Posts

চিন্তা

বস্ত্র শিল্প যার উপর দাঁড়িয়ে আমাদের অর্থনীতিঃ শেষ পর্ব

January 27, 2025

Md. Rezaul Islam

10
View

বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানির সুচনাঃ

বাংলাদেশে প্রথম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি স্থাপিত হয় ১৯৬০ সালে ঢাকার উর্দু  রোডে যার নাম রিয়াজ গার্মেন্টস। এটির প্রথম নাম ছিল রিয়াজ স্টোর যেটি টেইলারিং আউটফিট হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। ১৯৭৩ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস নাম করণ করা হয়। প্রাথমিক ভাবে রিয়াজ গার্মেন্টস এর উৎপাদিত পোশাক স্থানীয় বাজারে বিক্রয় করা হতো। ইংরেজি ১৯৬৭ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস এর উৎপাদিত ১০,০০০ পিস শার্ট বাংলাদেশ হতে সর্বপ্রথম বিদেশে রপ্তানি করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে প্রথম দেশের বাইরে পোশাক রপ্তানী করে রিয়াজ গার্মেন্টস। ১৯৭৮ সালের ২৯ জুলাই পোশাক রপ্তানী করে দেশে এক হুলস্থুল ব্যাপার ঘটিয়ে ফেলেছিল । ১৯৭৩/৭৪ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস মেয়েদের জন্য তিনটি ফ্যাশন উদ্ভাবিত করে। শকুন্তলা, আম্রপালি এবং প্যান্ডোরা। প্রতিটি ছিল বক্ষবন্ধনী । সুতরাং রিয়াজ গার্মেন্টস ছিল বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অগ্রপথিক ।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বর্তমান প্রেক্ষাপটঃ

রিয়াজ গার্মেন্টসের হাত ধরে চলা এই পোশাক রপ্তানি আজ অনেক দূর এগিয়েছে। প্রথমেই শুরু করা যাক কিছু তথ্য দিয়ে। বিটিএম এর রিপোর্ট অনুসারে আমাদের দেশের মোট জিডিপির ১৩%  এর ও বেশি এই খাত থেকে আসে। মোট রপ্তানির ৮৬% আসে টেক্সটাইল খাত থেকে। প্রায় ৪০ লক্ষ্য শ্রমিক এই খাতে জীবিকা নিরবাহ করে যাদের মধ্যে প্রায় ৬৩% হচ্ছেন নারী ১৯৮১-৮২ সালে বাংলাদেশ ০.১ বিলিয়ন টাকার রেডিমেইড গার্মেন্টস রপ্তানি করে বিশ্ব বাজারে একটি শক্ত পারাখা শুরু করে। এর মাত্র ১০ বছর পর সেটি ১৯৯২-৯৩ সালে ১৪৪৫ মিলিয়ন ইউ.এস ডলারে উন্নীত হয়। ২০১৬ অর্থ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এর পরিমান দাঁড়ায় ২৮০৯.৪১ কোটি ডলার। গত বছরের চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ১ হাজার ১৯৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হওয়া ১ হাজার ১১৩ কোটি ডলারের চেয়ে ৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে সামগ্রিক দিক বিবেচনা করলে পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। ইউরোপে আমরা সব থেকে বেশি পোশাক রপ্তানি করি। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো সারা বছর যে পরিমাণ টি-শার্ট বা গেঞ্জি কেনে, তার প্রায় ৪১ শতাংশই বাংলাদেশি পোশাক কারখানা সরবরাহ করে। ফলে ছয় বছর ধরে ইইউতে টি-শার্ট রপ্তানিতে শীর্ষ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।একই ভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ডেনিম রপ্তানিতে বাংলাদেশ শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে। নব্বইয়ের দশক থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আসছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে সারা বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। শুরু থেকেই টি-শার্ট রপ্তানি করে এলেও ২৫ বছর পর ২০১১ সালে ইইউতে শীর্ষে পৌঁছে বাংলাদেশ। তার আগ পর্যন্ত তুরস্কই সর্বোচ্চ পরিমাণ টি-শার্ট রপ্তানি করত ইউরোপের বাজারে। ইইউভুক্ত দেশগুলো ২০১৬ সালে ৭৪০ কোটি ইউরো বা ৭০ হাজার ৩০০ কোটি টাকার টি-শার্ট কিনেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ৪০ দশমিক ৮১ শতাংশ রপ্তানি করেছে। তুরস্ক ২৬ শতাংশ বা ১৯৬ কোটি ইউরো ও চীন ১৬ শতাংশ বা ১১৭ কোটি ইউরোর টি-শার্ট বা গেঞ্জি রপ্তানি করেছে।

