আমার দোষ ( এক)
------নাসিমা খান
বিয়ের দু'বছর ভিতরও যখন আমি অনন্যাকে একটা ঘর দিতে পারলাম না, একটা সামাজিক পরিচিতি দিয়ে ঘরে তুলতে পারলাম না অনন্যা ক্ষিপ্ত হতে শুরু করল। ভাই বোনের ভিতর আমি ছোট। বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। বড়ো বোনের অনার্স-মাস্টার্স চলছে আর আমি সবেমাত্র অনার্সের ছাত্র। কিছুতেই বলতে পারলাম না, মা, অনন্যাকে আমি বাড়ি আনতে চাই।
অনন্যা ফ্রিল্যান্সিং শিখতে শুরু করল। আমি ওকে বাঁধা দিলাম না। কী যোগ্যতা ছিল আমার যে অনন্যার উপর অধিকার প্রয়োগ করি? দুই পক্ষই আমাদের গোপনে বিয়েটা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমার মায়ের শর্ত ছিল, তোমার বড় দুই ভাইবোনের বিয়ে না দিয়ে কিছুতেই আমি অনন্যাকে বাড়ি তুলতে পারব না। তাছাড়াও তোমার পড়া লেখা শেষ করতে এখনো পাঁচ বছর লেগে যাবে। তুমি নিজে পায়ে না দাঁড়িয়ে বউয়ের দায়িত্ব কীভাবে নিবে?
বাবার সম্পত্তি ছিল। কিন্তু তিনি শুধু শুধু আমার বউয়ের দায়ভার কেন নিবেন? বউকে খাওয়াবার সামর্থ নেই যার তার লজ্জা করা উচিত বিয়ে করতে যাওয়া। এরকম তীব্র কথার বাণে বিদ্ধ আমি একটু সান্ত্বনা পেতে ছুটে আসতাম অনন্যার কাছে। কিন্তু অনন্যা ফ্রিল্যান্সিং এর অজুহাতে আমাকে সময় দিত না। আমি অনন্যাদের ঘরের বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকতাম। কতবার যে আমার মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে অনন্যা তার ইয়ত্তা নেই। আমার মনে হতো এটা অনন্যার অভিমান থেকে ঘটে। অনন্যার উপেক্ষাগুলোকে ভাবলাম অভিমান, অনন্যার অযুহাতকে ভাবলাম রাগ।
আকস্মিক একদিন বাড়ি থেকে ফোন করল মা। বলল,জীবনে একটা খুঁত বানিয়ে নিলি শেষ পর্যন্ত?
: কী বলছ মা?
: অনন্যা তো তোকে ডিভোর্স দিয়েছে। পোস্ট অফিসে তোর ডিভোর্স লেটার এসেছে। বাড়ি এসেছিল। আমরা গ্রহণ করিনি। তুই বাড়ি এসে ডিভোর্স লেটার তুলে আন। বেঁচে গেছিস। এবার মনোযোগ দিয়ে লেখা পড়া কর। মেয়ে ভালো নয় আমি তো আগেই বলেছিলাম।
আমি মোবাইল কেটে দিলাম। এতো বড় কঠিন শাস্তি কীভাবে দিতে পারল অনন্যা? নিজেকে প্রশ্ন করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। শেষবার কী অনন্যার সাথে কথা বলা উচিত। একবার কী ওকে অনুরোধ করে কিছু সময় প্রার্থনা করা উচিত। অনেক আশা নিয়ে অনন্যার সাথে দেখা করতে গেলাম। অনন্যা দরজা খুলে মুখ বাড়িয়ে বলল,কেন এসেছ তুমি? আমি আলমকে বিয়ে করে নিয়েছি।
: তিনমাস এদ্দত পালন করতে হয়, অনন্যা। তুমি তিন মাসের আগে আর কাউকে বিয়ে করতে পার না। সেটা জায়েজ নয়।
: দেখ, পলক আমি যে অন্তঃসত্ত্বা নই সেই পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়েই আমাদের বিয়ে হয়েছে। কথা না বাড়িয়ে তুমি চলে যাও।
