পুকুরপাড়ের দুপুরটা যেন থমকে থাকা এক চিত্রকল্প। আমগাছের পাতাগুলো নুয়ে আছে বাতাসের ভারে। চারপাশে শোনা যায় কোকিলের কুহুতান। সূর্যের আলো পুকুরের জলে পড়ে চিকচিক করছে। সেই পুকুরপাড়ে আনমনে বসে আছে অর্পা। কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল খোপা বাঁধা, আর সেই খোপা যেন তার মায়াবী চেহারাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। তার পরনে গাঢ় সবুজ শাড়ি, যা দীর্ঘ দিনের ধুলো-ময়লা মাখা। বয়স মাত্র উনিশ, তবুও চোখে মুখে যেন শতাব্দীর ক্লান্তি।পুকুরের স্থির জলে একের পর এক ঢিল ছুড়ে চলেছে অর্পা। তার চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা। ঢিলগুলো পানিতে পড়ার সাথে সাথে তৈরি হওয়া ঢেউগুলো যেন তার জীবনের এলোমেলো অধ্যায়ের প্রতিচ্ছবি।হঠাৎই পেছন থেকে বজ্রেপাতের মতো একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।– "এই হতচ্ছাড়ি!"
অর্পা চমকে উঠে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে, রহিমা বেগম (সৎ মা) তার দিকে তেরে আসছেন। হাতে একটা পুরনো ঝাঁটা নিয়ে। চোখে-মুখে ক্ষুভ।হারামজাদি! এখানে বসে বসে ঢিল ছুঁড়ছিস? আর ঐ দিকে ঘরের সব কাজ পড়ে আছে, সেগুলো কে করবে হে?অর্পা ব্যথায় কুকরে উঠে, তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। কাঁপা গলায় মা, আমি তো ঘরের সব কাজ গুছিয়ে রেখেদিয়েছি।রহিমা চোখে রাগের আগুন নিয়ে বলতে থাকে, "আর উঠোন, উঠোন কে ঝাড় দেবে তোর বাপ?অর্পা মাথা নিচু করে থাকে, ভেজা চোখে বলল, মাহ্, খেয়াল নেই। এক্ষুণি করে দিচ্ছি।"রহিমা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঝাঁটা দেখিয়ে বলে, "কেন খেয়াল থাকবে না? এই কুলক্ষী, তোর জন্য একদিন আমার কপাল পুড়বে, দেখিস! তুই হলি জন্মের কাল বুঝলি? যাহ,গিয়ে আগে উঠোন ঝাড় দে। আর শুন, কলপাড়ে থালা-বাসন রেখে এসেছি, সেগুলো ধুয়ে পরিষ্কার কর। চুপচাপ কাজে লেগে যা নাহলে এই ঝাটা দেখেছিস ত? ঝাঁটা দিয়ে পিঠের ছাল তুলে দেব একদম!"এটা বলে, ঝাঁটা অর্পার দিকে ছুড়ে মেরে হন হন করে চলে যান। যেতে যেতে নিজের মনে বলতে থাকেন, "কাজের কথা বল্লেই যেন রাজ্যের রানী অপমানিত হয়! যত্তসব! কবে এই আপদটা ঘাড় থেকে নামবে, কে জানে! এই বাড়ি থেকে লাত্তি মেরে বের করে দিতে পারলেই একটু শান্তি পাই।কথাটা শোনার পর, অর্পার চোখ থেকে দু'ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তবে সে কোনো প্রতিবাদ করল না। চুপচাপ চোখের পানি মুছে ঝাঁটা হাতে তুলে নিয়ে উঠোন ঝাড় দিতে চলে যায়।অর্পা জানে, এই কঠোর বাস্তবতার শুরু তার মায়ের মৃত্যুর দিন থেকেই। তিন মাস বয়সে মা-হীন শিশুর জীবনে যা কিছু ছিল, তা ছিল দাদির মায়া। কিন্তু মায়ার গণ্ডি ছাপিয়ে সৎমায়ের কঠোর আচরণ আর বাবার নীরবতার মধ্যে সে আজ একা। তার শৈশব কেটেছে মাটি আর শূন্যতার মাঝে, আর তার বর্তমান দিনগুলো বয়ে চলেছে চুপচাপ এক বোঝার মতো।পুকুরপাড়ে ফের বাতাস বইতে শুরু করল। আমগাছের পাতাগুলো আবারও সাড়া দিল সেই বাতাসে। কিন্তু অর্পার জীবনের গাছে কোনো নতুন পাতা গজানোর সম্ভাবনা যেন হারিয়ে গেছে বহুকাল আগেই।
90
View