২০১৭ সালের ছবি ছাপিয়ে বাঙালি ফেসবুক বিচারকেরা বলে দিচ্ছেন, ৭৮ বছর বয়সী ডোনাল্ড ট্রাম্প বাইবেলে হাত রেখে ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন। ২০২৫ সালের ছবিতে দেখা গেছে মিস্টার ট্রাম্প পবিত্র বাইবেলের ওপর হাত রাখেননি। যদিও তাঁর স্ত্রী মিজ মেলানিয়া স্বামীর পাশেই বাইবেল হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার আগে রেওয়াজ অনুযায়ী সব প্রেসিডেন্টই প্রথমে চার্চে যান। এমনকি ব্যক্তিগত জীবনে বিশ্বাসের জায়গা থেকে কেউ যদি নৈধার্মিকও থাকেন, চার্চে যেতে তার বাধা কিংবা দ্বিধা নেই। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেখানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী সেখানে তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধকে সম্মাননা জানানো শাসকের সৌজন্যতা ও বদান্যতা। এর অর্থ এটা দাঁড়ায় না যে, শাসকের নিজেকে স্বীকৃতি দিয়ে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী হতে হবে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট শপথ গ্রহণের সময় একটি নির্দিষ্ট শপথবাক্য পাঠ করেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ২ অনুচ্ছেদের ধারা ১-এ উল্লেখ রয়েছে। শপথবাক্যটি হলো:
"I do solemnly swear (or affirm) that I will faithfully execute the Office of President of the United States, and will to the best of my ability, preserve, protect, and defend the Constitution of the United States."
বাংলায় অনুবাদ করলে এর অর্থ দাঁড়ায়:
"আমি solemnly শপথ করছি (অথবা ঘোষণা করছি) যে, আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব সৎভাবে পালন করব এবং আমার সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সংরক্ষণ, সুরক্ষা এবং প্রতিরক্ষা করব।"
পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে, শপথবাক্যে ধর্ম, পবিত্র বাইবেল অথবা মহান ঈশ্বরের কোনো বাণী বা শ্লোক নেই। এমনকি ঈশ্বরের নাম নিয়েও শপথ নিতে হয় না।
গেল ২০ জানুয়ারি ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলে প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন জেডি ভ্যান্স। তাঁকে শপথ পড়ান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ব্রেট কাভানা। বাইবেলের ওপর হাত রেখে শপথ নেন জেডি ভ্যান্স। বাইবেল ধরে রেখেছিলেন স্ত্রী উষা ভ্যান্স।
এরপর ট্রাম্পকে শপথ পড়ান যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস। তাঁর স্ত্রী মেলানিয়া বাইবেল ধরে ছিলেন। শপথ শেষ হওয়ার পরপর তোপধ্বনিতে সম্মান জানানো হয় নতুন প্রেসিডেন্টকে। শপথ অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন ক্যারি আন্ডারউড ও ক্রিস্টোফার ম্যাকিও।
এর আগে ট্রাম্প ও মেলানিয়া প্রথমে যান ওয়াশিংটনে সেন্ট জনস এপিস্কোপাল চার্চে। এটি মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভিষেক রীতির অংশ। এ সময় সেখানে ছিলেন ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, সুন্দর পিচাই, টিম কুকসহ প্রযুক্তি অঙ্গনের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা। চার্চে আনুষ্ঠানিকতা শেষে ট্রাম্প ও মেলানিয়া যান হোয়াইট হাউসে।
নিজের অভিষেকের দিনকে ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ট্রাম্প। ঠিক আমাদের গণ-আন্দোলনে বিজয়ী পক্ষ এখন যেমনটা বলেন। নির্বাচনী প্রচারের সময় আততায়ীর হামলার কথা উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেছেন, আমেরিকাকে অবার মহান করে তুলতে সৃষ্টিকর্তা তাঁর জীবন বাঁচিয়েছেন। একদম আমাদের বিগত সরকার প্রধান বারবার যেমনটা বলে চলেছেন। এই জায়গাটিতে আমাদের সাথে দারুণ মিল।
সে যাই হোক। ২০১৭ সালে সুস্পষ্টভাবে পবিত্র বাইবেলের ওপর হাত রেখে শপথ নিলেও এবার কেন অন্যথা হলো? এটা নিয়ে খোদ আমেরিকাতেও আলোচনা হচ্ছে। একপক্ষ ২০১৭ দিয়ে ২০২৫কে রিপ্লেস করছেন। অপরপক্ষ দুই হাজার পঁচিশের ক্লিয়ার ছবি দেখিয়ে বাইবেলে হাত না থাকার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছেন। বাস্তবতা হলো হাত রাখা না রাখা গুরুত্বপূর্ণ নয়। শপথ অনুষ্ঠানে বাইবেল ছিল মানে ধরে নিতে হবে ওই ধর্মগ্রন্থে হাত রেখেই প্রেসিডেন্ট শপথ নিয়েছেন। তাতে কী হয়েছে? অন্যধর্মের অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে? মন বড় থাকলে সেটি ভাববার আদৌ সুযোগ নাই।
বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে এই বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন প্রেসিডেন্সিয়াল স্কলার ও অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক জেরেমি সুরি। তিনি বলেছেন, “সংবিধানে এমন কোনো কিছু উল্লেখ নেই যে, প্রেসিডেন্টকে শপথের সময় ইশ্বরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে। শপথ হলো সংবিধানের ওপর। আমি মনে করি না বাইবেলে হাত না রাখায় এটির কোনো মূল্য আছে। সংবিধান অনুযায়ী আপনি শপথ বাক্য অথবা প্রত্যায়নপত্র পাঠ দুটোই করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা ধর্মে নাস্তিকদের জন্যও শপথের ব্যবস্থা রেখেছে।”
আমেরিকার শাসকেরা পবিত্র বাইবেলে হাত রেখে সৎভাবে দায়িত্ব পালন করা এবং প্রেসিডেন্টের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে সংবিধান সমুন্নত রাখবার শপথ নেন। আমাদের দেশের শাসকেরাও বায়তুল মোকাররম মসজিদে গিয়ে পবিত্র কুরআনে হাত রেখে শপথ নিতে পারেন। কিন্তু আমেরিকার মতো বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক পরিবেশ সমুন্নত রাখা, ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে বিভাজিত না করা এবং নানা ছুতোয় বৈষম্য জিইয়ে রাখবার ফন্দি না আটার সাথে আমরা মিলিয়ে চলতে পারব তো? আমাদের এখানে সততা বলে কিছুই আর অবশিষ্ট নাই। আর সংবিধান ৫০ বছরও টেকসই না। কাজেই আমেরিকার হাতের সাথে না মিলবে আমাদের হাত। মার্কিনিদের মনের সাথে না হবে আমাদের মহব্বত।
যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করে ১৭৭৬ সালে। স্বাধীনতার প্রায় ১১ বছর পর ১৭৮৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গৃহীত হয় নতুন মার্কিন সংবিধান। দেশটা ওই সংবিধান মোতাবেকই এখনও চলছে। আর আমাদের স্বাধীনতা লাভের পর বাহাত্তরে ঘোষিত সংবিধানের অবস্থা এখনই নড়বড়ে। সুতরাং ইউএস প্রেসিডেন্টের সাথে আমাদের মহারাজাদের মেলাতে যাবেন না। শেষে গণতন্ত্রের নাম দেবেন কী? মার্কিন-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনা?
লেখক: সাংবাদিক
২২ জানুয়ারি ২০২৫