Posts

গল্প

গল্প: হারানো স্বপ্নের শঙ্খ

February 4, 2025

Akash Ulal

143
View

গল্প: হারানো স্বপ্নের শঙ্খ

(১) দুঃখের আঁধারে হারানো স্বপ্ন

মাহফুজের জীবনে কোনো আলোর দিশা ছিল না। গ্রামটির এক কোণায়, এক ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে তার পরিবার বাস করত। বাবা-মা দুজনেই ছিলেন গরীব শ্রমিক, যারা প্রতিদিন সকালে উঠে, নিজের শরীরকে পিষে কাজ করতেন, কিন্তু তাদের জীবন ছিল শুধুই সংগ্রাম। খাওয়ার জন্যও যুদ্ধ করতে হত। মাঝে মাঝে রাতে, সে শুনতে পেত তার মায়ের দীর্ঘশ্বাস। তবে, মাহফুজের মাঝে কিছুটা আলোর ঝিলিক ছিল—সে জানতো, একদিন তার জীবনে কিছু ভালো হবে, তবে কখন সেটা হবে, সে জানতো না।

এবং সবচেয়ে বড় দুঃখ ছিল—সে স্কুলে পড়তে চেয়েছিল, কিন্তু তার জন্য টাকা ছিল না। তার মতো হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে শুধু স্বপ্ন দেখে, কিন্তু কখনো তাদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয় না। একদিন, তার বাবা বলল, "পড়াশোনা দিয়ে কী হবে? যা তুমি করতে পারো, তা হলো কঠোর পরিশ্রম।" কিন্তু মাহফুজ জানতো—একদিন, সে কিছু করবে, অন্যদের থেকে আলাদা কিছু। কিন্তু সে ছিল এক অন্ধকারে, যেখানে স্বপ্নগুলো কখনো ছোঁয়া যায় না।

(২) জীবনের একদম অন্য রূপ

একদিন, যখন মাহফুজের বয়স প্রায় ষোলো, সে সিদ্ধান্ত নিল—কোনো এক উপায়ে শহরে যাবে, যেখানে সুযোগের আলো দেখা যায়। তার কাছে কোনো টাকা ছিল না, কিন্তু সে তার হাল ছাড়ল না। গ্রামের পথ ধরে, সে শহরের দিকে পাড়ি দিল। শহর ছিল বিশাল, উজ্জ্বল, তবে সেই উজ্জ্বলতার পিছনে ছিল এক কঠিন বাস্তবতা। মহামারীর মতো প্রতিযোগিতা, অচেনা মানুষের অদ্ভুত মুখাবলি, এবং এক অদৃশ্য চাপ—মাহফুজ এখানে আসার পর বুঝল, তার জীবন একেবারে নতুন যুদ্ধে প্রবেশ করেছে।

তার প্রথম কাজ ছিল নির্মাণ শ্রমিকের কাজ। সারাদিন কষ্ট করতো, এক লোহার খাঁচে বন্দী হওয়ার মতো অনুভূতি হতো। কিন্তু মাহফুজ জানতো, এটাই তার প্রথম পদক্ষেপ, এখানে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। সে স্বপ্ন দেখতো, একদিন সে এখান থেকে উঠে যাবে, তার মা-বাবার জন্য ভালো কিছু করবে।

(৩) টিকে থাকার লড়াই

কিন্তু শহরে এক কঠিন লড়াই অপেক্ষা করছিল। মাহফুজ প্রতিদিন কাজের মাঝে নিজের শরীরের ওপর অত্যাচার করত, আর রাতে এক নিঃশ্বাসে দুঃখের জমানো স্মৃতিগুলো বয়ে নিয়ে ঘুমাতে যেত। একদিন, যখন সে এক সড়কে হাঁটছিল, তখন দেখল, একটি গাড়ি হঠাৎ থামল। সেই গাড়ি থেকে নামল এক পরিচিত মুখ—শিলা। তার চোখে ছিল এক আশার রশ্মি। শিলা জানালো, তার কাছে একটা কাজের সুযোগ আছে, কিন্তু এক শর্ত ছিল—তার জন্য তাকে বেশ কিছু নতুন দক্ষতা অর্জন করতে হবে। মাহফুজ রাজি হয়ে গেল, কিন্তু সে জানত, তার হাতে কোনো জাদু নেই। শুধুমাত্র কঠোর পরিশ্রম আর ইচ্ছাশক্তি থাকবে।

(৪) আঘাত ও নতুন সূর্য

কিছুদিন পর, মাহফুজ যখন শিলার ব্যবসায় সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করল, তখন একদিন হঠাৎ করেই বিপর্যয় এলো। তার পুরনো সহকর্মীরা গোপনে শিলার ব্যবসায় প্রতারণা করতে শুরু করল। ব্যবসা খুব দ্রুত নীচে চলে গেল, এবং শিলা প্রায় সমস্ত সম্পদ হারিয়ে ফেলল। শহরে মাহফুজের কোনো আশ্রয় ছিল না, সব কিছু ভেঙে পড়ল। একদিকে তার মা-বাবার দুঃখের কথা, অন্যদিকে শিলার ক্ষতি—মাহফুজের মনে এক বিশাল শূন্যতা জন্ম নিল। সে বুঝতে পারছিল না, কী হবে তার পরবর্তী পথ।

একদিন, রাতের অন্ধকারে, শিলা মাহফুজের কাছে এসে বলল, "আমরা যখন হারিয়ে যাই, তখনই আমাদের সত্যিকারের শক্তি বেরিয়ে আসে। কখনো হাল ছেও না। তোমার মধ্যে যে শক্তি আছে, তা আর কাউকেই নেই।"

এই কথা মাহফুজের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত হলো। সে নিজের ভেতরের শক্তি উপলব্ধি করল—এটা তার শেষ সুযোগ। শহরের কঠিনতা তাকে নতজানু করেছে, কিন্তু সেই কঠিন পথেই তার জন্য আলোর পথ খুঁজে নিতে হবে।

(৫) হারানো স্বপ্নের পুনর্জন্ম

তারপর, মাহফুজ আবার নতুনভাবে শুরু করল। একদিনে সে সব কিছু ফিরে পেল না, কিন্তু তার চোখে ছিল এক নতুন অঙ্গীকার। তার সংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে গেল, তবে সে জানতো—এই পৃথিবীতে কেউ কারও জন্য কিছু সহজ করে না। জীবন শুধু ধৈর্য ও সাহসী আত্মবিশ্বাসের ফল।

এবং একদিন, সে বুঝতে পারল, পৃথিবী তাকে কিছু ফিরিয়ে দিয়েছে—তাকে আরো শক্তিশালী করে, আরো পরিপূর্ণভাবে। তার হারানো স্বপ্ন ফিরে পেতে, তাকে শুধু নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

শেষ কথা

মাহফুজ জানতো—জীবন শুধুই দুঃখ বা আনন্দের সমষ্টি নয়, এটি হলো এক অমিত শক্তি, যা বারবার মানুষকে আবার উঠে দাঁড়াতে শেখায়। যতই তার পথে বাধা আসুক না কেন, একদিন সে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল। হারানো স্বপ্নের শঙ্খটা পুনরায় বাজছিল, আর মাহফুজ জানতো—এটাই তার আসল পথ।

Comments

    Please login to post comment. Login