---
শিরোনাম: মেঘমালা এবং রোদ্দুর
পর্ব ১৩: শিক্ষার নতুন দিগন্ত
মেঘমালা আর রোদ্দুর, তাদের জীবনের পথে অনেক বাধা এসেছে। কিন্তু তারা কখনো হাল ছাড়েনি। তাদের ভালোবাসা ছিল একে অপরের জন্য, তবে তাদের ভালোবাসা শুধু নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি গ্রাম ও সমাজের জন্যও ছিল। তাদের ভালোবাসা ছিল অমলিন, যেখানে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর শক্তি ছিল। এই অনুভূতি তাদের মধ্যে এক অদম্য শক্তির জন্ম দিয়েছিল।
গ্রামের স্কুলটি বহুদিন ধরে অবহেলিত ছিল। জানালার কাচ ভেঙে গিয়েছিল, বেঞ্চগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। এক সময় যেখানে হাসির রোল বেজে উঠতো, সেখানে এখন শুধুই নিঃসঙ্গতার নীরবতা। গ্রামের বাচ্চারা, যারা ভবিষ্যতের সম্ভাবনা হয়ে উঠতে পারত, তারা শিক্ষার আলো থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল।
রোদ্দুর আর মেঘমালা এই পরিস্থিতি বদলাতে চাইল। তাদের মধ্যে গভীর প্রেম ছিল, তবে তারা জানত, শুধু নিজেদের ভালোবাসাই তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়নি, তারা তাদের গ্রামও ভালোবাসতো, তাদের ভবিষ্যৎকে আলোকিত করতে চাইছিল। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিল, স্কুলের সব পুরনো কষ্ট মুছে নতুনভাবে সাজাবে।
রোদ্দুর মেঘমালার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই জানিস, তোর সঙ্গে থাকতে আমি কি অনুভব করি? শুধু আমি তো একা কিছুই করতে পারব না। আমাদের ভালোবাসা, আমাদের যৌথ প্রচেষ্টা যদি এই স্কুলের ভবিষ্যত বদলে দিতে পারে, তবে আমাদের সবকিছুই অর্থবহ হয়ে উঠবে।"
মেঘমালা তার চোখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, “আমার এই বিশ্বাস তো তোর কাছ থেকেই এসেছে, রোদ্দুর। আমি জানি, তুই আমার পাশে থাকলে আমরা সবকিছু পারব।”
তাদের পরিকল্পনা শুরুতেই কিছু মানুষের প্রশংসা পেল, কিন্তু অনেকে দ্বিধা প্রকাশ করল। কেউ বলল, “এই গ্রামে খাওয়ারও জোগাড় নেই, কীভাবে স্কুল চালাব?”
মেঘমালা ধৈর্য সহকারে বলল, “যতটুকু আছি, তাতেই শুরু করব। ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিক হবে। যদি আজ আমরা কিছু না করি, তাহলে আমাদের বাচ্চারা কীভাবে ভালো থাকবে?”
তারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে সাহায্যের আবেদন করল। কেউ সামান্য অর্থ দিল, কেউ দিল পুরনো আসবাব। কিছু মানুষ বিরক্ত হয়ে বলল, “নিজেদের জীবন ঠিক করো আগে, গ্রামের দায় নেবে কেন?”
মেঘমালা হতাশ হয়নি। সে গ্রামের মহিলাদের নিয়ে একটি ছোট দল গঠন করল, যারা নিজ হাতে জিনিস তৈরি করে বিক্রি করতে শুরু করল। সারা গ্রাম এক হয়ে গেল, যেন তারা সবাই একটি একক পরিবারের অংশ হয়ে উঠেছে।
তাদের পরিকল্পনা চলার সময় হঠাৎ একদিন গ্রামে টানা তিনদিন ভারী বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। রাস্তা ভেসে গেল, বাড়ির চাল ভেঙে পড়ল। রোদ্দুর একদল যুবক নিয়ে গ্রামে আশ্রয়হীনদের সাহায্য করতে লাগল। মেঘমালা মহিলাদের সঙ্গে রান্নার আয়োজন করে, যাতে সবাই খেতে পারে।
রোদ্দুর মেঘমালাকে একটি ছোট স্থান থেকে ডাকল, “আমাদের মধ্যে যদি এমন সম্পর্ক না থাকতো, আমাদের প্রেম যদি এত মধুর না হতো, তবে কি আমরা একসঙ্গে এই কাজগুলো করতে পারতাম?”
মেঘমালা রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “তোর পাশে থাকলে আমি শক্তি পাই। তুই যে সময়গুলোতে আমাকে সাহস দিয়েছিস, সেই মুহূর্তগুলোই আমাকে নতুন উদ্যম দিয়েছে। আমাদের ভালোবাসা আমাদের গ্রামকেও নতুনভাবে আলোকিত করবে।”
বৃষ্টির পর পঞ্চায়েত প্রধান রোদ্দুর ও মেঘমালার কাজ দেখে বললেন, “তোমরা এত মানুষের পাশে দাঁড়ালে, তাতে আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু স্কুলের কাজ এখনো বাকি। এটা কি তোমরা শেষ করতে পারবে?”
রোদ্দুর দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমরা কথা দিয়েছি, তাই এটা শেষ করব। আপনারা শুধু আমাদের উপর বিশ্বাস রাখুন।”
মেঘমালা তার মহিলাদের দল নিয়ে কাজ চালিয়ে গেল। এক মাসের মধ্যে স্কুলের নতুন ভবন তৈরি হলো। উদ্বোধনের দিন পঞ্চায়েত প্রধান ঘোষণা দিলেন, “আজকের দিন থেকে এই স্কুলের নাম হবে ‘মেঘমালা-রোদ্দুর শিক্ষা কেন্দ্র’। এই দুজন আমাদের দেখিয়েছে, ভালোবাসা শুধু নিজের জন্য নয়, সবার জন্য হতে পারে।”
রোদ্দুর মেঘমালার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “তুই কি জানিস, তোর সাহস আর উদ্যোগ ছাড়া এটা কখনো সম্ভব হতো না?”
মেঘমালা হাসল, “তুই পাশে ছিল বলেই আমি সাহস পেয়েছি। আমাদের লড়াই এখনো শেষ হয়নি। গ্রামে এখনো অনেক কিছু করার বাকি।”
রোদ্দুর বলল, “তাহলে আমরা একসঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাব। যত বাধাই আসুক, আমরা এই গ্রামের মুখ বদলাব।”
এভাবেই, মেঘমালা আর রোদ্দুরের সাহসিকতা গ্রামকে একটি নতুন দিশা দেখাল। কিন্তু এটাই ছিল শুধুমাত্র তাদের পথচলার শুরু। তাদের ভালোবাসা, যা একে অপরের প্রতি ছিল, তা গ্রামের প্রতিটি কোণে আলো ছড়িয়ে দিল, এবং এই ভালোবাসা ভবিষ্যতের প্রতিটি পদক্ষেপে শক্তির উৎস হয়ে উঠল।