রহমান সাহেব প্রায় ৩৫ বছর ধরে সরকারি চাকরিতে ছিলেন। সততা ও কঠোর পরিশ্রমে কাটিয়েছেন জীবনের দীর্ঘ এই সময়টা। অবসরের পর তিনি ভেবেছিলেন স্ত্রী নাজমাকে নিয়ে বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটাবেন। ছোট্ট নাতিদের সঙ্গে সময় কাটাবেন, বাগানের ছোট লেবুগাছটা যত্ন করবেন, আর আল্লাহর ইবাদতে মনোযোগ দেবেন।
কিন্তু সেই স্বপ্ন অচিরেই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল।
অবসরের পর তিনি চাকরির পেনশনের টাকা পেলেন। মনে মনে ভেবেছিলেন এই টাকাটা বৃদ্ধ বয়সে তাদের আর্থিক নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু তার একমাত্র ছেলে ফাহিম আর বউ শারমিন সেই টাকার ওপর নজর দিল।
"বাবা, এই টাকাটা আমাদের দিন। আমরা এটা দিয়ে ভালো একটা ইনভেস্টমেন্ট করব। এই বাড়িটাও একটু নতুন করে মেরামত করে দেব, যাতে আপনি আর আম্মি আরাম করে থাকতে পারেন," ফাহিম বলল।
রহমান সাহেব ছেলেকে বিশ্বাস করলেন। তিনি সারাজীবন ছেলের জন্যই তো কষ্ট করেছেন। ছেলেকে টাকা দেওয়ার ব্যাপারে তার মনে কোনো দ্বিধা ছিল না।
কিছুদিন ঠিকঠাক চলল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পরিবর্তন শুরু হলো।
রহমান সাহেব ও তার স্ত্রী নাজমা লক্ষ্য করলেন, তাদের প্রতি আচরণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। খাবারের টেবিলে মাংস, মাছ, মিষ্টি সাজানো থাকত, কিন্তু তাদের জন্য থাকত শুধু ডাল আর ভাত। নাতনিদের দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দেওয়া হতো, আর ফাহিম-শারমিন নিজেরা মজা করে ভালো খাবার খেত।
যদি কখনও রহমান সাহেব কিছু চাইতেন, তখন শারমিন বিরক্ত হয়ে বলত, "এত কিছু চাইছেন কেন? এই বয়সে এত চাহিদা থাকা কি ঠিক?" ফাহিম কোনো কথা বলত না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত।
অন্যদিকে, শারমিনের মা ও ভাই প্রায়ই বাড়িতে এসে থাকত। তারা রহমান সাহেব ও নাজমার সাথে খারাপ ব্যবহার করত। শারমিনের মা স্পষ্ট বলেই দিত, "এখন তো বাড়ির মালিক ফাহিম। আপনাদের জন্য এত কিছু করা আমাদের দায়িত্ব নয়।"
এই অবহেলা ও অপমান ধীরে ধীরে অসহ্য হয়ে উঠল। রহমান সাহেব অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখানোর কথাও উঠত না। স্ত্রী নাজমা অনেক রাত ধরে চোখের পানি লুকিয়ে কান্না করতেন।
একদিন, এক তীব্র ঝগড়ার মধ্যে শারমিন ঘোষণা করল, "এই বাড়ি এখন আমাদের। আপনারা এখানে আর থাকতে পারবেন না। বের হয়ে যান।"
ফাহিম এই কথার প্রতিবাদ করল না। বরং চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। রহমান সাহেব আর নাজমা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। যেই বাড়ি তারা নিজেদের হাতে তৈরি করেছেন, সেখান থেকে তাদের বের করে দেওয়া হচ্ছে!
তারা কোনো কথা না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। চোখে ছিল অশ্রু আর মনে ছিল একটাই প্রশ্ন—তারা কি সারা জীবন শুধু এই পরিণতির জন্য এত কষ্ট করেছিলেন?
শেষ পরিণতি
এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের দেওয়া একটি পুরনো, ছোট্ট ঘরে তারা মাথা গুঁজলেন। তাদের দিন কাটত নিঃশব্দে, মাঝে মাঝে পুরনো দিনের স্মৃতি এসে চোখ ভিজিয়ে দিত। রহমান সাহেব অসুস্থ শরীরে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতেন, মনে মনে ভাবতেন, কোথায় ভুল করলেন তিনি?
যদিও নাজমা তাকে সান্ত্বনা দিতেন। তিনি বলতেন, "আমরা আমাদের কর্তব্য করেছি। তাদের দায়িত্ব ছিল আমাদের ভালো রাখা, কিন্তু তারা সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের এই বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের নয়, বরং তাদের চরিত্রেরই পরিচয়।"
নৈতিক শিক্ষা
এই গল্পটি আমাদের শেখায়, বাবা-মা আমাদের জীবনের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেন, তার প্রতিদান তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মাধ্যমেই দিতে হয়। বাবা-মার প্রতি অবহেলা বা খারাপ আচরণ শুধু তাদেরই নয়, বরং আমাদের মানবতারও অপমান।
পরিবারের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। বাবা-মা আমাদের জন্য যা করেছেন, তার তুলনায় আমাদের দায়িত্ব কিছুই নয়। তাদের প্রতি ভালোবাসা ও যত্ন দিয়ে তাদের শেষ জীবনটা সুখী করে তোলাই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।