Posts

গল্প

এসপারওসপার

January 16, 2025

Nasima Khan

9
View

এসপারওসপার 
------নাসিমা খান 
ফারিসা নামে আমার এক বান্ধবী ছিল। বাড়ির পাশে বাড়ি। খুব খাতির ছিল। আমার আর ফারিসাদের বাড়ির মাঝে একটা ফাঁকা ভিটে ছিল। একটা মাটির তৈরি বাড়ির ধ্বংসাবশেষ ছিল মাটির উঁচু স্তম্ভ ছিল একটি। ভিটেই প্রচুর দাতন গাছ ছিল। সেখানে আমাদের দুজনের কথা হতো। তিন গুটি খেলতাম, দাড়িয়াবান্ধা খেলতাম, মাঝে মাঝে পুতুলও খেলতাম। শুনতাম ভিটেই অনেক সাপ আছে। কিন্তু কী যেন একটা গাছের জন্য সাপ ফণা তুলতে পারে না। আমরা দুজন তারপরেও ভিটেই মাটির টিবিটার উপর বসে থাকতাম।

খুব সম্ভব ক্লাস সেভেনে  উঠলে একদিন শুনলাম ফারিসার বিয়ে হয়ে গেছে। আশ্চর্য গত বিকেলেও ভিটেই বসে ফারিসার ভ্রু সাইজ করে দিয়েছিলাম। কিছু তো বলেনি। গ্রাম্য সূলভ কৌতুহলে চলে গেলাম ওদের বাড়ি। শুনলাম বর নিয়ে ঘরে দরজা দিয়ে আছে।

গ্রামে ফিসফাস চলছে ফারিসার বর সাকিবের প্রেম ছিল আর একটা মেয়ের সাথে। কিন্তু কীভাবে সম্ভব হলো এটা?  অই মেয়ে তো ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। কীভাবে হলো সে রহস্য জানতে পারলাম না। ফারিসার সাথে তেমন একটা দেখা হয় না। যখনই খুঁজতে যাই দেখি ফারিসা আর সাকিব ঘরে দরজা দিয়ে আছে।

দুয়েক দিন পরে ফারিসাকে ভুলে গেলাম। ফারিসার সাথে সময় কাটত কিন্তু ওর সাথে আসলে আমার বন্ধুত্ব ছিল না।

ছয়মাস পরে ফারিসা আমাকে খুঁজতে এলো। সাকিব বি সিএস পরীক্ষায় পাস করে বড়ো অতিরিক্ত পুলিশ সুপার  হয়েছে।  তাই সে রাজশাহী চলে গেছে। সমস্যা হলো সে নাকি ফারিসার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখে না। ভিটের মাটির ঢিবির উপর বসে ফারিসার দুঃখের কাহিনী শুনলাম। সাকিব চিঠি পত্র দেয় না। আরো বড়ো কথা কীভাবে চিঠি লিখতে হয় ফারিসা তা জানে না। ফারিসা খুব খারাপ ছাত্রী ছিল। ফারিসার অনুরোধে আমি চিঠি লিখতে বসলাম। বললাম, বল কী লিখব?

ফারিসা বলল, কী লিখবি বলতে পারলে তোকে লিখে দিতে বলব কেন?  তুই তোর মতো করে লিখে দে।

প্রেমিককে চিঠি লেখার নিয়ম শেখানো হয় না স্কুলে। সুতরাং বেকায়দায় পড়ে গেলাম। বললাম, কী বলে সম্বোধন করব? 
ফারিসা বলল,তোর যা মনে হয় তাই লেখ।

কিছুই মনে আসে না আমার। অগত্যা যা মনে আসল তাই লিখলাম। প্রিয়তম স্বামী দিয়ে শুরু করলাম। তারপর চিঠির উত্তর দেওয়ার করুণ আকুতি করলাম। সবশেষে শ্রেণি মতো সালাম, শুভেচ্ছা দিলাম। কাদের তা জানি না। মোটামুটি স্কুলে শেখা পিতার কাছে টাকা চাহিয়া পত্র লেখার সম্পূর্ণ কাঠামো ঠিক রেখে যা যা মনে আসল তাই তাই লিখলাম।

এক ব্যাংকের ম্যানেজার মামা রাজশাহী একটা ব্যাংকে চাকরি করতেন। প্রতি পনেরো দিন পর তিনি বাড়ি আসতেন। পনেরো দিন ধরে আমি চিঠি লিখতাম একই ফর্মুলাতে। পনেরো দিন পর কাগজ দিয়ে খাম বানিয়ে, ভাত দিয়ে চিঠির মুখ আটকে ম্যানেজার মামার কাছে দুজন যেয়ে চিঠি দিয়ে আসতাম।

চিঠির উত্তর আসেনি একটাও। ফারিসা খুব বিরক্ত করে। পৃথিবীর যত কোমল ভাষা আছে ব্যবহার করতাম যদি পাষাণের মন গলে। ব্যর্থ হয়ে ফারিসা আমাকে সাথে নিয়ে ম্যানেজার মামার কাছে যায়  আর কান্নাকাটি করে। অনুনয় বিনয় করে। বলে, সে যেন আমার চিঠির উত্তর দেয়।

