Posts

গল্প

থাকে শুধু অন্ধকার

January 29, 2025

Afia Akter

Original Author আফিয়া আঞ্জুম সুপ্তি

25
View

থাকে শুধু অন্ধকার 

ভোরবেলা অচেতন অবস্থায় তরিঘরি করে আফরিনকে নেয়া হলো সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে । স্টমাক ওয়াশ করানো হয়েছে। এখন ঘুমাচ্ছে । স্যালাইন চলছে।

ডাক্তার অনিক জিজ্ঞেস করলো আফরিনের ছোট বোন আইরিনকে, 
'ঠিক কি হয়েছিলো, যার কারণে আপনার আপু একসাথে এতোগুলা ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিলো?'
--গতকাল রাতে আম্মু খুব মেরেছিলো আপুকে। আপু জোরে জোরে চিৎকার করে কেঁদেছে রাত ২টা পর্যন্ত। আমি তখন আপুর সাথেই জেগে ছিলাম। হঠাৎ ঘুমিয়ে যাই। এরপর কিভাবে যে কি হলো! "
--মা মারলেই ২৫ বছর বয়সী একটা মেয়ে সুইসাইড এটেম্পট নেবে? তাও ওয়েল এডুকেটেড। পাবলিক ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করা। দেখতে শুনতেও তো একেবারে খারাপ না। আরও কিছু কি আছে? থাকলে শেয়ার করুন আমার সাথে। "
--আমি তো আর কিছু জানি না স্যার! আপু আমাদের কারো সাথে খুব প্রয়োজন না হলে তেমন কথা বলতো না। গতকাল আম্মু মারার আগে পাশের বাসার মেহেনাজের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছে। "
--কি কি  বলেছে? আপনি কি শুনেছেন কিছু? আর মেহনাজ এর বয়স কতো? কি করে?
-- মেহনাজ ক্লাস থ্রি তে পড়ে। বয়স ৯/১০ হবে। মেহনাজ আর আমার ছোটভাই আরিয়ান আমাদের বসার ঘরে রং পেন্সিল আর পুতুল নিয়ে খেলছিল। আপু হঠাৎ মেহনাজকে ডেকে নিয়ে কোলে বসালো। তারপর বললো, 'তোমার চুলগুলো কেমন খসখসে হয়ে গেছে। যত্ন নাও না? তেল দিয়ে দেই আমি?' এই বলে মেহনাজের চুলে তেল দিতে শুরু করলো। মেহনাজের প্রায় কোমড় সমান চুল। আপু আগে বড় চুল দেখতেই পারতো না। মেহনাজের আম্মুকে বলতো, "আন্টি এতো বড় চুল রেখেছেন কেন ওর? মাথা ভারি ভারি লাগে না? গরম লাগে না? এতোবড় চুল আচড়াতেও তো সময় নষ্ট হয়" অথচ কাল অনেকক্ষণ সময় নিয়ে মেহনাজের চুলে তেল দিয়ে, আচড়ে বিনুনি করে দিলো। নিজের সবচেয়ে পছন্দের হেয়ার ব্যান্ডটা মেহনাজের চুলে আটকে দিলো। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরে নিচু স্বরে বললো, "চুলের যত্ন নেবে। চেহারার যত্ন 
নেবে। সৌন্দর্যই সব। মেয়ে মানুষের বেশি পড়াশোনা 
করতে নেই বুঝলে?"