অনন্যা মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল। সেই কঠিন মুহুর্তের কথা কিছুতেই ভাবতে পারি না। ভার্সিটি ছেড়ে বাড়ি গেলাম। ডিভোর্স লেটার তুলে আনলাম। সম্পর্ক যেখানে নেই, আত্মিক টান যেখানে অনুপস্থিত সেই সম্পর্কের কোনো স্মৃতি আর রাখতে চাই না। অনন্যার দেওয়া সমস্ত কিছু পুড়িয়ে দিলাম। দামী ব্রাণ্ডের ঘড়ি, শার্ট-প্যান্ট, কোট, বিয়ের রিং এবং ডিভোর্স লেটার।
মরতে যে ইচ্ছে করেনি তা নয়। কিন্তু এটুকু বুঝেছিলাম মৃত্যু সব সমস্যার সমাধান নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে নতুন উদ্যমে লেখাপড়া শুরু করলাম। লোকে বলে স্মৃতিও এক সময় পানসে হয়। ক্ষতের উপরও প্রলেপ পড়ে। কিন্তু আমার চোখের সামনে শুধু অনন্যা ঘুরতে লাগল। সম্পর্ক কিছুতেই একটা ছেলেখেলা নয় এই বোধের জন্য আমি পুরনো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রইলাম। এই জীবনে অনন্যাকে আর পাবার নয় জেনেও প্রত্যাশা করতাম একদিন অনন্যা ফিরে আসবে।
পাশ করে ভাগ্য জোরে ব্যাংকে চাকরি পেয়ে গেলাম। মনের অজান্তে ঘরের দরজা খুলে আমি অনন্যার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। মাঝে মাঝে নিজেকে আবিস্কার করতাম এজিবি কলোনির অনন্যাদের বাসার সামনে। জানতাম অনন্যা বা অনন্যার বাবারাও কেউ এখানে এখন থাকে না। অফিস শেষের রুটিন হয়ে উঠল এজিবি কলোনি। বাসার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা।
একদিন বাসার মালিক আমাকে প্রশ্ন করল, এখানে প্রতিদিন এসে দাঁড়িয়ে থাকেন, আপনি কী কাউকে খুঁজছেন?
: খুঁজলেই কী মানুষ পাওয়া যায়? যে ইচ্ছে করে হারিয়ে যায় তাকে কী সত্যিই পাওয়া যায়? এমনি দাঁড়িয়ে থাকি।
: আপনার রহস্য আমাকে বলবেন? যদি কোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারি?
: স্বয়ং উপরওয়ালা যেখানে নিরব সেখানে আপনি তো সামান্য মানুষ। আমি আর আসব না, আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন।
লোকটা আমাকে পাগল ভাবলেও আমার কিছু এসে যায় না। ছ'মাস পরে আসলে হয়তো এই লোকটা আমার মুখ স্মরণ রাখতে নাও পারে।
বাড়ি থেকে বিয়ের চাপচাপি শুরু হলো। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। এবার আমার পালা। বিয়ের রাতে অন্তরাকে বলে দিলাম সব কথা। অন্তরা চুপচাপ শুনল। কিছুই বলল না। অনন্যা ছিল দুরন্ত আর অন্তরা শান্ত। দুজন দুই মেরুর। কিন্তু অনন্যার উপেক্ষাতে যে স্বাদ ছিল অন্তরার সাথে চরম মুহুর্তেও সেই রকম তৃষ্ণা অনুভব করি না। মানব মনের এই নিগুঢ় রহস্য কেউ কোনো দিন সনাক্ত করতে পারেনি।
অন্তরাকে নিয়ে মার্কেট গেলাম। অন্তরার আকর্ষণ শাড়ি, গয়না, অর্থ বাড়ি আর সম্পত্তি। অনন্যার কাছে ব্যক্তি মানুষ থেকে সুন্দরতর আর কিছু নেই। অনন্যা সামাজিক স্বীকৃতির থেকে মনের দিক যাচাই করত অনেক বেশি। দুইজনের এই তফাৎ আমি চিরুনী তাল্লাসি করে এক করে প্রমাণ করতে পারিনি।
অন্তরা আকস্মিকভাবে বলল, তোমার অনন্যা আমার ফেসবুকে এড রয়েছে।
চলবে -----------