গ্রামের ভূতের গল্প
সবে মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছি ।মন থেকে ভয় আর কুসংস্কার দূর হবার উপযুক্ত সময় ।এমন সময় মনে যেকে বসে নতুন ধরনের ভয় ।আমাদের গ্রামটি আমাদের ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় গ্রাম এবংএটি পূর্ব পশ্চিম একটু বেশিই লম্বা ।হঠাত্ করেই গ্রামের পূর্ব দিকে কলেরার প্রকোপ শুরু হয় ।বিগত ২৫ বছরে গ্রামে কলেরা ছিলনা ।সাতদিনের ভিতরে পূর্ব পাশের পাঁচজন মারা যায় ।অনেক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেবার পরও পূর্ব পাশের প্রতিটি বাড়ির কেউনা কেউ আক্রান্ত হতে লাগল ।রোগটি ধীরে ধীরে পশ্চিম পাড়ার দিকে আসতে লাগল (আমাদের বাড়িও পশ্চিম পাড়াতে) তখন পশ্চিম পাড়ার মাতব্বরেরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলো যে কবিরাজ এনে রাশ দেবার ব্যবস্থা করতে হবে ।যথারীতি কবিরাজ আনা হলো,কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা ।তখন আমাদের গ্রামের এক পুরাতন কবিরাজ যে কিনা অনেকদিন হলো ফরিদপুর চলে গেছে,তাকে নিয়ে আসা হলো ।সে এসেই ঘোষনা করে দিল যে রাত এগারোটার পর যেনো কেউ বাড়ির বাহিরে বের না হয় ।রাত দশটার দিকেই পাড়ার প্রতিটা মসজিদের মাইকে ঘোষনা করে দেওয়া হতো যে সবাই যেনো ঘরে চলে যায় ।আসলে মাইকে ঘোষনা দেবার প্রয়োজনই ছিলোনা ।কারন সবাই এতোটাই ভীত ছিল যে সন্ধ্যার সাথে সাথে বাড়ির সব কাজ সেরে ঘরে ঢুকে পড়ত ।আর চারিদিকে নেমে আসত এক অদ্ভূত নীরবতা ।এমনকি সন্ধ্যার পর গ্রামের দোকানগুলোওখোলা থাকত না ।এশার জামাতেও লোক হতো অনেক কম ।বাবা-মা আমাদেরকে বের হতে দিতেন না ।তারপরও আমরা মাঝে মাঝে লুকিয়ে বের হতাম ।দেখতাম কবিরাজ তার সাঙ্গপাঙ্গসহ মশাল জ্বালিয়ে ধূপের ধোঁয়া উড়িয়ে পাড়ার এমাথা ওমাথা দৌড়াদৌড়ি করতো আর একঅপার্থিব সুরে অদ্ভূদ সব মন্ত্র উচ্চারন করছে ।পরিবেশটা এতোটাই অদ্ভুদ আর ভয়াবহ ছিলযে ভাবলে এখনো ভয় লাগে ।কবিরাজ এক এক দিন এক এক মহল্লা বন্ধ করতেন,যাতে ঐ পাড়ায় কলেরা বা ওলাবিবি না ঢুকতে পারে ।এভাবে পাড়ার প্রায় সবগুলা মহল্লা বন্ধ করা হলো।এরই মাঝে একরাতে আমার মা শুনতে পান কে যেনো আমাদের বাড়ির গেটের ওপাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে উঃউঃউঃউঃ...করে কাঁদছে ।মা ভাবল কোনো মহিলা বোধহয় সমস্যায় পড়ে কাঁদছে ।আসলে মা তখন পরোপকারের নেশায় রাশের কথা খেয়াল ছিলনা ।মা ঘর হতে বের হয়ে যতই গেটের দিকে যাচ্ছিলেন ততই একটা পচা গন্ধ পাচ্ছিলেন,যা অনেকটা মলের গন্ধের মত,কিছুটা মাংস পঁচাগন্ধের মত ।মা যখন গেটের পাশে দাঁড়ান তখন গেটের ফাকঁ দিয়েদেখেন যে রাস্তার ওপাশে ইলেক্ট্রিক পোলের সাথে হেলান দিয়ে একটি বিশালাকার মহিলা দাঁড়িয়ে আছে যার উচ্চতা প্রায় সাত ফুটের এর মত ।এর গা থেকেই এমন গন্ধ বের হচ্ছিল ।মহিলার ভয়ংকর চেহারা দেখে মা কিছুটা পিছিয়ে আসেন ।মহিলাটি ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদছিল আর বলছিল "তোরা আমাকে থাকতে দিলিনা,এই গ্রাম আমার ভাল লাগছিল,আমার আরো লাশদরকার ছিল '' উঃউঃউঃ আমি আজই এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবো উঃউঃউঃ ।এমন সময় মাররাশের কথা মনে পড়ে যায় আর প্রচন্ড ভয় পেয়ে মা ঘরে চলে আসেন ।ঘটনাটা এখানেই শেষ না । মা একটি গ্রাম্য সমিতির প্রথান ।পরদিন সকালে কিস্তি দিতে এসে এক প্রতিবেশি(যিনি নৌকায় কাজ করেন)নাকিবলছিল কালকে রাতে একটা ভয়ের ব্যাপার ঘটেছিল ।মা জিঞ্জাসা করল কি ঘটনা ? তখন তিনি বলেনযে কাল রাতে খেপ থেকে আসার সময় দুই গ্রাম আগেই তাদের নৌকার তেল ফুড়িয়ে যায় ।তাই ১৩জন লেভারএর ৯জনই পাশের গ্রামে নেমে যায় ।তিনি যেহুতু নৌকার মালিক তাই তিনিসহ আরো তিনজন মিলে লগি মেরে মেরে নৌকাটা বাড়ির দিকে নিয়ে আসছিলেন ।এমন সময় তারা দেখেন কে যেনো গ্রামের শেষ মাথায় নদীর পাড়ে বসে আছে আর তাদেরকেই ডাকছে ।তারা ভাবল কোনো মহিলা হয়ত বিপদে পড়েছে ।তাই সাহায্য করার জন্য তাদের নৌকা পাড়ে ভিড়ান ।এমন সময় তাদের নাকেও পঁচা গন্ধটা লাগে ।তারা মনে করে পাশেই কোনো মরা জীবজন্তু নদীতে ভেসে এসেছে,এটা তারইগন্ধ ।তাই তারা গন্ধটাকে তেমন পাত্তা দিলোনা ।মহিলাটা বলল যে,তারা যদি তাকে নদীর ওপারে দিয়ে আসেতবে ভাল হয় ।তারা মহিলাকে নৌকায় উঠতে বলে । নৌকা যখন মাঝ নদীতে তখন দুর্গন্ধটা প্রকোট আকার ধারন করে ।তারাবুঝতে পারে গন্ধটা মহিলার গা থেকে আসছে।তারপরও তারা যখন মহিলার দিকে তাকাতে যায় তখন মহিলা বলে কেউ আমার দিকে তাকাবি না তাকালে ক্ষতি করে দিবো ।তাইভয়ে ভয়ে তারা মাথা নিচু করে ফেলে ।ওপারে নামিয়ে দেবার পর মহিলা বলে তোরা আমার উপকার করছিস তাই তোদের ক্ষতি করলাম না ।এটাবলেই মহিলা হাঁটতে থাকে ।এরপর হতে গ্রামের কেউ আর কলেরায় আক্রান্ত হয়নি ।মূল ঘটনা এখানেই শেষ ।