-- ক্লাস থ্রিতে পড়ুয়া বাচ্চা মেয়ের সাথে এসব কথা বলার মতো মেয়ে তো আফরিন না। কিছু মনে করবেন না। আমার ছোট ভাইয়ের ক্লাসমেট আফরিন। সেই হিসেবে মোটামুটি চিনতাম ওকে। খুব ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন, স্মার্ট মেয়ে মনে হয়েছে। হঠাৎ কি হলো ওর? এ ধরণের আচরণ কবে থেকে শুরু করেছে? 
-- সৌরভ ভাইয়া কোভিডে  মারা যাওয়ার পর থেকেই আপু কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্টও খারাপ করেছে একারণে। মাস্টার্সেও টেনেটুনে পাশ। সারাদিন কি যেন ভাবতে থাকে। এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ হঠাৎ কি ভেবে যেন মৃদু হেসে ওঠে। জিজ্ঞেস করলে বলে না। দু একদিন রাতে ঘন্টার পর ঘন্টা ফেসবুক স্ক্রল করে, কোনো নোটিফিকেশন বা মেসেজ সীন করে না। শুধু স্ক্রল করতে থাকে। মাঝেমধ্যে বিসিএস কোয়েশ্চন ব্যাংক খুলে পড়তে বসে। ঘন্টা দুই পড়ার পরই মাইগ্রেন পেইন শুরু হয়, তারপর কাঁদতে শুরু করে। শব্দ করে না। শুধু চোখে পানি আর হেচকির শব্দ। 
-- এই সৌরভ ভাইয়াটা কে? 
-- সৌরভ ভাইয়ার সাথে আপুর রিলেশন ছিলো। 
-- ওহ্ আচ্ছা। আপনি চিনতেন সৌরভকে? কি করতো,কোথায় থাকতো বা আফরিনের সাথে কিভাবে পরিচয়? 
--সৌরভ ভাইয়া ব্রাক ইউনিভার্সিটিতে পড়তো। আপু যখন ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয় ভার্সিটিতে, ভাইয়া তখন মাস্টার্সে পড়তো। আপুর সাথে বইমেলায় পরিচয় হয়। আপু মেলার স্টলে কাজ করতো তখন আর ভাইয়ার একটা বই বের হয়েছিলো। আপু যেই প্রকাশনীতে কাজ করতো ওখান থেকেই৷ এভাবেই পরিচয় হয়েছিলো। ভাইয়ার মা মারা গেছিলো ছোটবেলাতেই। বাবা রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। 
ভাইয়ার বাবা, আপুকে চিনতেন। খুব পছন্দ করতেন। গতবছর মারা গেছেন আঙ্কেল। 
সৌরভ আমাদের বাসায় ভাইয়া দু তিনবার এসেছিলো।

-- আচ্ছা! সৌরভ মারা যাওয়ার পরপর কি আফরিন সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিলো? 
-- না স্যার, তখন এমন কিছু করে নি। আপু হোস্টেল ছেড়ে দিয়ে অনেকদিন বাসায় ছিলো। কারো সাথে কোনো কথা বলতো না। একটা সেমিস্টার ড্রপ দিয়েছিলো। 
-- হঠাৎ ৩ বছর পর এমন কেনো করলো? আচ্ছা বাসা থেকে বিয়ে বা অন্য কোনো বিষয়ে প্রেশার ছিলো? 
আইরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। 
-- জ্বি। আম্মু গতরাতে এজন্যই মেরেছিলো। আসলে আব্বু রিটায়ার্ড করেছে তো। শরীরটাও ভালো নেই। তাই আপুকে বিয়ে দেয়ার জন্য ঘটক ঠিক করেছিলো। গত শুক্রবার আপুকে দেখে গেছে। পাত্র জেলা পরিষদ মার্কেটে ব্যাবসা করে। মাধ্যমিক পাশ। ইভটিজিং কেসে ১ বছর জেল খেটে এসেছে।
-- তোমার আপু রাজি হয় নি বলে মা মেরেছে। তাই তো? 
এসব অর্ধশিক্ষিত মায়েদের নিয়ে এক জ্বালা! ভালো মন্দ বোঝে না। মনে করে এক জায়গায় গছিয়ে দিলেই হলো! 
ব্যাকগ্রাউন্ড, মেন্টালিটি কিছু ম্যাচ করা লাগবে না।

