Posts

প্রবন্ধ

পুরান ঢাকার অলিগলি

January 17, 2025

রাহিল

8
View

পুরান ঢাকা বলতেই দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে, অবিস্তৃত এলাকার সমাবেশ; রাস্তাগুলো সরু, যেখানে বহুলোকের আবাস। এখন এমন মনে হলেও তা পূর্বে ছিল ছিমছাম, সাজানো এক শহর। একেকটা বাড়ি ওদের পূর্বসূরীদের স্মৃতি বহন করে। ওরা খুব চালাক-চতুর আর ব্যবহারে অমায়িক। সারা বিশ্বেই সুপরিচিত এ শহর। বাংলাদেশের প্রধান কেন্দ্র তো বটেই, এটা মসজিদের শহর হিসেবেও প্রসিদ্ধ। ইতিহাস এর প্রাচীন, এ খ্যাতি অর্জিত হতে লেগেছে যথেষ্ট সময়।

শুক্রবার; সিফাত ও হাসান বের হয়েছে সেসব মসজিদ সন্ধানে, যেগুলো শতাব্দীকাল ধরে বহন করছে নিজ ইতিহাসের স্বাক্ষ্য। সিফাতের মূল উদ্দেশ্য এটা হলেও হাসান সিফাতকে সঙ্গ দিচ্ছে অন্য এক লক্ষ্যে, যদিও পুরো ব্যয়ভার ওর। জুমা পড়ার জন্য শতাব্দীপ্রাচীন মসজিদই ওদের বাঞ্ছনীয় ছিল। তবে হাসানের কথায় দু’জন বায়তুল মুকাররমে প্রবেশ করল। বেশ প্রফুল্ল লাগছিল তাকে। কারণ, ছোটবেলায় এ মসজিদে আসত সে, বহু বছর পর এসেছে আজকে। জুমা আদায় করে হাসান....।


 

১. 

চল, আমরা পুরান ঢাকার দিকে যাই, সিফাত বলল। হাসান রাজি হলে গুলিস্তান পেরিয়ে বংশালের রাস্তা ধরে দু’জনে এগোতে থাকল। একটা গলি, আর সামান্য দূরে এত মসজিদ! এজন্যই কি ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের শহর? একেকটা মসজিদ কি বিশাল বিশাল! এত লোকই বা কোথায় থাকে? তারা বড় গলির বামে আরো সরু এক গলিতে ঢুকল, এটা কাশাবটুলী এলাকা। এ চিকন গলিতে এত মানুষ, বাড়িঘর! সেই একই অবস্থা মসজিদের সংখ্যাও কম নয়। এ এলাকায় ‘চিনির মসজিদ’ নামে প্রসিদ্ধ এক মসজিদে তারা প্রবেশ করল। বাহির থেকে পুরোনো আমলের কারুকার্য দেখে অবাক হচ্ছে তারা। ভিতরে ও বাইরের দেয়ালসহ সম্পূর্ণ জায়গায় চিনিটিকরি পদ্ধতির মোজাইক দিয়ে নকশা করা। নামাজ শেষ হয়েছে আরো আগেই, তবে বেশ কয়েকজন মুরব্বীকে দেখা যাচ্ছে বসে কি যেন আলোচনা করছেন। পূর্ব পাশে ছোট হাউস, দক্ষিণে একটা ফোরকানিয়া মাদ্রাসা। মসজিদের ধাঁচ ভিন্ন, দু’দেয়াল পার হয়ে মেহরাব; মানে সারিবদ্ধ তিনটি কক্ষ! অন্ধকারের কারণে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না মেহরাবটা। তাছাড়া এর কেঁচি গেইট ও থাই দরজায় তালা দেয়া। একটু পর বয়স্ক এক লোক এলে, তারা তাঁর পিছনে পিছনে মেহরাব কক্ষে ঢুকল। কী সুন্দর এর গঠন শৈলী! সিফাত জিজ্ঞেস করল, 

—চাচা, এ মসজিদ তো অনেক পুরোনো, এর নির্মাণ সাল কত? 

