Posts

গল্প

সৎ বাবা

February 1, 2025

Arif Ali Mahmud

7
View
সৎ বাবা

      ঢাকা শহরের এক মধ্যবিত্ত এলাকায়, একটি ছোট্ট বাসায় তিন সদস্যের এক ছোট পরিবারের বসবাস। পরিবারের সদস্যরা হলেন—নীলা, তার মা রাবেয়া এবং রাবেয়ার স্বামী আসলাম। বছর পাঁচেক আগে নীলার বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে, আসলাম সাহেব রাবেয়াকে বিয়ে করেন। আসলাম সাহেব হলেন একজন সৎ চাকরিজীবী, এলাকার সবার প্রিয় একজন মানুষ; কিন্তু নীলার সঙ্গে তার সম্পর্ক শুরু থেকেই খানিকটা দূরত্বপূর্ণ।

      বর্তমানে নীলা একাদশ শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থী। নিজের বাবার কথা এখনও তার খুব মনে পড়ে। সময় পেলেই বাবার স্নেহের আকাঙ্ক্ষায় আনমনা হয়ে কী যেন ভাবতে থাকে। তাই শুরু থেকেই আসলাম সাহেবকে সে আপন করে নিতে পারেনি।

      একদিন, নীলা কলেজ থেকে ফেরার পথে হটাৎ বৃষ্টি শুরু হয়। প্রবল বৃষ্টির কারণে রাস্তা ফাঁকা আর অন্ধকার হয়ে আসে। এই সুযোগে এলাকার এক লম্পট নীলাকে সাহায্য করার নামে বিরক্ত করতে শুরু করে। এমন সময় আসলাম সাহেবও অফিস থেকে ফিরছিলেন। হঠাৎ তিনি সেখানে এসে হাজির হন।

      “এই ছেলে! আমার মেয়েকে বিরক্ত করছ কেন?” আসলাম সাহেবের কণ্ঠে দৃঢ়তা, “আর যদি কখনও এমন করতে দেখি, তাহলে তোমার ভালো হবে না বলে দিলাম!” —এই বলে তিনি নীলার হাত ধরে বাসায় নিয়ে আসেন। চলার পথে দু’জনের মুখে কোনও কথা ছিল না। তবে সেই মুহূর্তে নীলা অনুভব করে, এই মানুষটি, যাকে সে কখনওই সেভাবে আপন করে নিতে পারেনি, সত্যিই তার জন্য তার বাবার মতোই অনেক যত্নবান। এসব ভাবতে ভাবতে তার চোখ দুটো ভিজে গেল।

      বাড়ি ফিরে নীলা সরাসরি তার মায়ের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। তার মা ঘটনা কী জানতে চায়। তখন আসলাম সাহেব সব খুলে বলেন। শুনে রাবেয়া কিছুটা বিচলিত হলেও, বাবা-মেয়ের মাঝে এমন সখ্যতা দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলেন।

      নীলা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে উঠল, “থ্যাংক ইউ, বাবা।”

      নীলার মুখে এটা শুনে রাবেয়া বলেন, “তোমাদের এই সম্পর্কটাই তো আমার সব।”

      আসলাম সাহেব হেসে বলেন, “রক্তের সম্পর্ক না থাকলেই কি মনের সম্পর্ক হয় না?”

      পাশের বাড়ির মুনা খালা তখন কী একটা কাজে তাদের বাড়িতে এলেন। “সত্যি, এমন একজন সৎ বাবা পাওয়া বড় ভাগ্যের ব্যাপার।” এসব দেখে ও শুনে তিনি অবাক হয়ে বলেন, “অনেক মেয়ে আপন বাবার কাছ থেকেও এত ভালোবাসা পায় না।” মুনা খালা আরও যোগ করেন।

      সেদিন থেকে নীলা আসলাম সাহেবকে আর সৎ বাবা বলে ভাবে না; বরং মন থেকে “বাবা” বলে ডাকে। তাদের সম্পর্ক মধুর হয়ে ওঠে, যেন তা প্রকৃত বাবা-মেয়ের সম্পর্কের চেয়েও গভীর।

