মুক্তিযুদ্ধ মানে বাংলাদেশ। আমরা আমাদের চৈতন্য জ্ঞানেই ওই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আছি। এবং ওই স্বজ্ঞা থেকেই জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হেজেমনিক সরকারের বেপরোয়া বাড়াবাড়ির অজুত নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছি। শহীদ ও আহতদের পক্ষে কলম ধরেছি। আপনারাই বরং চব্বিশ দিয়ে একাত্তরকে বিলীন করে দেবার প্রয়াসী হয়েছিলেন। রিসেট বাটন চাপবার কথা বলেছিলেন।
উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের মুক্তিযুদ্ধ চিন্তা ভীষণ এলোমেলো যদি, কিন্তু, তবে দিয়ে ভরা। আজকের স্ট্যাটাসে মিস্টার আলম এত বেশিবার মুক্তিযুদ্ধের নাম নিয়েছেন যে, তা বেশ আরোপিত মনে হয়েছে। আরোপিত বিষয় আর গভীর বিশ্বাসের পার্থক্য যে কারোরই চোখে ধরা পড়ে। শাসক শেখ মুজিবের একশ একটা বদনাম থাকতে পারে। এবং বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত একজনও বদনাম ছাড়া সরকার প্রধান দেখেনি।
মুজিববাদের কবর দেয়ার পর আপনাদের তরফে আর মুক্তিযুদ্ধের নিরঙ্কুশ আলাপ চলে না। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারীদের সাথে সখ্যতা, ক্ষেত্রবিশেষে উদারহস্তে ক্ষমতার পাদপ্রদীপে রাখা, ক্ষমা না চাওয়া পরাজিত পাকিস্তানকে মিত্রতার সবখানি দিয়ে দেয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম হিস্টরিক সেন্ট্রাল জোন ৩২ নাম্বার আগুনে ঝলসে দিয়ে গণ কিংবা সর্বজনের সাথে রিকন্সিলিয়েশনের আলাপও ঠিক জমানো যাবে না। ৭২ পূর্ব শেখ মুজিবকে আপনারা গুরুত্ব না দিলেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতাই থাকবেন। আপনারা মুজিব ইতিহাসের কবর দিলেও আল মাহমুদের কবিতা সত্যই থাকবে। সত্য থাকবে মনীষীদের বয়ান।
বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে আমরা এই বাংলার তিনজন মনীষীর মতামতকে স্মরণ করতে পারি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম বলেছেন, 'শেখ মুজিবকে আমরা ঈর্ষা করেছি। ঈর্ষা করেছি আমাদের অতিক্রম করে বড় হওয়াতে। নানাদিকে বড়। তেজে, সাহসে, স্নেহে, ভালবাসায় এবং দুর্বলতায়। সবদিকে। এবং এই ঈর্ষা থেকেই আমরা তাকে হত্যা করেছি। কেবল এই কথাটি বুঝিনি যে, ঈর্ষায় পীড়িত হয়ে ঈর্ষিতকে হত্যা করে ঈর্ষিতের স্থান দখল করা যায় না।'
লেখক আহমদ সফা বলেছেন, `আজ থেকে অনেকদিন পরে হয়তো কোনো পিতা তাঁর শিশুপুত্রকে বলবেন, জানো খোকা! আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিল যাঁর দৃঢ়তা ছিল, তেজ ছিল আর ছিল অসংখ্য দুর্বলতা। কিন্তু মানুষটির হৃদয় ছিল, ভালোবাসতে জানতেন, দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোৎস্নারাতে রূপালি কিরণধারায় মায়ের স্নেহের মতো যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি এবং নিশ্চয়তার বোধ জাগিয়ে তোলে তা হলো তাঁর ভালোবাসা। জানো খোকা তাঁর নাম? শেখ মুজিবুর রহমান।'
'নিশিডাক' কবিতায় কবি আল মাহমুদ লিখেছেন
তার আহ্বান ছিল নিশিডাকের শিসতোলা
তীব্র বাঁশির মতো।
সে যখন বললো, 'ভাইসব।'
অমনি অরণ্যের এলোমেলো গাছেরাও সারি
বেঁধে দাড়িয়ে গেল।
সে যখন ডাকলো, 'ভাইয়েরা আমার।'
ভেঙে যাওয়া পাখির ভিড় করে নেমে
এল পৃথিবীর ডাঙায়
কবিরা কলম ও বন্ধুকের পার্থক্য ভুলে হাঁটতে
লাগলো খোলা ময়দানে।
লেখক: সাংবাদিক
২৮ জানুয়ারি ২০২৫