Posts

উপন্যাস

তবু‌ মনে রেখো

January 13, 2025

Indrani Palit Karmakar

13
View

চিলেকোঠার ঘর পরিষ্কার করতে করতে হঠাৎ চোখ পড়ে জানালার ধারে, পরিপাটি করে রাখা হারমোনিয়ামের উপর। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই হারমোনিয়ামের সঙ্গে।

ছোটবেলায় সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয় তাদের মায়ের কাছে।খুব যত্ন করে তাদের মা তাদেরকে সঙ্গীত শেখাতেন।

সুরমা ও পরমা তারা দুবোন।রবীন্দ্রসঙ্গীত যেন তাদের প্রাণ।তাদের সুমধুর কন্ঠ একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে মিশে যায় যেন মনে হয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের  সুর জীবন্ত হয়ে উঠেছে।দূরে বড় বটগাছের তলায় কিছু বয়স্ক মানুষ গল্প করতেন তারাও যখন তাদের গান শুনতেন তারা মুগ্ধ হয়ে যেতেন।

তাদের মাও একজন সুগায়িকা ছিলেন।মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাদের পরিবেশনা শ্রবন করতেন তিনি।বহু সময় ব্যয় করে তিনি তার দুই মেয়েকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম দিয়েছিলেন। তাদের সুরের মূর্চ্ছনায় তা প্রকাশ পেত।সকলেই মুগ্ধ হয়ে তাদের গান শুনতো।

রবি ঠাকুরের জন্মদিন তাদের কাছে বড় প্রিয় একটি দিন।সেদিন তারা সুন্দর করে সাজে।পরনে থাকে লাল পাড় সাদা শাড়ি।কপালে ছোট্ট টিপ,চোখে কাজল, হাতে চুড়ি।সুসজ্জিতা হয়ে তারা যখন মঞ্চে ওঠে, তাদের দেখে কেউ আর চোখ ফেরাতে পারেনা।তারা গান শুরু করতো, "এলেম নতুন দেশে"।তাদের বাবা এক ছায়াময় গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে,মুগ্ধ নয়নে আনন্দাশ্রু ফেলতেন।তাদের বাবা ও মা দুজনেই চাইতেন তারা দুই বোন যেন সঙ্গীত নিয়ে অগ্রসর হয়।তারা যেন গানে  তাদের নাম করতে পারে।

অনুষ্ঠানের পর সব দর্শক আনন্দে করতালি দিয়ে ওঠে।তারা দুবোন ধীর পায়ে মঞ্চ থেকে নেমে তাদের মায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়।তাদের মা উষ্ণ আলিঙ্গনে তাদের জড়িয়ে ধরেন।তাদের বলেন তিনি,"তোমরা খুব সুন্দর গান পরিবেশন করেছ।তোমরা এগিয়ে যাও।" তিনি তাদের বাবার মতোই বাকরুদ্ধ হয়ে যান।

এরপর তারা আরো অনেক অনুষ্ঠান করে।রবি ঠাকুর যেহেতু তাদের প্রাণের ঠাকুর, তাই তারা যেমন রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করতো,তেমনই রবি ঠাকুরের মৃত্যু দিনও পালন করতো।তাদের  কাছে সেদিনটি খুব দুঃখের দিন ছিল। তাদের পাড়াতেও 22 শে শ্রাবণের অনুষ্ঠান হতো,তারা দুবোন সে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতো।তারা তবু মনে রেখো এই  গানটি পরিবেশনা করতো। বারিধারায় সকলে করতালিতে তাদের অভিনন্দন জানাতো।সকলেই চাইতো তারা যেন সঙ্গীত নিয়ে জীবনে কিছু করে।

তারা কালের নিয়মে বেড়ে ওঠে।কলেজ জীবন শুরু করে তারা।সঙ্গীত বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে।সুন্দর এগিয়ে চলছিল তাদের সাংগীতিক জীবন। 
কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছা অন্যরকম ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের মা অসুস্থ হয়ে পড়ে।অসুস্থতা ছিল আকস্মিক ও তীব্র। যা গোটা পরিবারকে হতবাক করে দিয়েছিল।সুরমা ও পরমা যতটা সম্ভব শক্ত থাকার চেষ্টা করতো।তারা পালা করে ঘরের কাজ,রান্নার কাজ করতো।অসুস্থ মায়ের সেবা করতো।কিন্তু,এতকিছু করার সত্ত্বেও তাদের মায়ের শরীরের অবনতি হতে থাকলো।

এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় যখন তারা তাদের পাশে বসেছিল,তখন তাদের মা তাদের দুবোনের হাত নিজের হাতে নিয়ে দুর্বল কন্ঠে ধীরে ধীরে বলেন প্রতিজ্ঞা করো,"কোন অবস্থাতেই তোমরা গান ছাড়বে না।গান তোমাদের রক্তে।এটাই তোমাদের পরিচয়।"

