Posts

গল্প

পৃথিবীর রোগমুক্তি

January 10, 2025

কাজী খান সৈকত

44
View

ছেলেবেলায় একদিন স্কুলে যেয়ে দেখি আজ ছুটি। উপলক্ষ্যটা আজ আর মনে নেই। তবে খুব আনন্দ হয়েছিল সেদিন। বন্ধুদের সবার অবস্থাও আমার মত। আগের দিন কোন নোটিশ ছিল না। ক্যালেন্ডারের পাতায় কোন দাগ কাটা ছুটি নেই। তবুও আজ স্কুল বন্ধ!

বহুকাল পরে। পৃথিবীতে তখন মহামারী ছড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ অফিস থেকে একটি বার্তা পেলাম। আগামী কাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। বার্তাটি পেয়ে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে ওঠে‌; একটানা ৬০ দিন বন্ধ।

লকডাউনের দুই মাস এবং পরবর্তী আরও তিনটি বছর। পৃথিবী‌ এক অভিনব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলো। সংক্রমন বাড়লে আবার লকডাউন। ফের নতুন সংক্রমনের ঢেউ।

টেলিভিশন আর পত্রিকার পাতায় দেখা গেল - লুকিয়ে থাকা মানুষে‌র জন্য নির্জন হয়ে পড়া সৈকতে, গোলাপী ডলফিন ঝাঁক বেঁধে ফিরে আসছে। শহুরে দাড়কাকের পাশাপাশি আরও অনেক রকম পাখির বারান্দার গ্রীলে এসে বসা শুরু হলো। শহরের মানুষগুলো প্রতিদিন ছাদে জড়ো হয়ে সূর্যাস্ত দেখে। আমিও প্রায় প্রতিদিন সূর্য ডোবা দেখি। আকাশে মেঘের রঙ বদলানো দেখি। রাতের আকাশে এত তারা দেখে মানুষ অবাক হয়। অনেক মানুষের নিঃশ্বাসের অসুখ ভালো হয়ে যায়।

পাখি, ফুল আর গাছপালার সাথে শহরে লাশবাহী ফ্রিজিং এম্বুলেন্সের সংখ্যা বাড়তে থাকে। রাতভর এম্বুলেন্সের সাইরেন কানে বাজে। কোনোটি অক্সিজেন মাস্ক লাগানো মুমূর্ষু রোগী নিয়ে ছুটছে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে। কোথায় খালি বেড পাওয়া যায়। কোনোটির গন্তব্য কবরস্থান। কোনোটি লাশ নিয়ে গ্রামে রওনা হলো। সেখানে দাফন‌ হবে।

মানুষের নিঃশ্বাস যতখানি যায় ততখানি সংক্রমনের সীমানা। মানুষের নিঃশ্বাস হয়ে উঠলো মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। এক এক জন মানুষ,‌একেকটি পরিবার বিচ্ছিন্ন‌ দ্বীপের মত হয়ে উঠলো।

মরে যাবার ভয়ে সন্তানেরা পিতা মাতার লাশের সৎকারে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। ভাই সহোদরের লাশ বয়ে নিতে অস্বীকার করতে থাকে। বাড়িতে, হাসপাতালে, রাস্তায় অনেক মৃতদেহ সমাহিত হবার অপেক্ষায় ছিল। এসময় বিভিন্ন জনপদে কয়েকজন দেবদূতের আবির্ভাব হয়। তারা মৃতদেহ সৎকারে নিয়োজিত হলো। দেবদূতদের কেউ কেউ একশ মৃতদেহ দাফন করে বিখ্যাত হয়ে ওঠে।

তারপর করোনার ভয়াবহ বিস্তারের মাঝেই আবার  কাজে যোগ দিতে বলা হয়। খেয়ে-পরে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে।