কিছু বাঁধা-বিপত্তি এবং সমাধানঃ

২০১২-১৩ ছিল দেশের পোশাক শিল্পের জন্য এক বড় ধাক্কা। ২০১২ সালের ২০ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় অবস্থিত তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানায় মারাত্মক অগ্নিকাণ্ড ঘটে।যাতে মোট ১১৭ জন পোষাক শ্রমিক নিহত হয়। ভয়ানক এই দুর্ঘটনায় ঐ পোশাক কারখানার নয়তলা ভবনের ছয়তলা ভস্মীভূত হয়ে যায়।সরাসরি আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যায় ১০১ জন পোষাক শ্রমিক।আগুন থেকে রেহাই পেতে উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যু হয় আরও ১০ জনের।ঠিক তার এক বছর যেতে না যেতেই ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৮:৪৫ এ সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামের একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ে। ভবনের কয়েকটি তলা নিচে দেবে যায়। কিছু অংশ পাশের একটি ভবনের ওপর পড়ে।এ দূর্ঘটনায় এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয় যা বিশ্বের ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এরপররই নড়ে চড়ে বসে বিদেশি ক্রেতারা। তারা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকেন। বিদেশি ক্রেতাদের দ্বারা গঠিত দুটি জোট Alliance এবংAccord শ্রমিকদের কল্যানে কাজ শুরু করে। ২০১৭ সালে তাদের দেয়া বার্ষিক রিপোর্ট অনুসারে কারখানা গুলোর ৮৫ শতাংশ ত্রুটি সংস্কার কাজ শেষ এবং শ্রমিকদের মজুরী একটি সহনীয় কাঠামোর মধ্যে এসেছে অধিকাংশ শ্রমিক নিজেদের জীবনমান ও নিরাপত্তায় সন্তুষ্ট সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি পোশাক শিল্পে আজ অস্বস্তি অনেক কমে গেছে এবং সরকার শ্রমিকদের কল্যানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। 

টেক্সটাইল নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাঃ

আমরা হয়তবা অনেকে জানিনা,  বিশ্বের শীর্ষ ১০টি পরিবেশবান্ধব তৈরি পোশাক পণ্য উৎপাদনকারী কারখানাসমূহের মধ্যে ৭টিই বাংলাদেশে স্থাপিত।যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনবিল্ডিং কাউন্সিলে নিবন্ধিত ১৯৫টি বাংলাদেশি সবুজ পোশাক কারখানার মধ্যে ৩৬টি লিড সনদ পায়। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ইউএসজিবিসিতে নিবন্ধিত আরও ১৫৯টি বাংলাদেশি সবুজ পোশাক কারখানা লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ড ডিজাইন সনদ পাওয়ার অপেক্ষায় আছে।আর যে ৩৬টি কারখানা এই সনদ পেয়েছে,তার মধ্যে ৯৭ পয়েন্ট পেয়ে বিশ্বের নাম্বার ওয়ান পোশাক কারখানার স্বীকৃতি অর্জন করেছে রেমি হোল্ডিংস লিমিটেড।৯২ পয়েন্ট পেয়ে প্লামি ফ্যাশন লিমিটেড দ্বিতীয়, ৯০পয়েন্ট পেয়ে ভিনট্যাগ ডেনিম স্টুডিও লিমিটেড চতুর্থ, ৮৫ পয়েন্ট পেয়ে এসকিউ সেলসিস-২সপ্তম এবং ৮১ পয়েন্ট পেয়ে জেনেসিস ফ্যাশনস লিমিটেড দশমস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা করতেছে আস্তে আস্তে সকল কারখানাই পরিবেশ বান্ধব বা গ্রিন ফ্যাক্টরিতে পরিণত করা হবে কিন্তু গ্রিনফ্যাক্টরি করতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ দরকার। একটি ফ্যাক্টরি করতে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। এর পাশাপাশি জমি ও লাগে ৩ থেকে ১০ বিঘা। দেশের এ পর্যন্ত যেসব কারখানা গ্রিন ফ্যাক্টরির খেতাব জিতে নিয়েছে তাদের বেশিরভাগ উদ্যোক্তার বিনিয়োগই ছিল ৫০০ কোটি টাকা বা তার চাইতেও বেশি।সরকারের পোশাক শিল্পের সংগঠন বিজিএমইএ ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সামনে রেখে ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্য নিয়ে ‘পথনকশা ২০২১’ ঘোষণা করেছিল এবং এজন্য সরকার আন্তরিকতার সাথে কাজ করে গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের বড় বাঁধা বা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম এবং ভারত। সঠিক পরিকল্পনা না থাকলে আমরা আমাদের দ্বিতীয় অবস্থান ভারত ও ভিয়েতনামের কাছে হারাব।কিছুদিন আগে বিজিএমইএ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যেখানে দেখা যায় বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালে আরও কমে গেছে। যেখানে ২০১৬ সালে ছিল ৫৩০ মার্কিন ডলার সেখানে ২০১৭ সালে দাঁড়িয়েছে ৫০৬ মার্কিন ডলার। সবথেকে অবাক করার মত বিষয় হল তাঁদের দেশে চীন ও ভিয়েতনাম পোশাক রপ্তানিতে প্রায় বলতে গেলে আধিপত্য ধরে রাখছে।

সর্বশেষ কিছু কথা না বললেই নয়। আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা “যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন বাংলাদেশের তৈরি ডেনিম জিনস ব্যবহার করে। আর ইউরোপীয়দের মধ্যে প্রতি তিনজনে একজন বাংলাদেশের তৈরি টি-শার্ট ব্যবহার করে”। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। নিপীড়িত-নিঃশেষিত এজাতি আজ যেন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সোনার বাংলা গড়তে আজ তাঁরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ‘ ইনশাআল্লাহ এভাবেই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেয়ে ছোট এই মাতৃভূমিকে আরো সুন্দর করে গড়ে তুলব।

সবাইকে ধন্যবাদ।।

Comments

    Please login to post comment. Login