—হ হাঁচাই কইচ, আমরা হেই ছোটকাল থেইকা এনে আছি। বাইরে লেখা আছে উনিসসো সাল কত যেন। এমনই অইব, দেইকা আহ গিয়া। তোমরা কি এ মসজিদ দেখার লাইগা আইছনি? দেহ, দেহ, লগে সবি-টবি তুইলাও নিও। 

তারা পুরো মসজিদ ঘুরে দেখল, বেশ মুগ্ধও হলো। মূল বৈশিষ্ট্যই যেন, ‘চিনিটিকরির কারুকাজ’। এরপর বের হয়ে সামনে চলে এলো, বিশাল দেয়ালজুড়ে এর কারুকার্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যা যে কাউকেই বিস্মিত করবে। নিচে রাস্তার সাথে লাগোয়া এর নামফলক ও স্থাপন সাল ‘কাস্বাবটুলী জামে মসজিদ, স্থাপিত ১৩৩৮ হিজরী’। ছাদবিহীন এ মসজিদের প্রতিটি পিলারের মাথায় গম্বুজ। মূল অংশের ছাদে তিনটি গম্বুজ, মাঝের গম্বুজটি বড় আর দু’পাশে মাঝারি। এছাড়া চার কোণায় একই ধরনের কারুকাজের চারটি বুরুজ। মসজিদটি ১৯০৭ সালে নির্মিত হয়। ১৯৭৯ সালে কারুকার্যে কোন পরিবর্তন না করে মসজিদটি সংস্কার করা হয়।


 

২.

এবার তারা চকবাজারের দিকে হাঁটতে লাগল। আরমানিটোলা এলাকার আবুল খায়রত রাস্তা দিয়ে চলার সময় অসংখ্য মসজিদ ও পুরোনো বাড়ি তাদের চোখে পড়ল। এখানে ‘একশ টাকা’ নোটের ওই ‘তারা মসজিদ’টা অবস্থিত। এটাও রাস্তার পাশে এক সরু গলির ভিতর। দুপুরের কড়া রোদ মাথার ওপর, তারা মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে ভিতরে প্রবেশ করল, এ মসজিদের গঠনও কাশাবটুলীর মতো, মোঘল স্থাপত্য শৈলীর প্রভাব রয়েছে এতে। প্রবেশের পর মাঝে দু’দেয়াল পেরিয়ে মেহরাব। পুরো মসজিদের দেয়াল জুড়ে অসাধারণ নকশা, বিশেষভাবে আকর্ষণ করে তারার শিল্পকর্ম; গম্বুজসহ দেয়ালগাত্রে অসংখ্যা তারা। এজন্যই এর নামকরণ হয় ‘তারা মসজিদ’ হিসেবে। নকশা করা এই পদ্ধতির নাম ‘চিনি টিকরি’। তারা ঘুরে ঘুরে দেখার পর এক জায়গায় বসে গেল। মসজিদের গায়ে এর নির্মাণ-তারিখ খোদাই করা ছিল না। আদিতে মসজিদটি ছিল তিন গম্বুজঅলা, পরে সংস্কারের সময় পাঁচ গম্বুজ করা হয়।


 

৩.

এরপর আরমানিটোলা রাস্তা অতিক্রম করে চকবাজারের রাস্তায় ঢুকল। মোড় থেকে শায়েস্তা খানের মসজিদটা দেখা যাচ্ছে। আশপাশের আধুনিক সভ্যতার দাপটে বোঝার উপায় নেই, মাঝের মসজিদটি শতাব্দীপুরানো। সবাই ডাকে চক মসজিদ নামে। এতটা পথ হেঁটে ক্লান্ত হয়ে তারা দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য ছোট এক হোটেলে ঢুকল। কিছু খেয়ে চকবাজারের বা একসময়ের ঢাকার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে প্রবেশ করল। মোঘল আমলে চক মসজিদই ছিল ঢাকার কেন্দ্রীয় মসজিদ। যেখানে নামাজ আদায় করতেন আমীর ওমারাগণ। এ পাশের রাস্তায় দু’টি প্রবেশ পথ। প্রথমটা বন্ধ থাকায় তার পরেরটা দিয়ে তারা ভিতরে প্রবেশ করল। মসজিদটির মূল অবকাঠামো মাটি থেকে প্রায় দশ ফুট উঁচুতে, এক বিশাল মসজিদ! মোঘল আমলের বেশ কিছু কারুকাজ বহু সংস্কারের পরও দৃষ্টিআকর্ষণ করছে। এটাও অন্যান্য মসজিদের মত; কয়েকটি খিলান পেরিয়ে ভিতরে বিশাল মসজিদ তবক ও সুদৃশ্য মেহরাব। একজন খাদেম ঝাড়ু দিচ্ছে তাই তারা মেহরাবের সামনে গেল না। পুরো মসজিদ প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। নিচের তলা ঘুরে তাদের মনে হলো, এ মসজিদ এর কাঠামো অন্য মসজিদের মতো না। খুবই ভালো লাগল এগুলো, জুতোজোড়া নিচতলায় রেখে ওপরে গেল; দোতলা বন্ধ, তিন তলায় উঠল তারা। এরপর ছাদ, খোলা পেয়ে উঠে গেল, বড় মিনারটা কাছ থেকে দেখে অবাক হলো, তাছাড়া আরো কয়েকটি ছোট-বড় মিনার যা থেকে পাঁচ ওয়াক্তে ভেসে যায় মুয়াজ্জিনের আহ্বান। ছাদের পশ্চিম প্রান্তে বড় একটা শাহী গম্বুজ, এর দু’পাশে একটুছোট দু’টি গম্বুজ। এগুলোর গায়েও মোঘল নিদর্শন স্পষ্ট। বেশ কিছুক্ষণ ছাদে থাকার পর নিচে নেমে এলো। বের হওয়ার জন্য জুতা নিতে গিয়ে সিফাত দেখল নিচতলায় দরজা লাগানো। বুঝতে পারল না, কি করবে? এক বৃদ্ধকে গিয়ে বললে উনি সামনের দরজা দিয়ে না ঢুকে পাশের এক দরজা ঠেলে প্রবেশ করলেন। সিফাত জিজ্ঞেস করল, 