তাদের মায়ের মৃত্যু তাদের জীবনে এক বড় শূন্যতা তৈরি করে।যা পূর্ন করা কোনভাবেই সম্ভব না।যে বাড়ি সব সময় হাসি গানে মুখরিত থাকতো,সে বাড়ি আজ যেন গভীর বেদনায় ডুবে আছে।এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে তাদের বাড়ির পাশাপাশি তাদের জীবনেও। তারা তাদের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল,শোককে উপেক্ষা করে।তারা তাদের মাকে দেওয়া প্রতীজ্ঞা রাখার চেষ্টায় ছিল।

এখান থেকে তাদের দুবোনের পথ চলা শুরু হয়।তারা দুবোন যথেষ্ট পরিশ্রম করতো,গান নিয়ে।একটু সময় পেলে তারা টিউশন করতো।যাতে তাদের বাবাকে একটু আর্থিক সাহায্য করতে পারে।তাদের মা চলে যাওয়ার পর তাদের বাবা আর্থিক অনোটনে পড়েন।একসঙ্গে দুবোনকে পড়ানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।সুরমা স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর তাদের বাবা অন্য চিন্তা করতে থাকেন।

তাদের বাবা কষ্ট করে তাদের সঙ্গীত নিয়ে পড়াচ্ছিলেন।তারা দুবোন ও যথেষ্ট পরিশ্রম করছিল।তাদের পরিবারে আর কেউ না থাকায় বাড়ির সব কাজকর্ম তাদেরকেই করতে হতো।তাতে পড়াশোনার সময় একটু কমে যেত।তারা দুবোন একসঙেই অনুশীলন করতো,যেমন করে তাদের মা তাদের শিখিয়েছিল।

বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তারা অংশ নিতো।সেখান থেকে তারা কিছু হতো।তাতে তাদের একটু পরিচিতি হতো।তাদের দুবোনকে সুন্দর দেখতে ছিল।তাদের মায়ের মতো।তাদের বাবা ভয় পেতেন।তারা যেন কোন খারাপ সঙ্গে পড়ে না যায়।তাই তাদের একা ছাড়তেন না।যেখানে যাওয়ার থাকতো তিনি নিজে যেতেন তাদের নিয়ে।ছোটদের তাদের কোন অভাব বোধ করতে দেননি তিনি।

হঠাৎই তার নিজের শরীরও খারাপ হতে শুরু করে। হাল্কা জ্বর আসতো রোজ।তিনি ভয় পেতেন।তার অবর্তমানে তাদের কি হবে তা নিয়ে তিনি খুব চিন্তা করতেন।সুরমা বড় ছিল।তাই তিনি সুরমার পাত্র দেখা শুরু করলেন।তিনি চাইছিলেন অন্তত সুরমার বিয়ে দিয়ে যেতে।এদিকে পরমা একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়,অভিক নামে এক ছেলের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

এঘটনায় তাদের বাবা খুব ভেঙ্গে পড়ে।সুরমাকে সব সময় সদ্ উপদেশ দিতেন।সে যাতে এমন কাজ না করে তা তিনি বোঝাতেন।সুরমার বাইরে অনুষ্ঠান করা বা প্রতিযোগিতায় যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।সুরমার বাবা তাড়াতাড়ি সুরমাকে পাত্রস্থ করার চেষ্টা করছিল।পরমার ঘটনার জন্য সুরমার বিয়ের ব্যবস্থা করা  কঠিন হয়ে পড়েছিল।

তবু সুরমার বাবা হার মানেন নি। তারা মফস্বলে থাকতেন।তিনি চেষ্টা করছিলেন তার মেয়ের বিয়ে শহরতলীতে দিতে। এক উচ্চ পরিবারের সঙ্গে তিনি কথা বলেন,তার মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে।সুরমার ছবি দেখে তাদের খুব পছন্দ হয়।তারা অগ্রহায়নের শুরুতেই তাদের বিয়ের কথা পাকা করেন।

পাত্রের বাড়ি থেকে গুরুজনেরা এসে সুরমাকে আশীর্বাদ করে যান।সুরমার পরনে ছিল তাদের মায়ের মাহিসোর সিল্কের শাড়ি হলুদ রঙের। সঙ্গে হাল্কা সোনার গহনায় তাকে স্বর্গের অপসরা লাগছিল। নিমন্ত্রিত মানুষদের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেদিকে তাদের বাবার বিশেষ নজর ছিল। অনুষ্ঠান পর্ব ভালভাবে সমাপ্ত হয়।

সেদিন তিনি সুরমাকে ডেকে বলেন," তুমি নতুন জীবনে প্রবেশ করতে চলেছ।সেখানে সব মানুষকে তুমি আপন করে নেবে।যেমন করে তারা বলবেন,তেমন করে তুমি চলবে।" সুরমা তার বাবার কথায় সম্মতি জানায়।শুধু তার  ভয় হয় সে চলে গেলে তার বাবাকে কে দেখবে।



 

আগামীপর্বে: সুরমার বিয়ে হয় সুজনের সাথে।
                                                               চলবে.....

আমার গল্প যদি আপনাদের ভাল লাগে,তাহলে আমাকে ফলো করে দেবেন।নতুন পর্ব বা নতুন গল্প যখন আমি আপলোড করবো তা সবার আগে আপনার কাছে পৌঁছে যাবে।ধন্যবাদ

Comments

    Please login to post comment. Login