গল্প: অদৃশ্য শূন্যতা
(১) অদ্ভুত অভ্যস্ততা
অনিকেত কখনো ভাবেনি যে, তার জীবনে একদিন এমন এক মুহূর্ত আসবে যেখানে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে। সে ছিল এক সফল কর্পোরেট চাকুরে, খুব পরিচিত মুখ, সবকিছুই সঠিক জায়গায় ছিল। তবে, কিছু দিন আগে, কিছু অদ্ভুত অনুভূতি তাকে তাড়া করতে শুরু করেছিল। বোধহয় তার জীবন, সেই প্রাচীন কাঠামোর মধ্যেই আটকে পড়েছিল—যে কাঠামো তাকে দিনশেষে কেবল শূন্যতা দিচ্ছিল। চাকরি, বাড়ি, গাড়ি—সব কিছু ছিল, তবে সে কখনোই অনুভব করছিল না যে সে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে।
এই শূন্যতার মধ্যে, একটা অদ্ভুত অভ্যস্ততায় জীবন চলে যাচ্ছিল। প্রতিদিন অফিসে যাওয়া, একই পুরনো কাজ করা, বাড়ি ফিরে একই রুটিনে সময় কাটানো—সব কিছু যেন একটানা চলছিল। কিন্তু একদিন, অফিস থেকে ফিরে, সে দেখল তার প্রতিবেশী মেয়ে—শিলা, যার সঙ্গে সে প্রায়ই কথা বলত না, কিন্তু আজ তার চোখে ছিল একটা অতৃপ্তি।
শিলা এক অদ্ভুত প্রশ্ন করল, "তুমি কি কখনো ভেবেছো যে, আমরা কেন বেঁচে আছি?"
অনিকেত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। প্রশ্নটা তাকে ভাবিয়ে তুলল। কেন? কেন তার জীবনে সত্যিকার কোনো উদ্দেশ্য নেই?
(২) একটি নতুন পথের সংকেত
এরপরের দিনগুলোতে অনিকেতকে বারবার সেই প্রশ্নটি তাড়া করতে থাকল। অফিসের কাজের চাপ, প্রতিযোগিতা, ছুটির দিনেও কাটিয়ে দেয়া সময়—সবই যেন একধরনের যন্ত্রণা হয়ে উঠল। তার মন ছিল অস্থির, অস্থিরতা যেন তার ভেতর থেকে বের হতে চাইছিল। এক রাতে, খুব অদ্ভুতভাবে, তার ফোনে একটি ম্যাসেজ এল। পাঠিয়েছিল রুদ্র—তাদের পুরনো বন্ধু, যার সঙ্গে কয়েক বছর ধরে যোগাযোগ ছিল না। ম্যাসেজে ছিল, "তুই কি জীবনে কোনো চ্যালেঞ্জ নিতে চাস? তুই কি কখনো ভেবেছিস, একটা নতুন জীবন শুরু করার ব্যাপারে?"
অনিকেতের মাথায় অনেক চিন্তা ঘুরতে লাগল। কি হবে যদি সে জীবনের সঠিক পথে না চলে? যদি সে কিছু পাল্টায়? কিন্তু সে জানতো, এই মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তার জীবন অজানা পথে চলে যাবে। কিন্তু সে ভয় পেত না, বরং তার ভেতরে এক নতুন জিজ্ঞাসা জন্ম নিল।
(৩) অস্বস্তিকর সিদ্ধান্ত
অনিকেত তখন সিদ্ধান্ত নিল, সে পরিবর্তন আনবে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার পুরনো জীবন ছেড়ে নতুন কিছু করতে, রুদ্রের প্রস্তাব গ্রহণ করবে। এই সিদ্ধান্তের পর, তার সমস্ত জীবনটাই যেন বদলে গেল। এক সপ্তাহ পর, সে চাকরি ছেড়ে দিল এবং রুদ্রের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করল। তবে, শুরুর পর থেকেই বুঝতে পারছিল—ব্যবসা এত সহজ না, প্রচণ্ড চাপ ছিল। প্রতিযোগিতা, অর্থনৈতিক অস্থিরতা, এবং কখনো কখনো নিজের আত্মবিশ্বাসের অভাব—সবই ছিল তার সামনে।
(৪) অপ্রত্যাশিত বিপদ
তবে একদিন, যখন সব কিছুই অস্থিরতার মধ্যে চলে গিয়েছিল, তখন এক ভয়াবহ বিপদ আসল—রুদ্র অদৃশ্যভাবে তার ব্যবসা থেকে বের হয়ে গেল। এক রাতে, রুদ্র তার সমস্ত সম্পদ, এবং তাদের প্রতিষ্ঠানের তথ্য নিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেল। অবাক হয়ে, অনিকেত বুঝতে পারছিল না কী হবে। সে একা, পুরোপুরি একা, এখন আর তার পাশে কেউ ছিল না। কিন্তু তখনই, শিলা আবার তার কাছে এসে দাঁড়াল।
শিলা বলল, "জীবন কখনো পরিকল্পনা মাফিক চলে না, অনিকেত। তুমি যা ভাবতে, তা কখনোই ঠিকঠাক হয় না। তবে, তোমার পথ এখন একদম নতুন। তুমি কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসবে, সেটাই তোমার আসল পরীক্ষা।"
(৫) অন্ধকারের মাঝে আলোর সন্ধান
অনিকেত বুঝতে পারল—এই মুহূর্তে তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল না শুধু ব্যবসা, বরং নিজেকে আরেকবার খুঁজে পাওয়া। সে শিলাকে প্রশ্ন করল, "কীভাবে? কীভাবে আমি আবার দাঁড়িয়ে যেতে পারি?"
শিলা সান্ত্বনা দিয়ে বলল, "তুমি যদি জীবনের মধ্যে নিজের ভয়গুলো দেখো, তুমি তখনই আলোর দিকে এগোবে।"
এই কথাগুলো তার মনে স্থির হয়ে গেল। সে জানত, জীবনটা আর পুরনো রুটিনে ফেরানো সম্ভব নয়। তাকে এগিয়ে যেতে হবে, যেখানেই সে যাবে। তার মধ্যে এক নতুন শক্তি জাগ্রত হলো। সে আবার ব্যবসার পথে ফিরতে শুরু করল, এইবার কোনো ভয়ের না, শুধুমাত্র নিজের বিশ্বাসে ভর করে।
(৬) জীবনের নতুন উদ্দেশ্য
বছরের পর বছর, অনিকেত তার ব্যবসা নতুনভাবে দাঁড় করাল। তবে, শুধু ব্যবসা নয়, সে শিখেছিল—জীবনের আসল উদ্দেশ্য শুধুমাত্র অর্থ উপার্জন বা সফলতা নয়, বরং একাধিক অজানা পথের মধ্য দিয়ে নিজেকে খুঁজে বের করা। সে জানত, যাত্রার মাঝে যতই অন্ধকার আসুক না কেন, সেই অন্ধকারই একদিন আলোর পথে পরিণত হবে।