‘চিঠি’ নামের ছোট্ট শব্দটা যেন এক বিশালতাকে ধারণ করে। কাগজের বুকে হাতে লিখে কতসব খবরাখবর চালাচালি করা হয়। আচ্ছা ‘হয়’ বলছি কেন! এখন কি আর কেউ কাজল টানা দুটোচোখ পিটপিটিয়ে ন্যাকাবোকা আব্দার করে 'চিঠি লিখো প্রতিদিন, নইলে থাকতে পারবো না।' মরণ! ব্যস্ত এই সময়ে জগত সংসারে আর বুঝি কোনো কাজ নেই। সব ফেলে প্রতিদিন চিঠি লিখতে বসবে তোমায়। পুলুপিসি একথা শুনলে ঠিক এমনটাই বলতেন এটা নিশ্চিত। পুলুপিসিটা কে চেনা গেল না তো? না বললে কে আর কাকে চেনে বাপু। পুলুপিসি হলেন সেই আমলের পাঠশালায় যাওয়া রিঙ্কুদির পিসি। ব্যাপক জাদরেল এক মানুষ। ক লিখতে যিনি খগের তৈরি ক'খানা কলম ভেঙেছেন হিসেব নেই। সে গল্প কত্তবার যে শুনেছি। পিসির স্বামী ব্যবসার কাজে প্রায় প্রায় বার্মা যেতেন। বার্মা থেকে তিনি স্ত্রীর নামে সংসার খরচের টাকাও পাঠাতেন। সেবারও গেছেন। কিন্তু বহুদিন তার কোনো পাত্তা নেই। এদিকে ঘরে চাল বাড়ন্ত। শ্বশুর-শাশুড়ি, দুটো দেবর ননদ, নিজের একটি বাচ্চা নিয়ে পিসি দিশেহারা। সময় মতো টাকা না পাঠালে অবস্হা কেরোসিন। অনেক ভেবেচিন্তে শাশুড়ির পরামর্শ মতো স্বামীর উদ্দেশ্যে আকার একার জ্ঞানহীন পুলুপিসী একখানা পত্রবাণ করলেন -- ‘পয় সম পর সমচর এই য টক পঠল তড়তড় পঠ ন পঠল ভত মরণ(প্রিয় স্বামী, পর সমাচার এই যে, টাকা পাঠালে তাড়াতাড়ি পাঠাও, না পাঠালে ভাতে মরণ) ।' পুলুপিসীর বেচারা স্বামী চিঠির মর্মোদ্ধারে কতটা খাবি খেয়েছিলেন সে কথা জানা নেই।
সব কথা সব সময় আবার অজানাও থাকে না। কিছু কথা ধাইধাই করে বাতাসে হাত পা ছুঁড়ে চাউর হয়ে যায়। যে হ্যাঁ, ঘটনা একখানা ঘটেছে বটে। নইলে এত এত সাবধানতা সত্ত্বেও পাড়ার লোটাস ভাইয়া আর ফাতেমা আপুর মধ্যে নীরবে চিঠি চালাচালির ঘটনাটা জানাজানি হয়ে গেল কীভাবে!