-- না স্যার। আপু কোনো আপত্তি করে নি। এরকম লোকের সাথে আমার আপু সংসার করতে পারবে না কোনোদিন আমি জানি। আমার আপু খুব রুচিশীল একটা মেয়ে। তাও আপু কোনো আপত্তি করে নি। 
-- কি বলো? সরি! বলুন! 
-- সমস্যা নেই স্যার। তুমি করেই বলুন। আমি বয়সে অনেক ছোট আপনার। 
-- তাহলে তুমিও স্যার না বলে ভাইয়া বলো। এতে আমি বেশি কমফোর্ট ফিল করবো। আফরিন রাজি ছিলো। তাহলে সমস্যা হলো কোথায়? 
-- আসলে ভাইয়া, সৌরভ ভাই মারা গেল যেদিন, তখন আপু খুব পাগলামি করেছিলো। পুরো মহল্লার মানুষ জেনে যায় তখন আপুর রিলেশনশিপের কথা। আর ৩ বছর ধরে আপু কারো সাথে কথা বলে না, বুঝতেই তো পারছেন। মহল্লায় মোটামুটি কানাকানি শুরু হয়েছে যে, আপু পাগল হয়ে গেছে। এসব কথা পাত্রপক্ষের কানে গেছে। গতকাল সন্ধ্যায় তারা জানিয়েছে মাকে। আমার আপুর মতো মেয়েকে ওরা রিজেক্ট করলো, আম্মু ব্যাপারটা নিতে পারে নি। আপু তখন বাসায় ছিলো না। ইন্টারভিউ দিতে ঢাকায় গিয়েছিল। ৯ টার দিকে আপু বাসায় আসে। আম্মু তখন ঘুমিয়ে ছিলো। আপু মেহনাজের চুল বেঁধে দেয়ার একটু পরই আম্মু ঘুম থেকে ওঠে। তখনই আপুকে মারতে শুরু করে। সাথে অকথ্য গালাগালি।

-- বুঝলাম। ভেরি স্যাড। তারপরও এমনটা করা উচিত হয় নি ওর। একটু বেশিই অভিমানী মনে হয়।

হঠাৎ নার্স এসে খবর দিলো, আফরিনের জ্ঞান ফিরেছে। 
অনিক দ্রুত আফরিনের কেবিনে গেলেন। 
--আফরিন কেমন আছো? 
-- ভাইয়া আপনি? 
-- হুম। আমি যে এই হসপিটালে আছি, তুমি জানতে না? 
-- জানতাম। ভুলে গেছিলাম। 
-- সবকিছুই ভুলে যাও? 
-- হ্যা, মোটামুটি সবই বলা চলে।

বলেই একটু উঠে বসলো আফরিন।

-- আহা! উঠলে কেন? তোমার তো বিশ্রাম দরকার এখন। 
না আমি ঠিক আছি ভাইয়া। আপনি বসুন না! দাড়িয়ে কেন? 
-- ঠিক আছে। তা নাহয় বসলাম। তুমি আগে বলো, এমন অকাজ কেন করতে গেলে? মরা কি খুব জরুরি? জনগণ এভাবে মরতে চাইলে তো আমরা ডাক্তাররা বেকার হয়ে যাবো। জনগণ বাঁচতে চাইলেই না আমরা একটু আয় রোজগার করতে পারবো। 
জানালার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আফরিন আনমনে বললো 
-- বেঁচে থাকাটা অতো সহজ না। তাই আমার মতো ভীতু লুজাররা সহজ রাস্তা বেছে নেয়। মরতে চায় তারা। 
-- দেখো! তুমি কোয়ালিফাইড মেয়ে। দেখতে শুনতেও ভালো। বিয়ে আজ না হোক, একদিন তো হবেই। এতো ভেঙে পরার কি আছে? আর রইলো মায়ের পিটুনি। 
ওটা কোনো ব্যাপার না। আমার মা ও মারে সকালে ব্রেকফাস্ট না করে হসপিটালের জন্য রওনা হলে। 
হা হা হা! 
-- আমার খুব যন্ত্রণা হয় ভাইয়া! খুব ভয় করে। মনে হয় চারদিকে অন্ধকার। আমাকে গিলে খাবে। আমার হৃদপিণ্ডটা যেন ভয়ে কুঁকড়ে ছোট হয়ে যায়। আমার মনে হয়, আমি অতল গভীরে হারিয়ে যাচ্ছি। কাউকে খুব করে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা করে। মনে হয়, কারো বুকের মধ্যে লুকিয়ে যাই। আমাকে কেউ আগলে রাখুক শক্ত করে। যেন কোনো অন্ধকার, কোনো কালো ছায়া আমাকে কেড়ে নিতে না পারে। 
-- আফরিন! এসব কি বলছো ভাইয়া! কি হয়েছে তোমার? আমাকে খুলে বলো? 
-- ভাইয়া! আমি আসলে মরতে চাই না। আমি খুব! খুব করে বাঁচতে চাই ভাইয়া! কিন্তু আমি প্রতিদিন মরে যাই। 
প্রতি মুহূর্তে আমি মরতে থাকি। আমাকে একটু বাঁচান ভাইয়া! আপনি পারবেন আমাকে বাঁচাতে? একটু বাঁচান ভাইয়া! একটু আলো! ভাইয়া একটু আলো এনে দিন! আমি অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছি!

