Posts

চিন্তা

বাংলাদেশের বিনোদন শিল্পের বৈপ্লবিক পরিবর্তনঃ এখন, নয়তো কখন?

January 16, 2025

Arif Ali Mahmud

14
View

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা দেশের সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় দিন দিন অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে এটি এখন বসবাসের প্রায় অযোগ্য নগরীতে পরিণত হয়েছে। এই সমস্যা থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে অনেকে অনেক কথা বলছেন, যার মধ্যে কেউ কেউ বলছেন, ঢাকা থেকে এটা-সেটা অন্যত্র সরিয়ে দিলে এরূপ অবস্থা থেকে অনেকটাই মুক্তি মিলবে। ঢাকাকে শুধু দেশের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে ছেড়ে দিলেই ভালো হয়।

এদিকে দেশের বিনোদন শিল্পকে এর দুর্বল অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে এবং মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে বহুদিন ধরে সংগ্রাম করা হচ্ছে।

উপরোল্লিখিত এই দুটি বিষয়কে মাথায় রেখে দেশের বিনোদন শিল্প নিয়ে আজ কিছু কথা বলা যাক। আমরা বিশ্বের প্রধান কিছু বিনোদন শিল্প কেন্দ্রসমূহের দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, সেগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় রাজধানীর বাইরে অবস্থিত, যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের বিনোদন শিল্পের প্রধান কেন্দ্র লস এঞ্জেলেস। একইভাবে ভারত, তুরস্ক, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া প্রভৃতি দেশের বিনোদন শিল্পের প্রধান কেন্দ্রসমূহ যথাক্রমে মুম্বাই, ইস্তাম্বুল, করাচি এবং লাগোস। আবার, চীনের ক্ষেত্রে সেগুলো সাংহাই, হংকংসহ বিভিন্ন শহরে অবস্থিত। আমরা জানি যে, উপরোল্লিখিত প্রত্যেকটি শহরই নিজ নিজ দেশের জাতীয় রাজধানী ভিন্ন আলাদা শহর এবং প্রত্যেকটিই সমুদ্র তীরবর্তী বন্দর নগরী। সুতরাং বলতে চাচ্ছি যে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় যদি দেশের পুরো বিনোদন শিল্প বা 'এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি'কে (ফিল্ম, টিভি, ফ্যাশন, মিউজিক ইতাদি) রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা যায়, তাহলে আশা করি ভালো হবে। এর মাধ্যমে মূলত কয়েকটি ফায়দা লাভ করা যেতে পারে। যথা-

প্রথমত, রাজধানী ঢাকার ওপর যে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা কিছুটা হলেও কমবে।

দ্বিতীয়ত, চট্টগ্রামের উন্নয়ন আরো ত্বরান্বিত হবে।

তৃতীয়ত, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের গুরুত্ব ও খ্যাতি আরো বৃদ্ধি পাবে।

চতুর্থত, দেশের বিনোদন শিল্প একটি সম্পূর্ণ নতুন রূপ লাভ করে নতুন যুগের সূচনা করতে পারবে।

আর এরূপ স্থানান্তর নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রের চলচ্চিত্র শিল্প সর্বপ্রথম নিউ জার্সি, নিউ ইয়র্ক প্রভৃতি স্থানে যাত্রা শুরু করেছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে সেখান থেকে ধীরে ধীরে ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলেস ও তার আশেপাশে স্থানান্তরিত হয়ে আজকের হলিউডে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া, একটি দেশের বিনোদন শিল্পের কেন্দ্র হিসেবে সে দেশের সমুদ্র তীরবর্তী কোনো বন্দর নগরীর (যদি থাকে) কোনো জুড়ি নেই। এ পর্যায়ে প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা যায় এবং পাশাপাশি ঢাকাসহ অন্যান্য শহরের সাথে এর কিছু তুলনামূলক পার্থক্য তুলে ধরা যায়। যথা-

১. বর্তমানে ঢাকা শহর চট্টগ্রাম শহরের চেয়ে আয়তনে বড় হলেও, চট্টগ্রাম জেলা ঢাকা জেলার চেয়ে আয়তনে বেশ বড়। এখানে জেলার প্রসঙ্গ টানার কারণ হলো, শহর দুটি প্রধানত নিজ নিজ জেলার সীমানার ভেতরেই দিনে দিনে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকবে। 

২. চট্টগ্রাম জেলা আয়তনে বড় হলেও ঢাকা জেলার চেয়ে এর জনসংখ্যা কম। সুতরাং জনসংখ্যার ঘনত্বও খুব কম।

৩. ঢাকায় যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, বর্তমানে তার মধ্যে অনেকগুলোই চট্টগ্রামে রয়েছে এবং সামনে আরো অনেক কিছু হচ্ছে। তবে অতিরিক্ত হিসেবে চট্টগ্রামের রয়েছে বিশাল সমুদ্র সৈকত, সমুদ্র বন্দর, দ্বীপ, পাহাড়-পর্বত, জলপ্রপাত, বন-জঙ্গল ইত্যাদি, যেগুলো ঢাকায় নেই।

8. এছাড়াও চট্টগ্রামকে ঘিরে রয়েছে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়ির মতো চারটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বৈচিত্র্যময় ও সম্ভাবনাময় জেলা। ঢাকার তুলনায় চট্টগ্রাম থেকে এসব জেলায় যাতায়াত করা তুলনামূলক সহজ এবং সময় ও খরচ কম।

