নীল রঙা এক শীতের সকালে পৃথিবীতে এসেছিল নিঝুম। তার বাবা-মা দুজনেই ছিলেন স্কুল শিক্ষক। ভালোবাসায় ভরা ছিল তাদের ছোট্ট সংসার। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, নিঋুম মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবা-মাকে হারায় একটি সড়ক দুর্ঘটনায়। সে দিনটিই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার দিন।
নিঝুম তখনো বুঝত না জীবন কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে। পাড়ার এক দয়ালু পরিবার তাকে আশ্রয় দেয়, কিন্তু সেই পরিবারের অবস্থাও ছিল খুব সাধারণ। তাদের গরিবি তাকে নতুন করে জীবনের অর্থ শিখিয়েছিল। খাবার, পোশাক বা খেলনা—এগুলো তার জীবনে তেমন গুরুত্ব পায়নি। সে শিখেছিল ছোট ছোট জিনিসের মধ্যে আনন্দ খুঁজে নিতে।
তবুও, নিঋুমের চোখে স্বপ্ন ছিল অগাধ। তার মা বলতেন, "স্বপ্ন দেখো, কিন্তু তার পেছনে ছুটতেও শিখতে হবে।" এই কথাগুলো যেন তার জীবনের মন্ত্র হয়ে গেল।
নিঝুম দিনে স্কুলে যেত, রাতে পড়ত মোমবাতির আলোয়। পড়ার খরচ চালানোর জন্য টিউশন পড়ানো শুরু করল। অনেকেই বলত, "তুমি এতটুকু মেয়ে, এত বড় স্বপ্ন দেখা কি ঠিক?" কিন্তু তার স্বপ্নকে ভাঙার সাহস কারো হয়নি।
নিঋুমের সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ছিল বিজ্ঞান। সে চেয়েছিল বড় হয়ে একজন গবেষক হবে, এমন কিছু আবিষ্কার করবে যা মানুষের জীবন বদলে দেবে। বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে তার তৈরি করা ছোট্ট প্রজেক্টগুলো দেখে শিক্ষকরা মুগ্ধ হতেন।
একদিন স্থানীয় একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সে প্রথম পুরস্কার জেতে। সেই প্রতিযোগিতার বিচারক একজন বিখ্যাত অধ্যাপক, যিনি তার মেধা দেখে তাকে আরও পড়াশোনার সুযোগ করে দেন। স্কলারশিপ পেয়ে সে ঢাকায় এক ভালো কলেজে ভর্তি হয়।
কঠিন পরিশ্রম আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কলেজ শেষে সে বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়। তার গবেষণা সারা বিশ্বের নজর কাড়ে, আর সে এমন কিছু প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে যা দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জীবন সহজ করে তোলে।
নিঝুম কখনো ভুলেনি তার সংগ্রামের দিনগুলো। বড় হওয়ার পর সে একটি তহবিল গড়ে তোলে, যেখানে দুঃস্থ শিশুদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। তার মনে ছিল বাবা-মায়ের শেখানো মূল্যবোধ—"মানুষের জন্য কাজ করাই জীবনের আসল সার্থকতা।"
নিঝুমের জীবন ছিল এক দুঃখ আর স্বপ্নের কোলাজ। বাবা-মায়ের স্মৃতির আলোয় আর নিজের চেষ্টায় সে অন্ধকারকে পেছনে ফেলে জীবনকে আলোকিত করে তোলে। জীবন যত কঠিনই হোক, ইচ্ছাশক্তি আর মূল্যবোধ থাকলে সবকিছু জয় করা সম্ভব।