অভূতপূর্ব সময়টিতে আমি একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকি। নিজেদের একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা মনে হয়। একদিন একটি এম্বুলেন্সে করে দালানের পঞ্চম তলার বৃদ্ধ বাসিন্দাটি অন্তিম যাত্রায় যায়। একদিন জানা যায় তৃতীয় তলার সবাই মহামারীতে আক্রান্ত। একদিন শুনলাম নীচ তলার মোহাম্মদ জাকির হোসেন তার চাকরিটি হারিয়েছেন। দু মাস ধরে তিনি ফ্ল্যাটের ভাড়া পরিশোধ করতে পারছেন না। অভিনব সময়টিতে অবশ্য বাড়ি-মালিকেরা এই বিষয়টিতে বেশ ধীর ও সহনশীল হয়ে ওঠে।

আমাদের জীবনে ভোর হলে কাজে বেরোবার অব্শ্যকতাটি পুনরায় ফিরে আসে। পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকা এরকম এক সকালে জাকির হোসেনের সাথে আমার দেখা হয়। মহামারীর একটি ঢেউ তখন তার শীর্ষ বিন্দু অতিক্রম করছে‌। প্রতিদিন দ্বি-প্রহরে টেলিভিশনের পর্দায় মহামারীর সর্বশেষ পরিস্থিতি জানায়। সেখানে সর্বশেষ ২৪ ঘন্টায় মৃতের সংখ্যা ঘোষনা করা হয়। যা কয়েক শত অতিক্রম করে। আক্রান্তের সংখ্যা ঘোষনা করা হয়। যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যায়।

উল্লেখ্য দিনটিতে জাকির হোসেন দালানের প্রবেশ পথে, কলাপসিবল গেটের কাছে বসে ছিল। পরনে  চেকের লুঙ্গি ও হাতাকাটা গেঞ্জি। এই পোশাকটি, পরিহিত ব্যক্তিটিকে সাধারন একটি বৈশিষ্ট্য উপহার দেয়। গেঞ্জিটি সবসময় কোথাও না কোথাও ফেঁসে যায়।

জাকির হোসেনের সাথে কথোপকথনের পুরো সময়টাতে, তিনি মাটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার মুখ ভর্তি অপরিকল্পিত ভাবে বেড়ে ওঠা ঈষৎ পাকা দাড়ি। তাকে তার প্রকৃত বয়স থেকে বেশি বয়স্ক দেখায়।

প্রতিষ্ঠানে তার চাকরিটি ছিল অস্হায়ী। মহামারীর শুরুতে, লকডাউন শব্দটি যখন সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রপঞ্চ হয়ে ওঠে। তখন সকলের মত জাকির হোসেনের প্রতিষ্ঠানও ছুটি ঘোষনা করে।

জাকির হোসেন মোবাইল ফোনের টাওয়ার রক্ষনাবেক্ষন‌ কাজে নিয়োজিত ছিলেন। পেশায় তরিৎ প্রকৌশলী। এ বিষয়ে তার ডিপ্লোমা ডিগ্রী আছে। লকডাউনের পরে তার প্রতিষ্ঠান‌ কিছু জনবল ছাঁটাই করে। ওই দলে তাকেও রাখা হয়। শুরুতে তাদের ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। মহামারীর সাথে সাথে প্রতিশ্রুতিটিও প্রলম্বিত হতে থাকে। জাকির হোসেনরা বুঝতে পারে ওই আশ্বাসটি পূরন হবার সম্ভাবনা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে। এক পর্যায়ে ছাঁটাই হওয়া দলটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করে। পুরো বিষয়টি এরপর আইনের মারপ্যাঁচে আটকে যায়।

মধ্যবয়স্ক জাকির হোসেন বেশ কয়েক জায়গায় চাকরির চেষ্টা চালান। কিন্তু মহামারীর এই সময়টিতে চাকরির বিষয়টি আক্ষরিক অর্থেই সোনার হরিণ হয়ে ওঠে।

জাকির হোসেনের পরিবার তিন‌ সদস্যের। তার‌ সন্তানটি নবম শ্রেণীর ছাত্র। ঢাকার একটি স্বনামধন্য স্কুলে পরে। ছেলেটি মেধাবী বলে পরিচিত। তার স্ত্রীর একটি স্নাতক ডিগ্রী আছে।