বলতে বলতে অনিকের একটা হাত দুহাতের মুঠোয় চেপে ধরে ডুকরে কাঁদতে থাকে আফরিন!

-- আফরিন! আফরিন! শান্ত হও ভাইয়া! কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো। তোমার কি সৌরভের কথা বেশি মনে পরছে? মিস করছো? 
আফরিনের কান্না হঠাৎ থেমে যায়। স্থির হয়ে বসে একদৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর বলতে শুরু করে।

-- ভাইয়া জানেন? সৌরভ কবরে গেছে। আমার জীবনের সবটুকু আলো সাথে করে নিয়ে গেছে। খুব বেইমান। আমাকে এই কালো ছায়ার ভীড়ে ছেড়ে গেছে। 
-- আমি শুনতে চাই আফরিন! তুমি বলো। সৌরভের সাথে তোমার ভালো খারাপ যত স্মৃতি সব বলো। হালকা লাগবে নিজেকে৷ 
-- আমাদের যখন প্রথম পরিচয় হয়, সৌরভ বেশ লাজুক ছেলে ছিলো। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারতো না। ভার্সিটিতে ওর অনেক ফিমেল ফ্রেন্ড ছিলো। তাও কেন যে আমার সামনে এসে নার্ভাস হয়ে যেতো বুঝতাম না। আমি বুঝতাম ও আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু ও পাক্কা ১ বছর আমাকে বলতেই পারে নি। 
-- তারপর? কবে প্রপোজ করলো তোমায়? 
-- ও আমাকে ওভাবে প্রপোজ করে নি। পরের বছর ওর কবিতার বই বের হয় একটা। পাগলটা সেটা উৎসর্গ করেছিলো আমাকে। এরপর থেকেই কিভাবে যেন দুজনে জড়িয়ে গেলাম। 
-- সৌরভের ঠিক কি কি মিস করো তুমি? 
-- ওকে আমি মিস করি না। ও একটা দুঃস্বপ্নের মতো। তাড়া করে আমাকে।
-- কিছু মনে করো না। খুব ব্যাক্তিগত একটা প্রশ্ন করি। তোমাদের মধ্যে কি ইন্টিমেসি হয়েছিলো কখনো ? 
-- ওরা ২ বন্ধু একটা ফ্ল্যাটে থাকতো। আমি প্রায়ই যেতাম ছুটির দিনে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি থাকতাম। প্রেমিক প্রেমিকা এতো দীর্ঘ সময় বদ্ধ ঘরে একসাথে থাকলে অনেক কিছুই হয় সেখানে। 
-- আচ্ছা আচ্ছা! বুঝতে পেরেছি। তোমার কি এই বিষয় নিয়ে হতাশা? মানে এইযে, সৌরভের সাথে এত গভীর সম্পর্কে থাকা, এরপর ওর চলে যাওয়া! মানে তোমার কি মনে হয়, তোমার বড় ধরণের একটা ক্ষতি হয়ে গেছে? 
আফরিন চুপ করে থাকে। 
-- দেখো আফরিন! এসব মানুষের জীবনের খুবই স্বাভাবিক ঘটনা প্রবাহ! ইউ নো? ভার্জিনিটি যাস্ট একটা মিথ। কারো সাথে তুমি শারীরিক সম্পর্কে ছিলে বলে তুমি কোনো দিক থেকে অযোগ্য হয়ে গেছো এমন কিছু না!