লোটাস ভাইয়ারা আমাদের তিনতলায় থাকতো। ফাতেমা আপুরা নিচতলায়। আমরা স্যান্ডউইচের পুরের মতো মাঝখানটাতে, অর্থাৎ দোতলায়। যে কারণে ওই দুজনার চিঠি চালাচালির অভিনব ব্যাপারখানা আমারও চোখে পড়েছিল বটে। যদিও সেগুলো যে চিঠি, সে তথ্যটা পরে জানতে পেরেছি। তপুর মাধ্যমে। তপুটা জেনেছে লিখন মামার কাছ থেকে।
প্রথম দিকে তিনতলা থেকে দলাপাকানো কাগজ ফেলে পরিবেশ নোংরা করার বদভ্যাসের জন্য লোটাস ভাইয়াকে মনে মনে কষে বকা দিতাম। আর ফাতেমা আপুকে ধন্যবাদ। লোটাস ভাইয়ার মতো চৌকস একটা ছেলের একি ব্যবহার। ভাইয়া শুধু পড়াশোনায় ভালো ছিল তা নয়। খুব ভালো গাইতো। গিটার বাজাতো। কাগজ দলা পাকিয়ে নিচে ছুঁড়ে ফেলার আগে আগে তার গলায় সুর উপচে উপচে পড়তো। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করতাম দলা পাকানো কাগজের গোল্লাটা পড়া মাত্রই ফাতেমা আপু এসে হাজির হতো। আর কাগজটা তুলে নিতে নিতে নিক্ষেপকারীর উদ্দেশে বলতো, হচ্ছেটা কী! বাড়িতে ট্র্যাশবীন নেই? সমাজ বিজ্ঞান পড়াটড়া হয়নি বুঝি! মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের একজন ছাত্রের উদ্দেশ্যে ওই কথা শুনে হাসিই পেতো। ফাতেমা আপুটা খুব বোকা, তাই ভাবতাম। ওদের ভেতরের প্রাণরসায়ন(নাকি প্রেমরসায়ন!) বিজ্ঞানটা জানলে কী আর অমন বোকাটে ভাবনায় ভাসতাম!
লোটাস ভাইয়া আর ফাতেমা আপুর প্রেমরসায়ন ক্লাসের প্রশ্নপত্র ফাঁস হলো লিখন মামার মাধ্যমে। কতটা চেপে ব্যাডমিন্টনের শাটল বা কর্কটা মারলে প্রতিপক্ষ থতমত খাবে, সেসব কৌশল আমাদের শেখাতেন লিখন মামা। ববির ছোটো মামা তিনি। দারুণ একেকটা শট খেলতেন লিখন মামা। খেলা শেষে প্রায় প্রায় ক্যান্ডি, বাদাম, চিপস, ইত্যাদি খাওয়াতেন আমাদের। সেইসাথে আশেপাশের বাড়ির কার হাড়িতে কেমন খিচুড়ি পাকছে তার তথ্য তালাশ করতেন। বিশেষ করে অমুক তমুক আপুদের বিষয়ে তার খুব খেয়াল ছিল। আমাদের পাড়ার স্বঘোষিত ছোটোখাটো সমাজ সেবক তিনি। তবে যাদের বাড়িতে সমবয়সী বোন ছিল না তাদের তেমন পাত্তা দিতেন না কেন জানি। তপু আর আমাকে ব্যাপক খাতির করতেন। খাতিরের রহস্য তিন গোয়েন্দায় আসক্ত তপুই আবিষ্কার করেছিল একসময়। এই নিয়ে নিজেরা নিজেরা ব্যাপক হা হা হি হি করতাম আড়ালে।
তো সেই লিখন মামা, লোটাস ভাইয়ের ছুঁড়ে ফেলা কাগজের দলা কব্জা করার দায়িত্ব আমাদের দিলেন। আমাদের বাড়ির ঠিক সামনের বাড়িটাই তপুদের। আমরা দুজনে পাকা গোয়েন্দার মতো একটা কাগজের দলা খপাং করার আশায় তক্কে তক্কে থাকলাম। কিন্তু ফাতেমা আপুর সদা প্রস্তুত কর্মকৌশলের কাছে লাগাতার ফেল্টু খেতে লাগলাম। কাগজের গোল্লা আর বগলদাবা হয় না। লিখন মামাও খেলা শেষে আর তেমন হাত উপুড় করেন না। বরং মাঝেমধ্যেই অধৈর্যভাবে দাঁত খিঁচিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘তোদের দিয়ে কিস্যু হবে না। চেপে খেলা অত্ত সোজা নয় বাপু!’ তপু চেপে খেলায় মোটামুটি মাস্টার হয়ে উঠছে, এ কথা গত সপ্তাহেই লিখন মামা ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ এখন তার মুখে একি কথা! বাড়ি ফেরার পথে তপু একদিন জানালো কালই একটা কাগজের দলা আমরা বাগাতে যাচ্ছি দেখে নিস। বাড়ি গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসে ভাবছি, কাগজের গোল্লা নিয়ে তপু এতটা নিশ্চিত হলো কীভাবে।
তার জবাব দিতেই বুঝি তপু তার বাংলা ব্যাকরণ বই নিয়ে উপস্হিত। বেচারা বাংলায় বরাবরই একটু কাঁচা। আমিও যে খুব বেশি পাকা, তা নয়। তবে তপুর চেয়ে খানিক ভালো। সেই আমার কাছে কিনা তপু এসেছে ব্যাকরণ বুঝতে! হাসি চেপে আসল ঘটনা জানতে চাইলাম। আসল ঘটনা বেরিয়ে এলো খাতার আড়াল থেকে। সাদা একটা কাগজে টেরাবাঁকা অক্ষরে লেখা, ‘জান তোমার আমার প্রেমের কথা ধেঁড়ে লিখনটা যেন কোনভাবেই জানতে না পারে। জানলেই বাগড়া দেবে। দেখা হবে। মুমম্মা।’
-- কেমন? চোখ নাচিয়ে জানতে চাইলো তপু। ঘটনা বুঝে গেলাম চট করে। বুক ঠেলে উঠে আসা খুক খুক হাসিটা ছড়িয়ে দিয়ে ওর বুদ্ধির তারিফ করলাম।
যথা সময়ে কাগজখানা দলা পাকিয়ে লিখন মামার হাতে তুলে দেওয়া হলো। দু লাইনের চিঠিটা তিনি কম করে হলেও বার দশেক পড়লেন। মাথা চুলকে জানতে চাইলেন, এই তোরা ওদের কিছু বলেটলে দিসনি তো? সব থাকতে আমার নাম কেন বলতে গেল রে? আর ‘মুমম্মা’, ওটা আবার কী! তপুর চিমটি খেয়ে ছিটকে বেরোতে চাওয়া হাসিকে চোখ রাঙালাম। তপু বিজ্ঞের মতো বললো, কিসিটিসিকে সংকেতে লিখেছে আরকি। ভালো রে ভালো! দেখতে হয় তো তাহলে কেমন সংকেত চালাচালি করে দুটিতে।
বাড়ি ফেরার পথে তপুর হাসি আর থামে না। কেমন চেপে খেলেছি বল?
‘বাড়িতে ইঁদুরের উপদ্রব’ বিষয়ে বড় আপুর একটা লেখা ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। তা নিয়ে আহ্লাদের শেষ নেই। বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে লেখাটায় একটু চোখ বুলাতে গিয়ে ‘ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর’ বাক্যটায় চোখ আটকে গেল। আপুকে বার কয়েক জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নিলাম ‘ধেড়ে’ বানানে চন্দ্রবিন্দু হয় না। ইশশ তপু ওই বানানটা ভুল লিখেছে! লিখন মামা চেপে খেলায় মাস্টার হলেও লেখাপড়ায় লবডঙ্কা। কিন্তু প্রিয়বন্ধুর ভুলটা ধরিয়ে দেওয়া দরকার। তপুদের বাড়ি গিয়ে বলা যায় অবশ্য। কিন্তু আমার কেনজানি লজ্জা করে। আমাকে দেখলে আন্টি কেমন করে জানি হাসেন। আমার অস্বস্তি হয় খুব।