—চাচা, এ মসজিদ তো বহু পুরোনো; তো এর প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে কোন তথ্য নাই? 

—হ আচে তো, দেহ এইটাতে সব লেখা আচে। 

প্রবেশপথের পর একটু এগিয়ে দক্ষিণ পার্শ্বে একটা শিলালিপি টাঙানো। ফার্সি ভাষায় শিলালিপিটিতে লেখা আছে, “সঠিকভাবে পরিচালিত আমীর আল উমরা শায়েস্তা খান, স্রষ্টার জন্য এ মসজিদ নির্মাণ করেছেন। সন্ধানী (তালিব) এর তারিখ অনুসন্ধান করলে— আমি বলেছিলাম, ‘স্রষ্টার আদেশ কার্যকর হয়েছে, ১০৮৬ হিজরি (১৬৭৫ - ৭৬ খ্রিস্টাব্দ) বছর।’ ধারণা করা হয়েছে যে শায়েস্তা খান নিজেই খোদাই করা শিলালিপিটি রচনা করেছিলেন, কারণ তাঁর কাব্যিক ছদ্মনাম ছিল ‘তালিব’। মোঘল রীতিতে ঈদের চাঁদ দেখা দিলে এ মসজিদের সামনে থেকেই দেওয়া হতো তোপধ্বণি। রমজান মাসে তারাবির নামাজের সময় কিংবা বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে মসজিদটি ঝাড়বাতির আলোয় আলোকিত হতো। ইফতারির সময় বিভিন্ন বাড়ি ও দোকানপাট থেকে ইফতারি আসত।

জুতাজোড়া নিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল মসজিদ থেকে। সিফাত বলল, এখান থেকে হেঁটে গুলিস্তান যাবে। হাসান রাজিও হল। তারা হাঁটতে শুরু করল, আর দু’কিলো হাঁটলেই গুলিস্তান, যেখান থেকে বাসায় যাওয়ার বাস পাবে। গল্প করতে করতে তারা পথ চলছে, পথমাঝে পুরান ঢাকার শতবর্ষী স্থাপনাগুলো দেখছে। কি যেন মনে হাসান রিকশা ডাক দিল, পরক্ষণে দাম-দর করে চড়ে বসল তাতে। চলার সময় সিফাত রিকশাওয়ালাকে বলল, 

—‘হোসাইনী দালান’টা এখানে না? 

—হ, এই তো বামের গলি দিয়ে সামনে আগাইলেই এর দেখা পাবেন। 

হাসানকে বলল, তুই রিকশাটা ডাক না দিলে তো এখান থেকেও ঘুরে যেতে পারতাম। এটা ঐতিহাসিক একটা স্থাপনা। হাসান বুঝতে পারল না, কী এটা? সিফাত বুঝিয়ে বলল, এটা শিয়াদের প্রার্থনাগাহ। মোগল শাসনামলে সতের শতকে নির্মিত। রিকশা এগোতে থাকল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্যাম্পাসের সামনে দিয়ে। এ রাস্তা খুবই সুন্দর। কিছুক্ষণ পর গুলিস্তানের এক মোড়ে থামল। ভাড়া পরিশোধ করে রাস্তা পার হলো তারা, সেখান থেকে বাস ধরল বাসায় ফেরার।

সমাপ্ত...

Comments

    Please login to post comment. Login