আফরিন হো হো করে হেসে ওঠে। 
-- ভাইয়া জানেন? কাল কি হয়েছিলো? আমি ইন্টারভিউ দিতে গেছিলাম। কার কাছে জানেন? এস এম সৈকত। আমার সৌরভের বেস্ট ফ্রেন্ড। সৌরভের সেই ফ্ল্যাটমেট, যেই ফ্ল্যাটে আমি যেতাম ওর সাথে দেখা করতে। 
-- তারপর? সেই ফ্রেন্ড কি করে? চাকরি হয়েছে তোমার? 
-- হ্যা, চাকরি তো হয়েছেই! সৈকত ভাইয়া বড়লোক বিজনেসম্যান বাপের একমাত্র ছেলে। নিজের আইটি ফার্ম খুলেছে। আমাকে সে চাকরি অফার করেছে তার পিএ পদে। 
-- হুম। স্যালারি কম। তোমার সাথে ঠিক যায় না। 
-- না ভাইয়া! স্যালারি কম না। সে আমাকে স্টার্টিং এই ৬০ হাজার অফার করেছে। 
-- কি বলো? বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড বলে এই বিশেষ অফার নাকি? 
আফরিন আবারও হো হো করে হেসে উঠলো। 
-- হুহ! বন্ধুত্বেরই মর্যাদা নাই! আর বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড? 
আচ্ছা ভাইয়া আপনি আসল হিরে নকল হিরে চেনেন? 
আমার হাতের এই আংটিটা দেখুন তো? এটা কার জানেন? সৌরভের মায়ের৷ আমাদের সম্পর্কের ১ বছরের মাথায় সৌরভ আমাকে ওর বাবার সাথে দেখা করতে নিয়ে যায়। আঙ্কেল সেদিন সৌরভের হাতে এটা তুলে দেয় আমাকে পরিয়ে দেয়ার জন্য। 
-- আমি জহুরি নই৷ হিরা চিনি না ভাই! 
-- আপনার চিনতে হবে না। আমি জানি, এটা আসল হিরে। 
আমার বান্ধবীরা বলতো সৌরভ আমার সাথে টাইম পাস করে৷ সখ মিটলে ছেড়ে দেবে আমাকে। এই আংটি দেখে ওরা বিশ্বাস করতে পারে নি। জহুরি দিয়ে পরিক্ষা করিয়েছিলো। হা হা হা!  
-- সৌরভ তোমাকে অনেক ভালোবাসতো না? 
--ছাই বাসতো! ভালোবাসলে কেউ এভাবে অন্ধকারে ফেলে যায়? 
-- নিয়তি বড়ই নিষ্ঠুর আফরিন। 
-- জানেন ভাইয়া? সৌরভের যখন প্লাটিলেট একদম কমে গেলো, হাসপাতালে সবার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলো! ওর বাবা আর বন্ধু সৈকতকে কাছে ডেকে বললো, আমার আফরিনকে দেখে রেখো তোমরা। ও যেন কখনো কষ্ট না পায়! 
-- আফরিন, তুমি কি খুব বেশি মিস করছো সৌরভকে? 
আফরিন চুপ করে থাকে। একটু পরে বলতে শুরু করে। 
-- জানেন ভাইয়া! আঙ্কেল ছিলো বলেই আমি কোনোরকমে পড়াশোনাটা শেষ করতে পেরেছি। সৌরভ মারা যাওয়ার পর উনি আমাকে নিজের মেয়ের মতোই আগলে রেখেছিলেন। আমার সাইকোথেরাপি চলেছিলো পুরো ১ বছর। উনি সব খরচ দিয়েছিলেন। হোস্টেলে আসতেন মাঝেমধ্যে আমাকে দেখতে। বলতেন,খুব ভালো একটা ছেলে দেখে নাকি আমাকে বিয়ে দেবেন৷ 
আমাকে বলতেন, আমি যেন বিয়ের পর আমার স্বামীকে বলি ওনাকে বাবা ডাকতে। 
-- আল্লাহ বেহেশত নসিব করুক ওনাকে। 
-- ভাইয়া, আমি গত ১ টা বছর ধরে সরকারি চাকরির আবেদন করতে করতে পাগল হয়ে গেছি। পাশের বাসার ক্লাস সিক্সের এক বাচ্চাকে পড়াই। যা পাই ঐ টাকা আমার আবেদন করতে করতে আর পরিক্ষা দিতে দিতেই যায়। খুব আশা নিয়ে সৈকত ভাইর কাছে গেছিলাম। 
-- হুম। সৈকত তো তার বন্ধুকে দেয়া কথা রেখেছে। চাকরি তো দিলো তোমাকে তাও হ্যান্ডসাম স্যালারি। 
-- চাকরি! ৬০ হাজার টাকা কেন অফার করলো জানেন ভাইয়া? 
-- ঠিক বুঝলাম না। 
-- সৈকত আমার সাথে শুতে চায় ভাইয়া। পার্সোনাল এসিসট্যান্টের ট্যাগের আড়ালে সে আমাকে ভোগ করতে চায়। 
-- কি বলো? এতো বড় স্পর্ধা! এতো জঘন্য! 
-- আমি তার কথা শুনে রেগে যাওয়ায় সে কি বলে জানেন ভাইয়া? বলে, "তুমি তো ভার্জিন না। এতো চটছো কেন? আমাদের ফ্ল্যাটে সৌরভের সাথে কতো ঘন্টা সময় কাটিয়েছো তা আর কেউ না জানলেও আমি তো জানি। সমস্যা কোথায় তাহলে?" 
ভাইয়া! আমি তো সৌরভকে ভালোবাসি ভাইয়া! ভালোবাসার মানুষকে যা দিয়েছি তা কি টাকার বিনিময়ে কাউকে দেয়া যায় ভাইয়া বলেন? আমি কি বাজারের পণ্য হয়ে গেছি ভাইয়া? আমার শরীর কি কোনো সেক্স টয়? 
আমাকে কেমন করে সৈকত এই কথা বলতে পারলো ভাইয়া? আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ___ 
বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে আফরিন!  

