Posts

গল্প

কষ্টের রঙে রঙিন নীলা

January 7, 2025

Naznin sultana Dina

25
View

নীলা ছোটবেলা থেকেই ছিল স্বপ্নবিলাসী মেয়ে। তার চোখে ছিল অসংখ্য স্বপ্নের রঙিন ছবি। কিন্তু জীবনের কঠিন বাস্তবতা তাকে বারবার সেই স্বপ্ন থেকে ছিটকে দিয়েছে। তার জীবনের প্রতিটি কষ্ট যেন তাকে নতুন করে চিনিয়ে দিয়েছে জীবনের আসল অর্থ।


নীলা তখন মাত্র আট বছর। এক শীতের সকালে তার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন। বাবার মৃত্যু তার জীবনে প্রথম বড় আঘাত ছিল। বাবার সঙ্গে তার কাটানো ছোট ছোট মুহূর্তগুলো সব সময় তার মনে ঘুরে বেড়াত। বাবার কোলে বসে গল্প শোনা, বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া—এসব মুহূর্তই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়। কিন্তু হঠাৎ সবকিছু শেষ হয়ে গেল। বাবার অভাব নীলার মনে এক গভীর শূন্যতা তৈরি করল, যা কোনো কিছু দিয়েই পূরণ করা সম্ভব ছিল না।


বাবার মৃত্যুর পর থেকেই সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে মায়ের ওপর। মা নিজের ছোট একটা চাকরি করতেন, কিন্তু সেই সামান্য আয়ে সংসার চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে। নীলাকে অনেক কিছু ছেড়ে দিতে হয়েছিল। নতুন জামা-কাপড় বা প্রিয় খাবার কিনতে পারত না। পড়াশোনার খরচ মেটানোও কঠিন হয়ে উঠেছিল। নীলা তখন থেকেই বুঝতে শুরু করে, জীবন সহজ নয়। কষ্ট করেই সব কিছু অর্জন করতে হয়।


স্কুলে নীলার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল রুবি। তারা একসঙ্গে স্কুলে যেত, একসঙ্গে খেলত। কিন্তু একদিন একটি ছোট ভুল বোঝাবুঝি থেকে তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। রুবি তার গোপন একটি কথা সবার সামনে বলে দেয়, যা নীলার জন্য খুব লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সেই দিন থেকেই তাদের বন্ধুত্বে চির ধরা পড়ে। এই ঘটনাটি নীলার মনে গভীর দাগ কেটে যায়। সে বুঝতে শেখে, মানুষকে বিশ্বাস করা সব সময় সহজ নয়।


বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নীলার হৃদয়ে প্রথম প্রেমের অনুভূতি জন্ম নেয়। আরিফ নামের এক সহপাঠীর প্রতি তার মনের অনুভূতি ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে ওঠে। কিন্তু আরিফ সেই ভালোবাসার প্রতিদান দেয়নি। বরং নীলাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। নীলা প্রথমবার প্রেমে ব্যর্থতার স্বাদ পায়। সে বুঝতে পারে, জীবনে সব কিছুই প্রত্যাশা অনুযায়ী হয় না।


পড়াশোনা শেষে নীলা একটি ভালো চাকরি পায়। কিন্তু কর্মজীবনের শুরুতেই নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় তাকে। সহকর্মীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, কাজের চাপ, এবং অফিসের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি তার জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে। প্রথম প্রথম সে নিজেকে সব সময় সন্দেহ করত। কিন্তু ধীরে ধীরে সে নিজের দক্ষতায় বিশ্বাস রাখতে শিখল।


চাকরির ব্যস্ততার কারণে নীলা তার মায়ের সঙ্গে কম সময় কাটাতে পারত। মা তার এই দূরত্ব নিয়ে অভিমান করতেন। নীলা বুঝত, তার মাকে বেশি সময় দিতে পারছে না, কিন্তু কাজের চাপে সে অসহায় ছিল। মায়ের অভিমান নীলাকে আরও কষ্ট দিত।