মহামারীর সাথে আরও বেশ কিছুটা সময় কাটে। লকডাউন কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। মৃত্যুর মিছিলে ভিড় বাড়তে থাকে। শোনা যায় পাশের দেশটিতে ভাইরাসের এক নতুন ভেরিয়েন্ট ছড়িয়েছে। ততদিনে মানুষ ভাইরাসটির মানব শরীরে বংশবিস্তার ঠেকানোর কিছু প্রতিরোধক আবিষ্কার করেছে। ভাইরাসটির ধ্বংস ক্ষমতা কিছুটা কমে আসে। মুখে কাপড়ের মাস্ক আর পকেটে স্যানিটাইজার, মানুষের অভ্যাসে পরিনত হয়। মানুষ তীব্র লড়াইয়ের পর ভাইরাসটিকে পরাস্ত করার সম্ভাবনা তৈরি করে‌। এসবের বিপরীতে ভাইরাসটি তার জীনে পরিবর্তন নিয়ে আসে। নিজের ধ্বংস ক্ষমতা কমিয়ে সংক্রমন ক্ষমতা বাড়ায়। নতুন ভেরিয়েন্ট পৃথিবীতে দাবানলের মত‌ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। 


পাশের দেশে‌ একটি নদী লাশে‌ ভরে ওঠে। উজানের কিছু জনপদে মহামারীর শিকার হয়ে অনেক মানুষ মারা যায়। বেঁচে থাকা মানুষ রোগ ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্কে লাশগুলো নদীতে ভাসিয়ে দেয়। ওই দেশটি ধর্ম ও জাত-পাতের বিভক্তির কারনে বিখ্যাত। মহামারীর ফাঁদে পড়া মানুষ মন্দির ও মসজিদের দরজা খুলে দেয়। সব ধর্ম ও জাতের মানুষ সেখানে আশ্রয় নেয়। একদিন মহামারীর নতুন রুপটি সীমান্ত পেরিয়ে দেশে ঢুকে পড়ে।

জাকির হোসেনের ফ্ল্যাটের সামনে আমি এক বিকেলে কয়েকটি শিশুকে জড়ো হয়ে থাকতে দেখি‌। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তার স্ত্রী তার বাসাতেই শিশুদের পড়ানো শুরূ করেছেন। মহামারীর শুরুতেই বিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিটি শ্রেনীতে একটি পাঠ পরিকল্পনা দেয়া হলো। বাড়িতে বসে ওসব পড়তে বলা হলো। মহামারীতে মরে যাবার ভয় আর বৈষয়িক অনিশ্চয়তার সাথে অভিভাবকগণ এই অভিনব কর্তব্যে দিশেহারা হয়ে পড়েন। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একদল অভিভাবক জাকির হোসেনের স্ত্রীর দ্বারস্থ হন।

জাকির হোসেনের বসার ঘরের জীর্ণ সোফা ও কয়েকটি চেয়ারে শিশুগুলোর লেখাপড়া শুরু হয়। প্রথম দিকে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেনীর পাঁচটি শিশু একসাথে পড়তে আসতে থাকে। কিছুদিন পর অধ্যায়নরত শ্রেনীর উপর ভিত্তি করে শিশুগুলোকে কয়েকটি দলে ভাগ করা হয়। তারা আলাদা সময়ে পড়তে আসে। পড়তে আসা শিশুদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। একদিন দেখা যায় সকাল সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত জাকির হোসেনের ফ্ল্যাটটি শিশু ও অভিভাবকে মুখরিত হয়ে থাকে।

তার মেধাবী ছেলেটি শিশুদের ইংরেজি শিক্ষার দায়িত্ব নেয়। দক্ষ শিক্ষক হিসেবে ছেলেটির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। শোনা যায় জাকির হোসেনকে তার স্ত্রী শিশুদের গনিত পড়াতে বলেছিলেন। কিন্তু তার হঠাৎ রেগে যাওয়া এবং অকস্মাৎ চিৎকারে শিশুরা সন্ত্রস্ত‌ হয়ে পড়ে। এরপর থেকে‌ তাকে দাপ্তরিক বিষয়গুলোর দায়িত্ব দেয়া হয়।

ভাইরাসটির প্রবল প্রতাপ রুখতে মানুষ একসময় প্রতিষেধক আবিষ্কার করে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে টিকা দেয়ার মহোৎসব শুরু হয়। মানুষ মহামারীর বিপক্ষে জয়ী হয়ে উঠতে থাকে।

