Posts

চিন্তা

জামায়াত বনাম বিএনপি: এত উত্তাপে স্বার্থ কার!

January 10, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

24
View

জুলাই অভ্যুত্থানের আগে থেকেই বিএনপির সাথে জামায়াত-শিবিরের খানিকটা দূরত্ব তৈরি হয়। ৫ আগস্ট অভ্যুত্থান সফল হলে এবং আর্মি চিফ সবার আগে জামায়াতের আমিরের নাম উচ্চারণ করবার পর থেকেই তাদের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে উঠে যায়। যে জামায়াত এতদিন কোনো না কোনো বড় রাজনৈতিক দলের সহযোগী হয়ে রাজনীতি করতে পেরেই তৃপ্ত থেকেছে, তারা এখন একক পরাশক্তি হয়ে উঠতে চাইছে। যদিও এই শক্তির পরীক্ষাটা ভোটের মাঠে পরীক্ষা দিয়ে তারপর অর্জিত হওয়ার কথা। দেশটা এখনও যেহেতু সাংবিধানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রের নিয়ম ধরে রেখেছে। জামায়াতের ইচ্ছায় ইসলামী খেলাফত কায়েম হয়ে গেলে সেটি ভিন্ন অবস্থা তৈরি করবে। তখন যদি জামায়াত ক্ষমতায় থাকে আর কারো রাজনৈতিক অধিকার থাকবে না। খেলাফত ভিন্নমত সহ্য করে না। রাজার ছেলেপুলেরাই রাজা হয়। স্বজনরাই দেশের সমগ্র প্রশাসনিক ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে থাকে।

চুয়ান্ন বছরের বাংলাদেশে জামায়াতে সাথে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আমরা বিএনপিকেই রাখতে দেখেছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবার-পরিজনসহ পঁচাত্তরে এসাসিনেটেড হওয়ার পরে বহু ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া জিয়াউর রহমান সেনাপ্রশাসক হিসেবে দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুর খুনি ও স্বাধীনতার বিপক্ষে থাকা জামায়াতও রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেতে থাকে। পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার কেবিনেটে জামায়াতের দুই হেভিওয়েট সদস্য মন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতার প্রাণকেন্দ্রে ছিলেন।

সেই বিএনপির সাথে কী এমন ঘটল যে, এতটা দূরে সরে যেতে হলো জামায়াতকে? যতটা মনে হচ্ছে বিএনপি নিজেদেরকে নিখাদ মুক্তিযোদ্ধার দল মনে করছে। পক্ষান্তরে স্বাধীনতার প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতার পক্ষে এখনও অনড় অবস্থানে আছে জামায়াত। বিস্ময়কর সত্য হলো এখন যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সরকার দেশ চালাচ্ছে তাদের চেতনার সাথে জামায়াতে চেতনার মিল অনেকখানি। কার্যত এখানেই জামায়াত নিজেকে রুলিং পার্টি মনে করে ভীষণ শক্তিধর মনে করছে। পক্ষান্তরে বিএনপি‌ যেহেতু তাদের নেতা রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের চেতনাকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে অবস্থান স্পষ্ট করছে, এটাকে জামায়াত কিছুতেই হজম করতে পারছে না। জিয়াউর রহমান যেখানে স্বাধীনতার শত্রুমিত্রের মিল দেখতে চেয়েছে। সেখানে আজকের বিএনপি জামায়াতকে একাত্তরের ভূমিকার জন্য সরাসরি ক্ষমতা চাইতে বলছে।

জামায়াত ইসলামীর উদ্দেশ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব:) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আমরা ভেবেছিলাম এখন একটা সুযোগ এসেছে, এই সুযোগে তারা (জামায়াত) একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। সেটি না করে তারা একাত্তরে তাদের ভূমিকাকে জাস্টিফাই করছে। এবং দেশপ্রেমিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল কর্তৃক '৭১ এর মুক্তিযুদ্ধই জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অহংকার' শীর্ষক সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।
এসময় হাফিজ উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, আজকে গণঅভ্যূত্থানকে স্বাধীনতার উপরে স্থান দেয়ার একটি প্রচেষ্টা করছে একটি মহল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে কোনো কিছুরই তুলনা করতে পারি না আমরা। সবার উপরে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, চিরকাল এভাবেই থাকবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধকে কাউকে কলঙ্কিত করতে দিবো না। মুক্তিযুদ্ধ বিভক্ত হবে এটাও আমরা আশা করি না।

সম্প্রতি জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান এক ভাষণে বলেছেন, এদেশে দেশপ্রেমিক শুধুমাত্র সামরিক বাহিনী এবং জামায়াতে ইসলামী।

