**বিদায়ের সেই মুহূর্ত এবং এক নতুন পথচলা**
সময়টা ২০২৪ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে। সামনে অপেক্ষা করছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা, এক অজানা গন্তব্য। এর আগে কখনোই বাসার বাইরে দুই-তিন দিনের বেশি থাকা হয়নি, তাও হয়তো কোনো আত্মীয়ের বাসায়। কিন্তু এবার গল্পটা ছিল ভিন্ন। এবার যেতে হবে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরে, যেখানে নিজের বলতে শুধু আমি, পরিচিত একটাও মুখ নেই, আশেপাশের কোনো জেলাতেও নেই কেউ।
সময়ের সাথে সাথে বিদায়ের দিন ঘনিয়ে আসছিল। ২৬-২৭ তারিখের দিকে মনে অজানা এক শঙ্কা ঘুরপাক খাচ্ছিল—আমি কি পারবো? আম্মুও প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন, *"শিহাব, বাবা, তুই থাকতে পারবি তো?"* ছোট ভাইয়ের দুশ্চিন্তাটা আরও বেশি, সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলছিল, *"ভাইয়া, তুমি আমাকে ছেড়ে এতদূরে থাকতে পারবে? তুমি চলে গেলে আমি কার সাথে ঘুমাবো? তুমি যেও না, আমি তোমার থেকে আর ফোন চাইবো না!"* বন্ধুদের কথাও ছিল আবেগে ভরা, *"তুই চলে গেলে আমরা কাকে নিয়ে মজা করবো? আমাদের মধ্যে থেকে একজন মানুষ যেন হারিয়ে যাবে!"*
এই কথাগুলো শুনতে শুনতে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু শেষমেশ আর পারিনি। দরজা বন্ধ করে একা একাই কান্না করেছিলাম। একদিকে ছিল অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে প্রিয়জনদের ছেড়ে যাওয়ার বেদনা।
**বিদায়ের মুহূর্ত**
২৯ জানুয়ারি, ২০২৪। বিদায়ের দিন এসে গেল। সকাল থেকেই সবাই ব্যস্ত, আমার জামাকাপড় গুছিয়ে দিচ্ছে, আর আমি চুপচাপ ঘরের এক কোণে বসে আছি। বিকেল তিনটার দিকে আব্বু বললেন, *"চল শিহাব, তোকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসি।"* আমি কিছু না বলে ব্যাগ কাঁধে তুলে নিলাম।
হঠাৎ ছোট ভাই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, *"ভাইয়া, যেও না!"* আমার হৃদয় তখন একেবারে ভারী হয়ে উঠল। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু পারলাম না। কারণ আমি জানতাম, একবার যদি নিজেকে ভেঙে ফেলি, তাহলে কেউই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না।
ঘর থেকে বের হওয়ার সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় বললাম, **"আম্মু, আমি যাচ্ছি।"**
কোনো উত্তর এল না। একটু খেয়াল করতেই দেখি, দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন আমার মা। চোখে অশ্রু, কিন্তু মুখে হাসি। যেন এক অদৃশ্য শক্তি দিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছেন।
গাড়িতে ওঠার আগে আব্বু কপালে হাত বুলিয়ে বললেন, *"নতুন জায়গা, নতুন মানুষ—এখানেই তোকে মানিয়ে নিতে হবে। এমন কিছু করিস না, যাতে কেউ তোর পরিবার নিয়ে কিছু বলে!"*
আমি মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানালাম। এরপর গাড়ি চলতে শুরু করল, আর বাসা, মা, ছোট ভাই, সব কিছু ধীরে ধীরে দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেল।
**নতুন ক্যাম্পাস, নতুন জীবন**
নতুন ক্যাম্পাসে প্রথম কয়েকটা দিন যেন এক অচেনা যুদ্ধের মতো লাগছিল। চারপাশে মানুষ, কিন্তু কেউ পরিচিত নয়। একাকীত্বের ভার যেন প্রতিটি মুহূর্তে চেপে বসেছিল। নিজেকে অনেক সময় বেখেয়ালি লাগত, মনে হতো, ভুল জায়গায় চলে এসেছি।
কিন্তু এই অন্ধকার সময়েও কিছু মানুষ আলোর মতো পাশে এসে দাঁড়াল। ইয়ারমেট নামক কিছু ভাই, যারা বন্ধুর মতো সাহচর্য দিল, কিছু সিনিয়র, যারা আপন ভাইয়ের মতো পথ দেখাল, আর শিক্ষক নামক অভিভাবক, যারা বাবা-মায়ের অভাব পূরণ করলেন।
ওদের সবার সান্নিধ্যে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, আমি আর একা নই। আমি সত্যিই এক নতুন পরিবারের অংশ হয়ে গেছি।
**এক বছর পর—নতুন উপলব্ধি**
আজ ২৯ জানুয়ারি, ২০২৫। ঠিক এক বছর পূর্ণ হলো।
এতো বড় একটা সময়, অথচ মনে হয় যেন মুহূর্তেই কেটে গেল। সেই দিনগুলোতে যারা আমাকে হাসিখুশি থাকতে সাহায্য করেছে, যারা একাকীত্বে পাশে দাঁড়িয়েছে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাই না।
ইয়ারমেট, সিনিয়র ভাই, শিক্ষক—তোমাদের সবার জন্যই আজ আমি এখানে দাঁড়িয়ে। এই পথচলা হয়তো কঠিন ছিল, কিন্তু তোমাদের জন্যই আমি শিখেছি, **"বাসা থেকে দূরে থাকলেই একা হয়ে যায় না, কারণ পরিবার শুধু রক্তের সম্পর্কেই গড়ে ওঠে না, হৃদয়ের বন্ধনেও গড়ে ওঠে।"