      এখন প্রতিদিন আসলাম সাহেব অফিস থেকে ফেরার পথে নীলাকে কলেজ থেকে নিয়ে বাড়ি আসেন। আর সেদিনের পর থেকে সেই লম্পট আর কোনওদিন নীলার সাথে দুষ্টুমি করার সাহস পায়নি।
 

      এভাবে তিন বছর কেটে গেল। এখন নীলার মা-বাবা তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে লাগলেন। পাত্র—আকাশ—অবশ্য নীলার নিজের পছন্দের। ভার্সিটিতে পড়তে পড়তে উভয়ের পরিচয়-বন্ধুত্ব-প্রেম।

      আসলাম সাহেব রাবেয়াকে বলেন, “নীলার বিয়ের পর বাড়িটা খা খা করবে। ওর জন্য সব সময় সারা বাড়ি আনন্দে ভরে থাকত।”

      রাবেয়া মৃদু হেসে বলেন, “কিন্তু এটাই যে নিয়ম। না চাইলেও মেয়েদের একদিন বাবার বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়। আর ওর জন্য তো তুমি নিজের কোনও সন্তান নিলে না। তাই বাড়ি তো খালি থাকবেই।”

      “মানুষের মতো মানুষ করতে পারলে একটি সন্তানই তো যথেষ্ট। তাছাড়া, আমি তো ওকে সব সময় নিজের সন্তান হিসেবেই ভালোবেসেছি।” হেসে জবাব দিলেন আসলাম সাহেব।

      “সত্যিই তোমার মতো মানুষেরা আছে বলেই পৃথিবীটা আজও এত সুখময় মনে হয়।” আসলাম সাহেবের কাঁধে মাথা রাখতে রাখতে বললেন রাবেয়া।
 

      একদিন পারিবারিকভাবে খুব ধুমধামের সাথে নীলা এবং আকাশের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর, এক পূর্ণিমার রাতে, বারান্দায় বসে গল্প করতে করতে আকাশ নীলাকে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা নীলা, যদি আমি হঠাৎ মরে যাই, তাহলে তুমি কী করবে?”

      আকাশের মুখে এমন কথা শুনে নীলা তার মুখ চেপে ধরে বলল, “এভাবে বলে না। আমরা একসাথে বাঁচব, একসাথে মরব।”

      “তারপরও বলো না।” আকাশ একটু জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করল।

      নীলা গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলো, “আমি চাই না তুমি আমার আগে মরে যাও। আমি চাই না তোমার পর অন্য কাউকে বিয়ে করতে। আমি আমার মা’কে দেখেছি, আমার বাবা চলে যাওয়ার পর তাকে কত অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে।” —বলতে বলতে নীলার গলা ভারী হয়ে গেল, “যদি আমার এই বাবা না হতেন, তাহলে হয়তো আমার মা-ও আমাকে ছেড়ে চলে যেতেন। সবাই এমন স্বামী পায় না। সবার ভাগ্যে এমন বাবা জোটে না। তাই আমি চাই না আমাদের সন্তান কোনও মন্দ সৎ বাবা পাক। আর আমার একার পক্ষে আমাদের সন্তানকে মানুষ করা সম্ভব হবে না। তাই আমরা দু’জন অনেক বছর বাঁচতে চাই; তারপর একসাথে মরতে চাই।”

      নীলার এসব কথা শুনে আকাশ হাসল, আর বলল, “যাহ! পাগলি, আমি তো দুষ্টুমি করেছি। আমিও চাই না তোমাকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। আমি মরে গেলে তোমাকে কাতুকুতু দেবে কে?” —এই বলে সে নীলাকে কাতুকুতু দিতে দিতে বুকে জড়িয়ে ধরল। আর নীলা হাসতে হাসতে স্বামীর বুকে মাথা রেখে আনমনে চোখের জল ফেলতে লাগল, আর তার চোখের জলে আকাশের নীল রঙা শার্ট ভিজতে থাকল।

Comments

    Please login to post comment. Login