৫. দেশের সব উপকূলীয় শহরগুলোর মধ্যে একমাত্র চট্টগ্রামই একইসাথে দেশের প্রধান বন্দর নগরী, ব্যবসায়-বাণিজ্যের কেন্দ্র, বিভাগীয় রাজধানী এবং দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী।

সুতরাং উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করে বলা যায়, ঢাকার বাইরে দেশের বিনোদন শিল্পের কেন্দ্র হিসেবে চট্টগ্রাম সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান । আমাদের নিজস্ব হলিউড-বলিউডের কথা কল্পনা করলে চট্টগ্রাম একটি আদর্শ শহর। এমতাবস্থায়, সবদিক বিবেচনা করে সঙ্গতকারণেই যদি দেশের পুরো এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি, অর্থাৎ এফডিসি-সহ অন্যান্য শুটিং হাউজ, স্টুডিও, রেকর্ডিং স্টুডিও, ল্যাব, প্রোডাকশন হাউজ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সবকিছু সেখানে স্থানান্তর করা যায়, তাহলে দেশের গোটা বিনোদন শিল্পের মধ্যে ব্যাপক বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব আসবে বলে আশা করা যায়। তবে ঢাকা এবং এর আশেপাশে কিছু স্টুডিও, ফিল্ম সিটি ইত্যাদি থাকতেই পারে এবং প্রয়োজনে সেখানে শুটিংও হতে পারে। কিন্তু দেশীয় এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির মূলকেন্দ্র হবে চট্টগ্রাম। তখন নাহয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে ঢালিউডের পরিবর্তে অন্য কোনো নামে ডাকা যাবে। ধীরে ধীরে সেলিব্রিটিরাও নিজেদের ইচ্ছে ও সুবিধামতো সেখানে স্থানান্তরিত হতে পারবেন। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হলিউড-বলিউডের সেলিব্রিটিরাও সঙ্গত কারণে তাদের দেশের রাজধানীতে নয়, বরং লস এঞ্জেলেস, বেভারলি হিলস বা মুম্বাইয়ের মতো শহরে বাস করে থাকেন।

সুতরাং বাংলাদেশের এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির পুরো ব্যবস্থায় যদি এরকম বৈচিত্র্য আনা যায়, তাহলে আশা করা যায়, শীঘ্রই পুরো ইন্ডাস্ট্রি তার দুর্বল অবস্থা থেকে উন্নতি লাভ করবে, নতুন করে বিশ্ববাসীর নজর কাড়বে, এবং একদিন কাঙ্ক্ষিত বিশ্বমানে পৌঁছতে সক্ষম হবে। আবার, এর মাধ্যমে পুরো চট্টগ্রাম অঞ্চলের পর্যটন, আবাসন, অবকাঠামো, ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ অন্যান্য খাতসমূহও লাভবান হবে।

এতে আশা করি, শীঘ্রই চট্টগ্রাম শহর একটি 'গ্লোবাল সিটিতে' রূপান্তরিত হতে পারবে। আর এসবের প্রভাব রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বড় শহরেও পড়বে। সুতরাং বলা যায়, এরকম একটি বৈপ্লবিক উদ্যোগ দেশের বিনোদন শিল্প, অর্থনীতি এবং গোটা দেশের চেহারা পাল্টে দিতে সক্ষম। বর্তমানে দেশ যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে এই শিল্পের জন্য এরকম উদ্যোগ নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। তবে এই প্রক্রিয়াটি জটিল, সময়-সাপেক্ষ এবং ব্যয়-সাপেক্ষ। কারোর একার পক্ষে বা রাতারাতি এটি করা সম্ভব নয়।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, "এসব করবে কে?" উত্তর হলো, ইন্ডাস্ট্রির লোকেরাই করবে। তারা ব্যতীত আর কে করতে পারে? আর যদি কেউ বলে, "আমাদের এসব করার দরকার নেই। ভবিষ্যতে, কেউ করলে করবে।", তাহলে আর কিছুই হলো না। কোনোকিছু কাউকে না কাউকে প্রথমে শুরু করতে হয়। তাই এ ব্যাপারে বর্তমানের লোকেরাই নাহয় শুরু করলেন। আবার, এও প্রশ্ন হতে পারে, "দেশে তো আরো শহর আছে। তাহলে শুধু চট্টগ্রামের কথাই বলা হচ্ছে কেন?" এর উত্তরে বলা যায়, দেশের বিনোদন শিল্পের উন্নয়ন এবং বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব আনয়নের লক্ষ্যে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ব্যতীত আর কোনো উত্তম বিকল্প নেই।

যাই হোক, ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান অবস্থার উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনের পাশাপাশি এরূপ একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনও জরুরী বলে মনে করি। তাই এই বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার নিকট আবেদন জানাচ্ছি। এ বিষয়ে দেশের অভিনয় শিল্পী, মডেল, কণ্ঠশিল্পী, নির্মাতা  প্রযোজক, কলা-কুশলী, স্টুডিও মালিক, দর্শক-শ্রোতা ও সাংবাদিকসহ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাচ্ছে। বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাচ্ছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (বি. এফ. ডি. সি.), চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতি, পরিচালক সমিতি, শিল্পী সমিতি, প্রযোজনা সংস্থা এবং গণমাধ্যমের। তাদের সকলের সদিচ্ছা এবং সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগই এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বাস্তব রূপ দান করতে পারে। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের অংশ হিসেবে বিনোদন শিল্পের উন্নয়ন হোক, বাংলাদেশের মঙ্গল হোক এটাই কামনা। ধন্যবাদ।

Comments

    Please login to post comment. Login