পরদিন বিকেলে লিখন মামা তখনও আসেননি ব্যাডমিন্টন কোর্টে। তিনি এলে খেলা শুরু হবে। নিজেদের মধ্যে বেশ গলা খুলে গালগল্প করছিলাম। হঠাৎ মনে পড়ায়, তপুর উদ্দেশে বললাম, ‘ধেঁড়ে’ বানানে চন্দ্রবিন্দু হয় না বোকা। ইয়াল্লা! আগে বললে কী হতো? আমারও সঠিক বানানটা জানা ছিল না। গতকালই শুদ্ধ বানানটা জেনেছি। ‘ধেঁড়ে’ না ‘ধেড়ে’ হবে। বলে দুজনে হাসতে শুরু করলাম। পিঙ্কি, সান্তু, রুমি ওরা কেউ আমাদের হাসির রহস্য বুঝলো না। যিনি বোঝার তিনি যে কখন এসে আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন টেরই পাইনি কেউ। দুই হাতে আমাদের দুজনের কান মুচড়ে ধরে খেঁকিয়ে উঠলেন লিখন মামা-
‘তাই তো বলি মেডিকেল পড়ুয়া একটা ছেলের লেখা অমন বিচ্ছিরি হয় কী করে! খুব পেকেছো না! দেখাচ্ছি মজা।’ মজা দেখানোর মতো যুতসই কিছু একটা খোঁজার জন্য ইতিউতি করার সুযোগে আমরা দুজন ওর হাত ছাড়িয়ে দে ছুট্। আর কক্ষনো ওমুখো হইনি।
ওই ঘটনার পর তপুটা কেন জানি আমাকে ভুল বুঝেছিল। ওর ধারণা, আমি ইচ্ছে করেই প্রকাশ্যে বানান ভুলের কথাটা তুলেছিলাম। তারপর থেকে আমার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দেয়। ওদের বাড়ির সাথে আমাদের বাড়ির আত্মীয়তার কোথাও কোনো ছন্দপতন না ঘটলেও আমাদের বন্ধুত্ব কেমন থমকে গেল। দেশ ছেড়ে কানাডা চলে যাওয়ার সময়ও আমার সাথে কথা বলেনি তপু। আমি গল্পের বইয়ের ভেতর ওকে ছোটো ছোটো চিরকুটে কতবার যে লিখে পাঠিয়েছি, ‘Sorry. Miss you!’ বা ‘Missing you.’ একটারও উত্তর আসেনি। তপুটা ভয়ানক গোঁয়ার বরাবরই। তার মাত্রা যে এতটা সেই প্রথম জানলাম।
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর হাতভরতি অবসর সময় পাওয়া গেল। অলস সময়ের অনেকটাই আউট বই পড়ে কাটছে। তিন গোয়েন্দা সিরিজের সবগুলো এরই মধ্যে শেষ করে ফেলেছি। সিরিজটা পড়তে গিয়ে তপুর কথা খুববেশি মনে পড়েছে। ‘মিস ইউ’ বাক্যটা দীর্ঘশ্বাসের অক্ষরে লিখে বাতাসের বুক পকেটে বেয়ারিং পোস্ট করে দিয়েছি। উত্তরের আশা ছেড়েছি বহুদিন। হঠাৎ একদিন আমাকে চমকে দিয়ে কমলারঙের একটা খাম এলো বাড়ির ঠিকানায়। প্রাপকের জায়গাতে আমারই নাম! প্রেরকের নামটা দেখে মা মুচকি হাসলো। বাব্বাহ্ এতদিনে রাগ নামলো ছেলের!
দ্রুত হাতে চিঠিটা খুলতে গিয়ে টের পেলাম আমি কাঁপছি। আমি কাঁদছি। ঝাপসা চোখে চমৎকার গোটা গোটা অক্ষরে নির্ভুল বানানে লেখা, --ঢঙও জানিস ব্যাপক। কেন বাংলায় বুঝি স্পষ্ট করে লেখা যেতো না? নাকি ইংরেজি বাক্য ‘I miss you’ এর বাংলাটাই জানা নেই গর্দভ! মানেটা আমি বলছি শোন - ‘তোর জন্য পরাণ পোড়ে’। বুঝেছিস শুঁটকি টেরি! মুমম্মা।