--আফরিন! এভাবে ভেঙে পরো না৷ আমি আছি তো। তোমাকে কাজের ব্যাবস্থা আমি করে দেবো। আর নয়তো যতদিন তোমার সরকারি চাকরি না হচ্ছে, আমি তোমার যাবতীয় খরচ দেবো। পরে চাকরি পেয়ে আস্তে আস্তে শোধ করে দিও। এখনো অনেক বয়স বাকি আছে তোমার। 
-- আমি গতকাল এইসব যন্ত্রণা মাথায় নিয়ে বাসায় ফিরেছি। আমার পুরো শরীর কাঁপছিলো। এর মধ্যে মা অমনভাবে মারলো! 
-- বুঝতে পেরেছি আফরিন! তোমার অনেক কষ্ট হয়েছিলো তখন। আমি ফিল করতে পারছি।
-- কিছুই বুঝতে পারেন নি। আমার মা আমাকে মারার সময় কি বলেছে জানেন? আমি রাক্ষসী! অপয়া! আমি নাকি সৌরভকে গিলে খেয়েছি! আমার অশুভ ছায়া পরে নাকি সৌরভ মারা গেছে। আমার কুলক্ষনেই সৌরভের বাবা মারা গেছে। আমি বেঁচে থাকলে আমার বাবাও নাকি মরে যাবে। 
-- ওসব বাজে কথা! কুসংস্কার। তুমি শান্ত হও আফরিন। 
-- আপনি বনলতা সেন কবিতার শেষ চার লাইন জানেন ভাইয়া?  
"সব পাখি ঘরে ফেলে, সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন। 
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার নাটরের বনলতা সেন! "
হ্যা ভাইয়া! শুধু অন্ধকারই আছে। আর কিচ্ছু নেই। আর আমি সেই অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছি। কোথাও একফোঁটা আলো নেই! কোথাও কেউ নেই!

Comments

    Please login to post comment. Login