কয়েক বছর পর আবার পূর্ণ অবয়বে মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয়। জাকির হোসেনের ছেলেটি খুব ভালো ফল করে। আমাদের দালানের সব ফ্ল্যাটে সাফল্যের মিষ্টি পৌঁছে দেয়া হয়।

আলীমুল হাসানের গল্পটি অবশ্য উল্টো পথে হাঁটে। মহামারীতে যে মানুষগুলো কর্মক্ষেত্রে ছাঁটাই হয়, আলীমুল তাদের একজন। স্ত্রী ও একমাত্র শিশুপুত্রকে নিয়ে তিনি রাজধানীর একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে ভাড়া থাকেন। মহামারীর আগে তিনি একটি টাইলস প্রস্তুতকারক কোম্পানিতে, বিপনন বিভাগে কাজ করতেন। মধ্যমসারির কর্মকর্তা। কাজের খাতিরে তাকে এক শহর থেকে আরেক শহরে ছুটে বেড়াতে হতো।

অনেক কিছুর মত মহামারী নির্মান শিল্পে‌ ধ্বস নিয়ে আসে। অসংখ্য দালানকোঠা অসম্পূর্ণ কাঠামো নিয়ে মহামারী শেষের অপেক্ষায় থাকে। অনেকের সাথে আলীমুলকেও তার প্রতিষ্ঠান ছাঁটাই করে। তিনি তার জমানো টাকা পুঁজি বাজারে বিনিয়োগ করেন। তার স্ত্রী বাইরে ছাত্র পড়ানো শুরু করেন। বাড়িতেও কিছু ছাত্র-ছাত্রী পড়তে আসে। আলীমুলের পরিবার সংগ্রাম করে‌ টিকে থাকে।

আলীমুলের জগৎ ক্রমশ ছোট হয়ে আসে।‌ সে তার চাকরিচ্যুতি মেনে নিতে ব্যর্থ হয়। মহামারীর শেষে পৃথিবী যখন ক্রমশ সুস্হ্য হয়ে উঠছে, তাকে অনেক রকম হীনমন্যতায় ভূগতে দেখা যায়। তার সংসারটি পুরোপুরি তার স্ত্রীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। একদিন সকালে তার স্ত্রী কাজে বেরোলে সে তার শিশু পুত্রটিকে পরীক্ষা করে দেখে। আলীমুলের কাঁধে একটি জন্ম দাগ রয়েছে। সে শিশুটির কাঁধে হবহু একটি দাগ খুঁজতে থাকে। আলীমুলের মধ্যমায় অতিরিক্ত একটি রেখা টানা আছে। শিশুটির মধ্যমায় সে একটি অতিরিক্ত রেখার খোঁজ করে। এই জন্মদাগ আলিমুল উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। শোনা যায় তার পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ এবং তারও আগে তার পূর্ব পুরুষগণ  এইসব চিহ্ন বহন করত। আলিমুল তার শিশুটির পিতৃত্ব নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে। স্ত্রী কাজে বেরিয়ে যাবার পর প্রতিদিন সে শিশুটিকে উল্টেপাল্টে কাঙ্খিত চিহ্নটি খুঁজতে থাকে।

সংবাদপত্রের পাতায়, টেলিভিশন ও মোবাইল স্ক্রীনে আলোড়ন‌ সৃষ্টি করা দিনটিতে আলিমুলের স্ত্রী দীর্ঘক্ষন তাদের ফ্ল্যাটের সদর দরজায় কড়া নাড়ে। অনেকক্ষন ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। আলিমুলের মোবাইল ফোনটি নিরুত্তর বাজতে থাকে। তার স্ত্রী প্রথমে প্রতিবেশী ও পরে আত্নীয় বন্ধুদের কাছে আলিমুলের খোঁজ করে। কয়েকজন তার সাহায্যে ছুটে আসে। দরজা  ভেঙে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করার পর প্রথমে তারা শিশুটিকে নিস্তেজ অবস্হায় পরে থাকতে দেখে। একজন ছুটে গিয়ে পরীক্ষা করে জানায় শিশুটির নিঃশ্বাস এখনও চলছে। শিশুটির ঘাড়ে ও গলায় গভীর ক্ষতচিহ্ন। সম্ভবত শিশুটিকে গলা টিপে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়। পাশের ঘরে আলিমুল কে সিলিং এর সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। নাইলনের দড়িতে গলায় ফাঁস লাগানো। একজন ছুটে গিয়ে পরীক্ষা করে জানায় আলিমুল আত্নহত্যা করেছে।