ম্যানেজার মামাও নানা রকম বুদ্ধি খাটায়। কিন্তু সাকিবের সাড়া নেই। ফারিসা খুব নরম মেয়ে। দেখতে দেখতে আরো দুটো বছর কেটে গেছে। এর মাঝে মাত্র একবার এসে দুদিন ঘরে দরজা দিয়ে থেকে গেছে ফারিসার সাথে। কিন্তু সাকিব তার জন্য একটা সুতোও আনেনি।

ফারিসার মা-বাবার তেমন গুরুত্ব দেখি না। ফারিসা এসে আমার কাছে কাঁদে। সাকিব বছরে একবার আসে। দুদিন থেকে চলে যায়। স্ত্রী সহবাস ছাড়া ফারিসার সাথে কোনো কথা হয় না। কেন চিঠি লেখে না তার কোনো জবাব দেয় না। ফারিসা জিজ্ঞেস করলে নাকি বলে, বেশি কথা বলবি না, তাহলে একদম আসব না।

আমি অলরেডি ইন্টারে পড়ি। একদিন ফারিসা এলো মূর্তিমান কালি যেন। বলল,আমি যাব। 
: কোথায় যাবি? 
: সাকিবের কাছে। 
: এতো দিন পরে এই সিদ্ধান্ত কেন? 
: ও নাকি এক এসপির সাথে থাকে। 
: পুরুষের সাথে? 
: না বিটি পুলিশ।

বললাম, দ্যাখ এসপার ওসপার। থাকলে থাকবে, না থাকলে চলে যাবে। 
: সে হবে না, আমি অই বিটির চুলের মুঠো ধরে বাসা থেকে বের করে দিয়ে আসব। 
: তুই!  তুই পারবি?  এতো সহজ? 
: যদি না পারি সাকিবরে খুন করে চলে আসব। 
: কী বলিস?
: হ্যাঁ, যা বলছি তা একদম সত্য।

ফারিসা একদিন সেই ম্যানেজার মামার সাথে ঢাকা রওনা হলো। সাকিব তখন পুলিশের এসপি। ঢাকাতে থাকে। আশঙ্কা হলো ফারিসা আহত হয়ে ফিরবে।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য ফারিসা পুরো ছয়মাস পরে ফিরে এলো। ফারিসা অন্তঃসত্ত্বা তখন। ফারিসাকে অনেকেই দেখতে এসেছে। সঙ্গে সাকিবও আছে। ফারিসার কাপড় চোপড় খুব দামী নয় অত্যন্ত খারাপ। কমদামী চেক শাড়ি। অন্যদিকে সাকিব স্যুট কোট টাই। 
ফারিসার সময় নেই বেশি আমার সাথে কথা বলার। শুধু বলল,ভালো আছি।

প্রায় বছর দশ পরে ফারিসার সাথে দেখা। দুই মেয়ে। সঙ্গে সাকিবও আছে। না ফারিসার বেশভূষার তেমন পরিবর্তন নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা সেদিন তুই কী করেছিলি যে শেষ পর্যন্ত তুই থেকে গেলি।

ফারিসা হাসল। বলল, তেমন কিছু না। সাকিবের ঘরে গিয়ে দেখি ফিটফাট ঘর। মহিলার কাপড়ও রয়েছে। প্রথমে আলনা থেকে মহিলার কাপড় নিয়ে রাস্তায় ফেলে দিলাম। 
তারপর? 
তারপর সাকিবের বাঁধানো ফটো দেয়াল থেকে পেড়ে ভেঙে চুরমার করে দিলাম। এরপর টিভি ধরেছিলাম। কিন্তু সাকিব এসে আমার হাত থেকে টিভি ধরে নিয়ে রাখল। 
তারপর? 
: সাকিব বলল আমি তো এই আগুন দেখতে চেয়েছিলাম। ফারিসা তুমি এসেছো আমি আর কাউকে চাই না। 
: এতো সহজে হয়ে গেল?  সেই মহিলা? 
: মান নিয়ে সরে গেল। 
: সরে গেল? 
: হ্যাঁ!  কারণ আমি বলেছিলাম আমি ওদের হেডকোয়ার্টারে যাব, আর দুইজনের নামে অভিযোগ করব। 
: তুই!  তুই?
: হ্যাঁ, তোর কথা মনে হয়েছিল। তুই বলেছিলি এসপার ওসপার। ব্যাস!  সম্মানের ভয় সবার আছে। 
: এখন তোকে ভালোবাসে? 
: ভালোবাসা দিয়ে কী করব?  স্বীকৃতি, টাকা, অধিকার সব তো আছে। ভালোবাসা তো আপেক্ষিক ব্যাপার। আজ বাসে না। কাল বাসবে।

শুনেছি ফারিসার এখন চার কন্যা, এক পুত্র। ফারিসার এখন কোনো কিছুরই অভাব নেই। সাকিব বুড়ো হয়েছে। রিটায়ার্ড করেছে সেই কবে। জানি না ফারিসা শেষ পর্যন্ত ভালোবাসা পেয়েছিল কিনা। বহু বছর হলো ফারিসার সাথে দেখা হয় না। 
----------সমাপ্ত------

Comments

    Please login to post comment. Login