লিখনিতে: সাদমান সৌমিক
রুদ্র আর নীলিমা—এই দুটো নাম যেন একসঙ্গে থাকতেই তৈরি হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনেই পরিচয় হয়েছিল তাদের। রুদ্র ছিল শান্ত স্বভাবের, একটু গম্ভীর, আর নীলিমা ছিল রঙিন বসন্তের মতো—অবিরাম কথা বলা, হাসি-ঠাট্টায় মেতে থাকা এক প্রাণোচ্ছল মেয়ে।
নীলিমার জীবন ছিল অগোছালো, কিন্তু তার প্রতিটা এলোমেলো কথার মধ্যেই ছিল অদ্ভুত এক আকর্ষণ। আর রুদ্র? সে ছিল ঠিক তার উল্টো—গোছানো, হিসেবি, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। তবুও কী এক অদ্ভুত কারণে তাদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল, যা ধীরে ধীরে রূপ নিল এক অন্যরকম অনুভূতিতে।
এক সন্ধ্যায়, ক্যাম্পাসের সেই পুরনো অশ্বত্থ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নীলিমা হঠাৎই বলে উঠল,
—"রুদ্র, ভালোবাসা কী জানিস?"
রুদ্র অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে, মৃদু হেসে বলল,
—"তুই কী বলতে চাস?"
নীলিমা গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
—"আমি তোর প্রেমে পড়েছি, রুদ্র!"
রুদ্র কিছু বলল না। সে জানত, এই সম্পর্কটা সহজ নয়। তার পরিবার, ভবিষ্যৎ, সমাজ—সবকিছু মিলিয়ে এই সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া যাবে না। কিন্তু তার মন? সে তো বহু আগেই নীলিমার হাসির মধ্যে ডুবে গিয়েছিল!
সেদিনের পর থেকে তাদের সম্পর্কটা বদলে গেল। বন্ধুত্বের জায়গাটা আরও গভীর হলো, কিন্তু একটা ভয় রুদ্রের মনকে কুরে কুরে খেতে লাগল—এই সম্পর্ক টিকবে তো?
নীলিমা ছিল স্বাধীনচেতা, সে কোনো কিছুর পরোয়া করত না। কিন্তু রুদ্র দায়িত্ববান, পরিবার ও সমাজের চাপ তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
একদিন নীলিমা বলল,
—"রুদ্র, যদি তোর পরিবার আমাদের সম্পর্ক মেনে না নেয়?"
রুদ্র চুপ করে থাকল।
নীলিমা তার হাত ধরে বলল,
—"আমাদের ভালোবাসাটা কি তার চেয়ে ছোট?"
কিন্তু বাস্তবতা ভালোবাসার চেয়ে কঠিন ছিল।
রুদ্রের বাবা-মা কখনোই চাইবে না সে নীলিমাকে বিয়ে করুক। কারণ তাদের সামাজিক অবস্থান ছিল আলাদা, পারিবারিক পার্থক্য ছিল চোখে পড়ার মতো।
একদিন, রুদ্র সাহস করে তার বাবার সামনে নীলিমার কথা তুলল।
—"বাবা, আমি নীলিমাকে ভালোবাসি। আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।"
তার বাবা রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,
—"তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? ওই মেয়ের সঙ্গে তোর কোনো ভবিষ্যৎ নেই! সমাজ কী বলবে? আমাদের আত্মীয়রা কী ভাববে?"
রুদ্র জানত, এই বাধা সে কাটিয়ে উঠতে পারবে না।
নীলিমা সব বুঝতে পারছিল। কিন্তু তবুও সে অপেক্ষা করেছিল। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। কিন্তু একদিন রুদ্র আর কোনো খোঁজ নিল না।
সেদিন সন্ধ্যায় নীলিমা শেষবারের মতো তাকে একটা চিঠি লিখল—
*"রুদ্র,
তুই আমাকে ভালোবাসিস, এটা জানি। কিন্তু তুই সাহসী না, এটা আরও ভালো করে জানি। আমি তোকে ধরে রাখতে চাইনি, শুধু চাইছিলাম, তুই একবার আমার জন্য লড়বি। কিন্তু তুই লড়তে পারলি না। তাই আমি চলে যাচ্ছি। ভালো থাকিস।"*
সেই চিঠিটা রুদ্র পেয়েছিল, কিন্তু পড়তে পড়তেই তার চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল।
সে দৌড়ে গিয়েছিল নীলিমার বাসায়, কিন্তু তখন খুব দেরি হয়ে গেছে। নীলিমা শহর ছেড়ে চলে গেছে। কোথায়, কেউ জানে না।
অনেক বছর পর, একদিন রুদ্র কলকাতার এক পুরনো বইয়ের দোকানে ঢুকল। বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ একটা চেনা গন্ধ পেল—শিউলির গন্ধ।
সে পিছন ফিরে তাকাল।
নীলিমা দাঁড়িয়ে আছে, চোখে পুরনো দিনের ছায়া।
রুদ্র আস্তে করে বলল,
—"কেমন আছিস?"
নীলিমা মৃদু হাসল, চোখে জল টলমল করছিল।
—"ভালো আছি, রুদ্র। তুই?"
রুদ্র কিছু বলল না। কারণ তার উত্তরটা আর দরকার ছিল না। তারা দুজনেই জানত—ভালো থাকা আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য অনেক বড়।
*(শেষ।)*