মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশ। তার আবার চারটা প্রদেশ লাগবে! সংসদের উচ্চকক্ষ-নিম্নকক্ষ লাগবে! এইগুলোর নাম রাষ্ট্র সংস্কার? রাষ্ট্র মেরামত? নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত?
দেশের পুরোনো চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার সুপারিশের কথা ভাবছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের ব্যবস্থাপনা প্রদেশের হাতে দেওয়ার পক্ষে এ কমিশন।
১৯ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে পরিবেশিত 'দেশে চারটি প্রদেশের কথা ভাবছে কমিশন' শীর্ষক সংবাদে জানিয়েছে, গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশনসংক্রান্ত সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা না দিলেও ওই অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা তাঁদের সম্ভাব্য কিছু সুপারিশের কথা তুলে ধরেন। এর মধ্যে চারটি প্রদেশ করার বিষয়টিও রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ওই সংবাদে আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন ‘রাষ্ট্র মেরামতের এখনই সময়’ শীর্ষক লেখায় পাঁচটি প্রদেশ করার প্রস্তাব করেন। প্রথম আলোতে প্রকাশিত এ লেখায় পাঁচ প্রদেশের কাজ কী হবে, সেই ধারণাও দেন তিনি। বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে অষ্টম বৃহত্তম দেশ। জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি। ছোট দেশ হলেও এত বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে সরকারকে নিয়ে যেতে হলে বাংলাদেশকে ন্যূনতম পাঁচটি প্রদেশে ভাগ করে একটি ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র করা যেতে পারে। পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে দুটি করে চারটি প্রদেশ ও বৃহত্তর ঢাকা নিয়ে আরেকটি প্রদেশ। মেট্রোপলিটন ঢাকা কেন্দ্রশাসিত থাকবে। কেন্দ্রের হাতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, সীমান্ত ও সমুদ্রনিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ ও বৈদেশিক সাহায্য-সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো থাকবে। বাকি বিষয়গুলোতে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধান থাকলেও প্রদেশগুলো ব্যবস্থাপনায় থাকবে।
স্থানীয় শাসনবিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমি সাধারণভাবে আমার লেখায় যেটা বলার চেষ্টা করেছি এবং এখনো মনে করি, সেটা হচ্ছে ভৌগোলিকভাবে এই দেশটা একটা ছোট দেশ। মানুষ হয়তো বেশি। তবে ভাষাগত, ভৌগোলিক অবস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো বিভাজন নেই। আমি মনে করি, বর্তমানে যেসব বিভাগ আছে এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করলে এবং এখানে ভালো কাজ করার ক্ষমতা দিলে প্রদেশের ঝামেলা না গেলেও চলে। প্রদেশ সমস্যা সমাধানের চেয়ে নতুন করে কিছু সমস্যার সৃষ্টি করবে।’
বস্তুত ৩৫০ জন জাতীয় সংসদ সদস্য ও ৩০-৩৫ জন মন্ত্রীর ভারেই যেখানে জাতি ভারাক্রান্ত, সেখানে আরও ৫০-৬০ জন মন্ত্রী ও ৫০০ সংসদ সদস্যের বিপুল বোঝা বহন করবার সক্ষমতা এই জাতির থাকতে আছে? এমনিতেই রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা চরমে, তার ওপর ক্ষমতা ও পদ-পদবীর বাড়াবাড়ি উত্তেজনার পারদ চড়িয়ে দেয়া ছাড়া ভিন্ন কোনো ফায়দা নাই।
আমাদের ভাষা, ধর্ম ও ভূগোল প্রায় এক। কেবলমাত্র নৃগোষ্ঠীগুলোর আচার আলাদা। পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের জন্য আলাদা পরিষদ করে দেয়া হয়েছে, সেটা সামলাতেই সরকার হিমশিম খায়। স্থিতিশীলতা রাখতে পারে না। তার ওপর প্রদেশে ভাগ করে দেয়ার পর কেউ যখন স্বায়ত্তশাসন এবং ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতা চেয়ে বসবে সেই জ্বালা কে সামলাবে?
কাজেই আমরা যেকোনো প্রকার প্রদেশের ঘোরতর বিরোধী। দেশ ভেঙে দেয়ার দুর্মতি ছাড়াও এই রাষ্ট্রের সংস্কৃতি বদলানোর অনেক কাজ আছে। ফেডারেল শাসন ব্যবস্থায় যাওয়ার মতো শক্তি ও সামর্থ্য আমাদের নেই। ৮ বিভাগের ৬৪ জেলাকে একীভূত থাকতে দিন। খামোখা আর বিভাগ বাড়ানোরও দরকার নাই। ভাগ-বিভাগে বিভাজন বাড়ে। ওসবে মন না দিয়ে ১৭ কোটি মানুষের জন্য কিভাবে আর্থ-সামাজিক মুক্তি নিশ্চিত করা যায় সেটা নিয়ে কাজ করেন।
১৭ কোটি জনতার ওপর ১২ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট বসিয়ে ১২ লাখ সরকারি কর্মীর জন্য মহার্ঘ ভাতা বাবদ খরচ করতে চাইছেন ৭ হাজার কোটি টাকা।
এমন দুর্মর বুদ্ধি নিয়ে আপনারা আসছেন দেশ ভাগ করতে! এটা এক বাংলাদেশ। এর কোনো প্রদেশ নাই। প্রদেশের নাম নিয়ে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার এজেন্ডা থেকে এখনি সরে আসুন। মানুষকে স্বস্তিতে থাকতে দিন।
লেখক: সাংবাদিক
১৯ জানুয়ারি ২০২৫
25
View