ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই রফিক সাহেব উঠে পড়েন। চৌকির নিচে হাত দিয়ে মাটির হাঁড়ি বের করেন। হাঁড়ির মুখে শক্ত করে বাঁধা এক টুকরো পুরনো কাপড়, যেন তার ভেতরের সম্পদ কেউ চুরি করতে না পারে। কাপড়টা সরিয়ে তিনি এক মুঠো ধান হাতে তুলে নেন। চশমার কাচ ঘোলাটে হয়ে গেছে, চোখের কোণে জমে থাকা পানি মোছেন। তারপর ধানগুলো হাতে নিয়ে মৃদু স্বরে বলে ওঠেন, “এগুলোই তো ছিল আমার রোজগার... আমার রাবেয়া, আমার সোনা মেয়ের জন্য।”
রাবেয়া, তার একমাত্র মেয়ে। মা নেই, বাবাই সবকিছু। রাবেয়ার মা চলে গেছে পাঁচ বছর আগে, এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায়। রাবেয়া তখন কেবল দশ বছরের শিশু, কিছুই বোঝেনি। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন বুঝতে শিখল, তখন বাবার চোখের জলই তার সবচেয়ে বড়ো শিক্ষক হয়ে উঠল।
রফিক সাহেব দিনমজুর। বয়স হয়ে গেছে, আগের মতো খাটতে পারেন না। কিন্তু মেয়ে মানুষ করছে একা, তাকে তো কিছুতেই দমে গেলে চলবে না! ভোরবেলা মাঠে যান, অন্যের জমিতে কাজ করেন, সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন কাঁধে ভারী গামছা আর ক্লান্ত শরীর নিয়ে। কিন্তু মেয়ে যখন হাসিমুখে বলে, “বাবা, আজ স্কুলে আমাদের নতুন বই দিয়েছে!”—তখন যেন সমস্ত ক্লান্তি কোথায় উধাও হয়ে যায়!
রাবেয়া পড়াশোনায় ভালো। বাবা চায় মেয়েটা বড়ো হোক, যেন কষ্ট করতে না হয়। কিন্তু এই দারিদ্র্যের মাঝে স্বপ্নের দাম অনেক বেশি। মেয়ের স্কুল ফি জোগাতে গিয়ে বহুদিন নিজের জন্য নতুন কাপড় কেনেননি তিনি। পায়ের স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেছে? সমস্যা নেই! পুরনো দড়ি দিয়ে জুড়ে নিলেন।
হঠাৎ এক ঝড় এসে সব ওলটপালট করে দিলো...
সেই রাতটা ছিল অন্ধকার। বাইরে কালবৈশাখীর হাহাকার। রাবেয়া বাবার পাশে বসে গল্প করছিল, হঠাৎ কাশতে শুরু করল। প্রথমে সামান্যই মনে হয়েছিল, কিন্তু তারপর কাশির সাথে রক্ত উঠল!
রফিক সাহেব পাগলের মতো ওকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটেন। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর ডাক্তার বলেন, “রোগ অনেক আগেই বাসা বেঁধেছে। এখন চিকিৎসা দরকার, নইলে মেয়েকে বাঁচানো যাবে না।”
চিকিৎসা দরকার, অনেক টাকা দরকার! কিন্তু টাকা আসবে কোত্থেকে?
তিনি যে কাজ করেন, তার মজুরি দিনে ২০০-২৫০ টাকা! ডাক্তার বললেন, “কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে।” পঞ্চাশ হাজার! তার কাছে তো পঞ্চাশ টাকাও নেই।
এদিকে রাবেয়ার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। মেয়েটা বাবার হাত শক্ত করে ধরে বলল, “বাবা, আমি ভালো হয়ে যাব, তাই না?”
রফিক সাহেব গলা শুকিয়ে আসে। চোখের পানি আটকে রেখে বলেন, “হ্যাঁ মা, তুই ঠিক হয়ে যাবি। আমি তোকে নিয়ে অনেক দূর যাব, তোর স্বপ্ন সত্যি হবে।”
তিনি সাহায্যের জন্য অনেকের কাছে গেলেন। কেউ পাঁচশো দিল, কেউ এক হাজার। কিন্তু মোট টাকার কাছে এই সাহায্য ছিল তুচ্ছ। তিনি জমির মালিকের কাছে গেলেন, বললেন, “হুজুর, আমার মেয়েটা মরে যাবে, আমার অগ্রিম বেতন দেন!”
কিন্তু মালিক বললেন, “আমার পক্ষে সম্ভব না রফিক, তোকে যদি টাকা দিই, তাহলে আমি চলব কী করে?”
তিনদিন পর...
রাবেয়ার অবস্থা আরও খারাপ হলো। বাবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “বাবা, কষ্ট কোরো না তো... আমি জানি তুমি অনেক চেষ্টা করেছো।”
কিন্তু এই কথাই যেন বাবার বুক ছিঁড়ে দিল!
সেদিন রফিক লেন, তা গ্রামে সবাই মনে রেখেছিল অনেকদিন। তিনি নিজের শরীর বিক্রি করে দিলেন!
হ্যাঁ, গ্রামের ধনী মহাজনকে বললেন, “আমার একটা কিডনি নিয়ে নেন, আমার মেয়েকে বাঁচান!”
মহাজন রাজি হলো, কিন্তু টাকা দিল মাত্র ত্রিশ হাজার।
রাবেয়ার অপারেশন হলো। প্রথম দিকে ভালোই ছিল, কিন্তু শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে গেল। রফিক সাহেব কেবল তার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “মা, তুই ভালো হয়ে যা, আমার কিছু হবে না।”
রাবেয়া কিছু বলল না। শুধু বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল, “বাবা, আমি যদি না থাকি, তুমি কষ্ট পেও না...”
রফিক সাহেব কান্খতে পারলেন না।
সেই রাতেই রাবেয়া চলে গেল...
বাবা কেবল মেয়ের ঠান্ডা হাত ধরে বসে রইলেন। তার বুক ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু কান্না আসছে না। চোখের পানি যেন শুকিয়ে গেছে।
গ্রামের লোকজন জানত, বাবা-মেয়ে ছিল একে অপরের ছায়া। কিন্তু রাবেয়ার মৃত্যুর তিনদিন পর দেখা গেল, রফিক সাহেবও আর নেই। কেউ জানে না, কিভাবে মারা গেলেন। কেউ বলে, তিনি খাবার খাননি, দুঃখে মারা গেছেন। কেউ বলে, বুকের ব্যথায় হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।
কিন্তু সবচেয়ে সত্যি কথা হলো, এক বাবা তার মেয়ে ছাড়া বাঁচতে পারেনি!
বাড়ির ভেতর সেই মাটির হাঁড়িটা এখনো রয়ে গেছে। ভেতরে কিছু ধান পড়ে আছে... যা ছিল রাবেয়ার জন্য।