কিছুক্ষণ পর একটি লাশবাহী ফ্রিজিং এম্বুলেন্স বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ায়। আলিমুলের মৃতদেহ এম্বুলেন্সে তোলা হয়। তার স্ত্রী শিশুটিকে নিয়ে লাশবাহী গাড়িতে উঠতে অস্বীকৃতি জানায়। যেহেতু শিশুটি তখনও বেঁচে আছে। মহামারীর মৃত্যুর মিছিল সামলাতে অসংখ্য লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যান কেনা হয়েছিল। এখন ওগুলোর বড় অংশই হাসপাতালে রোগী আনা নেয়ায় ব্যবহৃত হয়। এই যুক্তি আলিমুলের স্ত্রীকে টলাতে পারে না। তিনি তার সন্তানকে বুকে আঁকড়ে ধরে একটি সিএনজি নিয়ে হাসপাতালের উদ্দ্যশ্যে অনিশ্চিত যাত্রা করেন।

আলোচিত দিনটিতে জনপদের মানুষ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী তটস্থ হয়ে থাকে। সেদিন সকালে আমাদের শহর চৈত্রের রোদে ঝলসে যায়। সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলার গুলো ভাসানো হয়। অসংখ্য মানুষ সমুদ্রস্নানে নামে। ততক্ষনে সারারাত ধরে সৈকতে জমা হওয়া ঝিনুক গুলো অলংকারে পরিনত হয়েছে। একজন  নারীর গ্রীবায় এরকম একটি ঝিনুকের মালা তাকে মহাপৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী রমনীতে পরিনত করে। যে কচ্ছপটি বিগত দুইবার এই বেলাভূমিতে ডিম পারতে আসে, সে আরও নির্জন কোন স্হানের খোঁজে সরে যায়। গোলাপী ডলফিনের ঝাঁক গভীর সমুদ্রে যাত্রা করে। শহর ক্রমশ পাখিশূন্য হয়ে পড়ে। বিদ্যুতের তারে দাড়কাকের দল একা হয়ে পড়ে। আকাশে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু ভূবনচিল ডানা মেলে। কাঁধে ভারি ঝোলা নিয়ে শিশুরা বিদ্যালয়গুলোর দিকে যাত্রা করে। লক্ষ লক্ষ মানুষ তার দৈনিক কর্তব্য পালনে ছুটে যায়। শহরের পীচঢালা পথ, মটরযানে ভরে ওঠে। কারখানার দানবীয় যন্ত্রগুলো চিৎকার করে সচল হয়। শহরের আকাশ ধোঁয়া আর ধুলোয় ধুসর হয়ে ওঠে। মানুষ তার চেনা পৃথিবী ফিরে পায়।

আলোচিত দিনটিতে জাকির হোসেনের সাথে আমার দেখা হয়। আমার চোখে স্হির দৃষ্টি রেখে জাকির হোসেন কুশল বিনিময় করেন। জানা যায় শহরের শ্রেষ্ঠ কলেজটিতে তার মেধাবী ছেলেটি ভর্তি হয়েছে। এসময় একদল শিশু তার ফ্ল্যাটের সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে। ভেতরে জাকির হোসেনের স্ত্রীকে দেখতে পারা যায়। তার গ্রীবায় একটি স্বর্নের চেইন ঝলমল করে। জাকির হোসেন শিশুদের শৃঙ্খলা মেনে বের হবার নির্দেশ দেয়।

পৃথিবীর সাথে সাথে, জাকির হোসেন ও তার পরিবার সুস্থ হয়ে ওঠে।


কাজী খান সৈকত

Comments

    Please login to post comment. Login