এ ব্যাপারে প্রেসক্লাবের ওই অনুষ্ঠানে মিস্টার হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা তাদেরকে এতদিন মিত্র হিসেবেই গণ্য করে এসেছি। তাদের উপর যখন অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছে ফ্যাসিস্ট বাহিনী আমরা তাদের সহমর্মিতা জানিয়েছি। তাদের দলকে যখন বিলুপ্ত করে দেয়া হয়েছে, ধানের শীষ দিয়ে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিয়েছি। বেগম খালেদা জিয়া তাঁদের মন্ত্রীসভায় স্থান দিয়েছে। আমরা অনেকে সেটি পছন্দ করিনি, দলের শৃঙ্খলার স্বার্থে মেনে নিয়েছি। তার বিনিময়ে কি তাদের এই উক্তি করা সঠিক হয়েছে? আমরা এই ধরনের উক্তি তাদের কাছে আশা করি না।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ৫ আগস্টের পর একটি রাজনৈতিক দলের আত্মসাৎ দেখেছে জনগণ; কারা পায়ের রগ কাটে তাদের চেনে জনগণ; ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে একাত্তরের বিরোধিতাকারী জামায়াত। ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করেন; ইসলাম মানে তো বারবার মোনাফেকি করা না।

জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিএনপির নেতা রুহুল কবির রিজভীর এমন বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় জামায়াত। তারা বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি ভারতের আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। জামায়াতের এই ভূমিকা গোটা জাতি গ্রহণ করেছে। আর এ কারণেই সম্ভবত রিজভীর গাত্রদাহ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এ ধরনের বিভ্রান্তিকর ও অপবাদ আরোপের রাজনীতি থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

জামায়াত-শিবির বনাম বিএনপির রাজনৈতিক উত্তাপ এতটাই বেশি ছড়াচ্ছে যে, লাস্ট রেজিমের কার্যকলাপ ও বিচার এবং জুলাই অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সাফল্যের আলাপ অনেকটাই ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংবিধান বিলোপ, আশু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছে বিএনপি ও জামায়াত। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বয়ান, কিংস পার্টি গঠন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও দ্রব্যমূল্যের টেনশনও যেন অনেকটাই চাপা পড়ে যাচ্ছে।

তাহলে এখন কথা উঠছে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রশ্নে কে পক্ষে আর কে বিপক্ষে এমন মীমাংসিত বিষয় নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের এই তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে আদতে কার লাভ হচ্ছে? এখন তো কথা বলবার কথা লাস্ট রেজিমের দুর্নীতিবাজদের ধরে বিচারের আওতায় আনা, তাদের পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনা এবং দ্রুততম সময়ে দেশে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি নিয়ে। কিন্তু তা না হয়ে উল্টো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস ও বিভক্তি তৈরি হচ্ছে। মানুষ ও দলের অতীত খুঁড়ে কালিমা বের করে লোকসম্মুখে আনা হচ্ছে।

বিএনপি যেখানে জামায়াতকে ক্ষমা চাইতে বলছে, সেখানে জামায়াতের অনুসারীরা বরং উল্টো জামায়াতের কাছেই সবার ক্ষমা চাইতে হবে বলছে। জামায়াতের কাছেই সবার কেন ক্ষমা চাইতে হবে? জামায়াত নাকি একাত্তরে ভারতের মাতাব্বরিতে স্বাধীনতা চায়নি। তারাই নাকি ঠিক ছিল। ওই আশঙ্কাই নাকি ২০২৪-এ এসে সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। যেজন্য তাদেরকে নাকি ভারতপন্থী আওয়ামী লীগের কাছ থেকে দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হয়েছে।

বিএনপি ও এর অনুসারীরা ঠিক এই জায়গাটিতেই জামায়াতের সাথে কঠোরভাবে দ্বিমত পোষণ করছে। বিএনপির দাবি, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধান বাদ দিলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বলে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। অতএব তারা রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার ভোটে নির্বাচিত সরকারের তরফে হোক এমনটা চান।

জামায়াত ও বিএনপির বাগযুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচ্ছন্ন ও প্রত্যক্ষ কোনো মতামত না থাকলেও নবগঠিত কিংস পার্টি জাতীয় নাগরিক কমিটির অনেক সদস্যই জামায়াতের সুরেই স্বর মিলিয়েছেন। এমন এক বাস্তবতায় বড় দল বিএনপি তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পরবর্তীতে কী পদক্ষেপ নেয় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দেখবার বিষয় এখন এটাই। আপাতত আমাদের প্রশ্ন একটাই জামায়াত বনাম বিএনপি: এত উত্তাপে আসল স্বার্থ কার?

লেখক: সাংবাদিক
১০ জানুয়ারি ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login