত সূচক তাকিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলল_
"আপনার এখন আসুন, প্লিজ। দেখছেন তো আমাদের পারিবারিক কিছু কলহ তৈরি হয়েছে। "
জনৈক কিনযাকে উপহাস করে বলে _
"তুমিও তো ওর কোন সম্পর্কের বোন হোও তাই না? তুমি আর উপমা তো প্রায় সমবয়সী। উপমাকে দেখতাম নায়রার জন্য দুধ উতলানোর মত দরদ উতলায় পড়তো, তোমারও তো দেখছি দরদ উঠলে পড়ছে বোনের জন্য।উপমার মতলব তো ঠাওরে আসছে তা তোমার মতলব কী মেয়ে?"
"আপনারা কিন্তু নিজেদের সীমা অতিক্রম... "
"এই মেয়ে তুমি ওদিকে যাও উনাদের ব্যবস্থা নিচ্ছি। "
জায়ানের ধমক খেয়ে কিনযার প্রস্থান হয় । জায়ান মহিলা গুলোর সামনে দাঁড়ায়।তার দৃষ্টি শান্ত, স্বাভাবিক। জায়ান কে দেখে মহিলাগুলো ভ্রু কুচকায়। দরাজ কন্ঠে জায়ান বলে ওঠে_
"বিনা টিকিটে তো এতক্ষন যাত্রাপালা দেখলেন এই অনেক। এখন বিদায় হন। পরে না হয় আবার যাত্রাপালা দেখতে আসবেন টিকিট সমেত। "
"তুমি না বরের ছোট ভাই। "
"আই সে গেট আউট। "
মহিলাটিকে থামিয়ে দিয়ে জায়ান আবারও দরাজ কন্ঠে বলে ওঠে।
জায়ানের কথায় মহিলা গুলো অপমানিত বোধ করেছে, তাই তারা কোন কথা না বলে ❝জুলেখা মেনশন❞বাড়িটি ত্যাগ করলো।
সদর দোয়ার থেকে সামনে হেঁটে বাবার সামনে দাঁড়ায় জায়ান।
"চাচা কোথায়? "
জাফর ইসলাম সোজাসাপটা জবাব দেন ছেলের প্রশ্নের_
" তার কক্ষে। "
জায়ান বাবার দিকে কয়েকপল তাকিয়ে থেকে উপরে চলে যায়।
চলবে...
#পরিনয়ে_পরিত্রাণ