সন্ধ্যার আলো তখনো পুরোপুরি নিভে যায়নি। গোধূলির লালচে আলোয় পুরো শহরটা কেমন যেন সোনালি রঙে রঙিন হয়ে আছে। রাস্তার ধারে একটা বেঞ্চে বসে আছে ফাহিম। তার হাতে একটা চিঠি, চোখে অদ্ভুত এক শূন্যতা।
চিঠিটা লাবণীর লেখা। লাবণী—যে ছিল তার জীবনের সবচেয়ে আপন মানুষ, তার হৃদয়ের সবচেয়ে নরম কোণটা যার জন্য সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু আজ, এই চিঠিটাই যেন তার বুকের মাঝে হাজারটা ছুরির মতো বিঁধে যাচ্ছে।
ফাহিম আর লাবণী ছোটবেলা থেকেই বন্ধু। একই স্কুলে পড়া, একসঙ্গে খেলাধুলা করা, একই স্বপ্ন দেখা—সব কিছুতেই তারা একে অপরের ছায়াসঙ্গী ছিল। কলেজে ওঠার পর তাদের বন্ধুত্ব আরও গভীর হলো, যেন এক অদৃশ্য বন্ধনে তারা জড়িয়ে গেল।
কিন্তু কখন যে বন্ধুত্বটা ভালোবাসায় পরিণত হলো, তা তারা নিজেরাও জানে না। লাবণীর হাসি ছিল ফাহিমের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস, আর ফাহিমের কেয়ারলেস অথচ যত্নশীল আচরণ লাবণীর মনে তৈরি করেছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি।
একদিন বিকেলে কলেজের মাঠে বসে লাবণী হেসে বলল,
— "তুই জানিস, আমার ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন, এমন একজন মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাব, যে আমার প্রতিটা ছোট ছোট অনুভূতি বুঝবে!"
ফাহিম মুচকি হেসে বলল,
— "তাহলে তোর স্বপ্ন তো পূরণ হয়ে গেছে! কারণ আমি তোর প্রতিটা অনুভূতি বুঝি!"
লাবণী একটু থমকে গেল। তারপর হালকা স্বরে বলল,
— "তুই কি জানিস, আমি কখনও তোর থেকে দূরে যেতে চাই না?"
ফাহিম মৃদু হাসল,
— "আমিও তোকে কখনো হারাতে চাই না।"
সেদিন তারা কেউ কাউকে সরাসরি ভালোবাসার কথা বলেনি। কিন্তু দু'জনেই জানত, তারা একে অপরের জন্যই তৈরি।
জীবন সব সময় কারও ইচ্ছামতো চলে না। ভালোবাসার গল্পগুলোও সবসময় সুন্দর পরিণতি পায় না।
ফাহিম যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য অন্য শহরে চলে গেল, তখন থেকেই দূরত্বটা তৈরি হতে লাগল। প্রথমদিকে প্রতিদিন ফোনে কথা হতো, মেসেজ আদান-প্রদান চলত। কিন্তু ধীরে ধীরে ব্যস্ততা বেড়ে গেল, সময়ের অভাবে যোগাযোগ কমে গেল।
একদিন লাবণী অনেক অপেক্ষার পর ফাহিমকে ফোন করল। ওপাশ থেকে ক্লান্ত গলায় ফাহিম বলল,
— "লাবণী, আমি অনেক ব্যস্ত, পরে কথা বলি?"
সেদিন লাবণীর মন ভেঙে গিয়েছিল। সেই রাতে সে বুঝতে পারল, ফাহিমের জীবনে এখন অনেক কিছু আছে, শুধু তার জন্য সময় নেই।
এভাবেই সময় গড়িয়ে গেল। লাবণীর জন্মদিন এল, কিন্তু ফাহিম ভুলে গেল। লাবণী ফোন করল না, মেসেজও দিল না। শুধু অপেক্ষা করল…
কিন্তু অপেক্ষারও একটা সীমা থাকে।
একদিন বিকেলে লাবণী আর ফাহিম দেখা করল। লাবণী হেসে বলল,
— "তুই অনেক বদলে গেছিস!"
ফাহিম একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
— "না রে, জীবনটাই বদলে গেছে। ব্যস্ততা বেড়ে গেছে, পড়াশোনা, কাজ… সময় কোথায়?"
লাবণী কষ্ট চেপে হাসল। তারপর ধীরে বলল,
— "ঠিক আছে, ভালো থাকিস।"
সেদিনের সেই হাসিটা ছিল বিদায়ের হাসি।
তারপর ফাহিম ব্যস্ত হয়ে পড়ল জীবনের দৌড়ে। চাকরি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা—সবকিছু নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে আর লাবণীর কথা মনে পড়েনি।
কিন্তু লাবণী?
সে প্রতিদিন অপেক্ষা করত, একটা ফোন কলের জন্য,