"অপেক্ষার শেষ প্রহর"
পাহাড়ের ওপাশে ছোট্ট একটা গ্রাম, নাম অরুণপুর। এই গ্রামেই বাস করত নিরুপম আর রুপা। ছেলেবেলার বন্ধুত্ব থেকে একসঙ্গে পথ চলার স্বপ্ন দেখা, সবই হয়েছিল তাদের। কিন্তু ভাগ্য কখনো কখনো মানুষের গল্পটা নিজের মতো করে লিখে ফেলে।
নিরুপম ছিল খুবই সাধারণ একটা ছেলে। বাবা-মা ছোটবেলায় মারা গিয়েছিল, তাই কাকা-কাকির কাছে বড় হয়েছে। লেখাপড়ায় ভালো ছিল, স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে ডাক্তার হবে। আর রুপা ছিল গ্রামের সবচেয়ে প্রাণোচ্ছল মেয়ে, হাসিতে যার মুখ ভরে থাকত সবসময়।
একদিন নিরুপম মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় পাস করল। শহরে চলে যেতে হবে পড়তে। রুপার চোখে জল— "তুমি কি ফিরে আসবে?"
নিরুপম হেসে বলেছিল, "অবশ্যই আসব! আমাদের গল্প তো এখনো শেষ হয়নি!"
রুপা অপেক্ষা করতে লাগল। চিঠি লিখত প্রতিদিন, কিন্তু কোনো উত্তর আসত না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের মানুষ বলাবলি শুরু করল— "নিরুপম কি আর ফিরবে? শহরের মানুষ শহরেই থেকে যায়।"
দিন, মাস, বছর পেরিয়ে গেল। রুপা অপেক্ষা করতে করতে একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে সে কথা বলাও বন্ধ করে দিল, শুধু জানালার পাশে বসে থাকত, যেন কোনো একদিন নিরুপম এসে দাঁড়াবে তার সামনে।
একদিন ডাক এল— "নিরুপম এসেছে!"
রুপা ছুটে বেরোল না। সে তখন একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেছে, শুয়ে আছে খাটে। নিরুপম এসে তার পাশে বসল, কাঁদতে কাঁদতে বলল, "রুপা, আমি তোমার চিঠিগুলো পড়েছি, কিন্তু ফিরতে পারিনি... অনেক দেরি হয়ে গেছে, তাই না?"
রুপা খুব কষ্ট করে হাত বাড়িয়ে দিল। নিরুপম তার হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
সেই রাতেই রুপা চলে গেল চিরতরে।
নিরুপম সেদিনই সিদ্ধান্ত নিল, আর কোনোদিন শহরে ফিরে যাবে না। সারা জীবন এই গ্রামেই কাটিয়ে দেবে। সে রুপার সমস্ত চিঠি নিজের বুকে চেপে ধরে একাকী বসে থাকত রুপার ঘরে, জানালার পাশে।
গ্রামের মানুষরা বলে, নিরুপম আর হাসতো না, কারও সঙ্গে কথা বলত না। একদিন সবাই দেখল, জানালার পাশে নিরুপম চুপচাপ বসে আছে, তার হাতের মুঠোয় ধরা রুপার শেষ চিঠি—
"তুমি ফিরবে তো?"
কেউ আর জানল না, সে কখন চলে গেছে। শুধু দুটো নিঃসঙ্গ আত্মা হয়তো কোথাও আবার এক হয়েছে।