"অভিমান"
রাত তখন প্রায় তিনটা। নিরব নিস্তব্ধতার মাঝে শুধু ঘড়ির টিকটিক শব্দ। জানালার ফাঁক গলে চাঁদের আলো ঘরে পড়েছে, যেন কেউ নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে। বিছানায় বসে থাকা ছেলেটির চোখে জল, হাতে একটা পুরনো চিঠি। নাম তার আদিব।
এই চিঠিটা সে বহু বছর ধরে যত্ন করে রেখেছে, যেন একটা স্পর্শে সব স্মৃতি আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে। চিঠিটা লিখেছিল তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, তার প্রাণের মানুষ, সায়মা।
অতীতের পাতায় ফিরে যাওয়া
সায়মা আর আদিব ছোটবেলা থেকেই বন্ধু। একসঙ্গে খেলাধুলা, একসঙ্গে পড়াশোনা, একসঙ্গে স্বপ্ন দেখা—সবই করত তারা। কিন্তু একটা সময় সব বদলে গেল।
আদিবের বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী, তাই পরিবারের সবাই চেয়েছিলেন সে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাবে। কিন্তু আদিবের মন পড়ে থাকত সায়মার কাছে। তার বাবা-মা এটাকে ছোট ছেলের ছেলেমানুষি ভেবে অবহেলা করত।
বিদেশ যাওয়ার আগের দিন সন্ধ্যায় সায়মা এসেছিল দেখা করতে। দু’জন নদীর ধারে গিয়ে বসে। চাঁদের আলো পড়ে নদীর জলে ঝিলিক দিচ্ছিল।
সায়মা খুব শান্ত গলায় বলল,
— "তুই কি সত্যি চলে যাবি?"
আদিব হেসে বলল,
— "হ্যাঁ রে! বড় হতে হলে তো বাইরে যেতেই হবে। তোকে তো আমি কথা দিয়েছি, ফিরে এসে তোকে একদিন সারপ্রাইজ দেব!"
সায়মার চোখ ছলছল করছিল। সে বলল,
— "আমি জানি, তুই ফিরবি না... ফিরলেও আমি তোর কাছে থাকব না।"
আদিব অবাক হয়ে বলল,
— "এইসব পাগলামি করছিস কেন?"
সায়মা হেসে বলল,
— "আমি তোর জন্য অপেক্ষা করব না। আমি চাই তুই সফল হোস, তুই অনেক বড় হোস। কিন্তু তুই জানিস? আমি চাইনি তুই চলে যা। আমি চাইনি আমাদের এত বছর ধরে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব দূরত্বের মাঝে হারিয়ে যাক।"
এই কথাগুলো বলে সে উঠে পড়ল, আর শেষবারের মতো তাকিয়ে বলল,
— "ভালো থাকিস, আদিব।"
সেদিনের সেই বিদায়টা ছিল কেমন যেন এক অদ্ভুত। এরপর বিদেশ যাওয়ার পর আদিব অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ধীরে ধীরে চিঠির উত্তর দেওয়া কমে গেল, ফোন করা কমে গেল। জীবন এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে বন্ধুত্বটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
বর্তমানের বেদনা
আদিব আজ দেশে ফিরে এসেছে, অনেক বছর পর। অনেক খোঁজ করেও সায়মাকে আর পায়নি। বন্ধুরা বলল, সায়মা বিয়ে করে অন্য শহরে চলে গেছে।
তারপর একদিন পুরনো কিছু বই ঘাঁটতে গিয়ে এই চিঠিটা পেল। চিঠির শেষের লাইনটা পড়ে তার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল—
"তুই হয়তো ভুলে যাবি, কিন্তু আমি তোকে কখনো ভুলব না। তোর জন্য আমার কোনো অভিমান নেই, শুধু একটা শূন্যতা আছে।"
চোখের কোনা ভিজে উঠল আদিবের। সবকিছু থাকতেও কেন যেন নিজেকে একেবারে শূন্য মনে হচ্ছিল। হয়তো কিছু সম্পর্ক দূরত্বে নয়, অবহেলায় হারিয়ে যায়।
সেই রাতে, জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঠিক আগের মতোই পড়ছিল, কিন্তু আজ তা যেন বেশি মলিন লাগছিল…