রঙিন শহরের সাদা মানুষ

নীলা অনেক দিন ধরেই ঢাকার ব্যস্ত জীবনে অভ্যস্ত। প্রতিদিন সকালে অফিসের পথে চলার সময় সে দেখে, রাস্তার ধারে কত রঙের মানুষ ঘুরে বেড়ায়। কারও মুখে ক্লান্তি, কারও চোখে স্বপ্নের আলো। কিন্তু এই কোলাহলের মাঝেও এক ব্যক্তিকে দেখে নীলা সব সময় অবাক হয়।

লোকটির গায়ের রং সাদা, ঠিক যেন ধবধবে সাদা চাদরের মতো। সবার চোখ এড়িয়ে সে চুপচাপ নিজের কাজ করে যায়। তার হাতে সব সময় একটি রঙিন বাক্স থাকে, যেন সেই বাক্সে সমস্ত শহরের রঙ ধারণ করে রেখেছে। কিন্তু তার নিজের মুখে এক ধরনের স্থিরতা, কোনো আবেগের ছাপ নেই।

নীলা একদিন সাহস করে লোকটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, "আপনার এই রঙিন বাক্সে কী আছে?"

লোকটি মৃদু হেসে বলল, "এখানে সব রঙের স্বপ্ন আছে। এই শহরের মানুষের স্বপ্নগুলো আমি প্রতিদিন সংগ্রহ করি।"

নীলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, "স্বপ্ন সংগ্রহ করেন? কীভাবে?"

লোকটি বলল, "আমি এই শহরের রঙিন জীবনের মধ্যে হাঁটি, তাদের কষ্ট, সুখ, আশা, হতাশা — সবকিছু অনুভব করি। কিন্তু আমি সাদা কারণ আমি এসব থেকে নিজেকে দূরে রাখি। আমি শুধু তাদের স্বপ্নগুলো দেখি এবং মনে ধারণ করি।"

নীলা এবার আরেকটি প্রশ্ন করল, "কিন্তু আপনি কেন সাদা? আপনার রঙ কোথায়?"

লোকটি একটু থেমে বলল, "আমি নিজেকে রঙ থেকে মুক্ত রেখেছি। আমি চাই মানুষ নিজেকে চিনুক, নিজের রঙ খুঁজে পাক। আমি সাদা, কারণ আমার কাজ শুধু অন্যদের রঙ দেখানো।"

নীলা তখন বুঝতে পারল, এই সাদা মানুষ আসলে এই শহরের রঙিন জীবনের প্রতিচ্ছবি। সে নীলাকে নিজের চিন্তার জগতে ডুবিয়ে দিল। নীলা ভাবতে লাগল, আমরাও কি জীবনের কোলাহলে নিজেদের রঙ হারিয়ে ফেলি না? আমরা কি সব সময় নিজের স্বপ্নগুলোকে সত্যি করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করি?

একদিন সকালে, নীলা লোকটিকে আবার দেখতে পেল। সে এবার রঙিন এক টুকরো কাগজের দিকে তাকিয়ে ছিল। কাগজটিতে লেখা ছিল: *"রঙিন শহরে সব সময় সাদা থাকলে রঙের মর্ম বোঝা যায় না। নিজেকে রঙিন করো, তবে অন্যদের রঙ চিনতে শেখো।"*

নীলা বুঝতে পারল, সেই সাদা মানুষ তার কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রেখে গেছে। সে সিদ্ধান্ত নিল, জীবনের প্রতিদিনকে রঙিন করে তুলবে। নিজেকে আর নিজের স্বপ্নকে নতুন করে সাজিয়ে তুলবে। সেই সাদা মানুষ হয়তো রঙ নিয়ে কিছু বলেছিল, কিন্তু সে আসলে জীবনের গভীরতাকে তুলে ধরেছিল।

এরপর থেকে নীলা নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত রঙিন করার চেষ্টা করত। আর সেই সাদা মানুষ? সে হয়তো অন্য কোনো রঙিন শহরের পথে হাঁটছে, অন্য কারও স্বপ্নের রঙ দেখতে। কিন্তু নীলার হৃদয়ে সে রেখে গেছে চিরন্তন এক বার্তা—জীবনকে রঙিন করে তুলতে হলে নিজেকে আগে সাদা থেকে রঙিন করতে হবে।
 

Comments

    Please login to post comment. Login