Posts

গল্প

গল্প: ‘অপারগ টেকনোলজি’

February 4, 2025

Akash Ulal

157
View

গল্প: ‘অপারগ টেকনোলজি’ 

(১) শুরুতেই এক ভুঁইফোড় স্বপ্ন

সাবির রহমান—একসময় ছিল যে মফস্বল শহরের একটি ছোটো পরিবারে জন্ম নেয়া সাধারাণ ছেলে। তার বাড়ি ছিল খুবই সাধারণ, বাবা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী, কিন্তু ছোট্ট শহরের গণ্ডিতে আটকে গিয়ে তিনি কখনোই বড় কিছু করতে পারেননি। তবে, সাবিরের চোখে ছিল এক অদ্ভুত আগুন—বিশ্বের সবকিছু নিজের করে নেবার। সে জানত, একদিন তার নাম হবে সবার মুখে মুখে। কিন্তু সেই নামটা সাধারণভাবে হবে না—তাকে 'বিশ্বসেরা' হতে হবে।

ছোট শহরে থাকা অবস্থায় সাবির বুঝতে পেরেছিল, প্রথাগত পথে কিছুই হবে না। শহরের প্রতিটি মানুষের জীবনে যেসব সীমাবদ্ধতা ছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। তাই সে ছুঁতে চাইল এমন কিছু, যা সমাজের নিয়মের বাইরে। শুরু করল প্রযুক্তি নিয়ে কাজ। শহরের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রযুক্তিবিদদের সাথে যোগাযোগ করল এবং জানল—সরকারি প্রকল্পে বড় অংকের টাকা লোপাট করার জন্য এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করা সম্ভব।

অবশেষে, এক গোপন রাত, সাবির তার ‘অপারগ টেকনোলজি’ নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করল—এটি তার জীবনের প্রথম পদক্ষেপ ছিল এক অদ্ভুত শাসন প্রতিষ্ঠা করার দিকে।

(২) সরকারকে ঠকিয়ে স্বপ্নের প্রাসাদ

সাবির খুব দ্রুত সরকারের বড় বড় প্রকল্পগুলিতে ঢুকতে শুরু করল। তার প্রথম লক্ষ্য ছিল: কোনো এক বড় সরকারি প্রকল্পের দুর্বলতা খুঁজে বের করা এবং সেখানে অনৈতিক উপকরণ এবং প্রযুক্তি ঢোকানো। খুব দ্রুত, সে বুঝে গেল—সরকারের ভেতরে একটা অসাধারণ সুযোগ আছে, যেখানে টাকা চুরি করতে গিয়ে কেউ ধরাও পড়বে না।

সে প্রথমে সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ ই-কমার্স প্রকল্পে একটি বেহুদা সফটওয়্যার প্রবেশ করাল, যা খরচ বাড়ানোর পাশাপাশি কার্যকারিতাও ছিল শূন্য। তবে, সাবির এটাকে বিক্রি করল "বিশ্বমানের" সফটওয়্যার হিসেবে। সরকার টাকা দিলো, কিন্তু তার প্রতি বিশ্বাস রাখার কারণে কেউ খেয়ালই করল না, প্রকল্পের কাজ চলছে কতটা খারাপ। সাবির তার মুনাফার শতভাগ ভাগ পেল।

এটি ছিল তার প্রথম বড় ধাপ—এখন সে সরকারের বড় বড় প্রকল্পের সাথে যুক্ত হতে শুরু করল। তার কোম্পানির নাম হয়ে গেল ‘অপারগ টেকনোলজি’। আর সে এভাবে পরিকল্পনা করে, প্রতিটি প্রকল্পে অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ করানোর কৌশল শুরু করল। বিশেষ প্রযুক্তি সরবরাহের নামে তিনি ভুয়া পণ্য এবং পরিষেবা বিক্রি করতে লাগলেন। সে জানতো, সরকার কখনোই তার সাপ্লাইয়ের মান পরীক্ষা করবে না, কারণ প্রকল্পের কাজ ধীরে ধীরে চলছিল।

(৩) যখন বড় হয়ে গেল, তখন আর থামেনি

সাবিরের সাফল্য দিন দিন বাড়তে লাগল। তাকে আর ছোট ব্যবসায়ী হিসেবে ভাবা হচ্ছিল না, বরং সে এখন দেশের শক্তিশালী কিছু সরকারি কর্মকর্তার সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করছিল। তার কোম্পানির আয় বেড়ে গিয়েছিল কয়েক শ কোটি টাকায়। সাবির জানতো, সরকার যতই তার উপর ভরসা রাখুক, তার পকেটেই টাকা ঢুকছে। কিন্তু সে আরও বেশি চাইল। তার সামনে বড় একটা লক্ষ্য ছিল—প্রকল্পের প্রতিটি খরচ বাড়িয়ে পুরো দেশের অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলা।

একদিন, সে সরকারের সবচেয়ে বড় কনস্ট্রাকশন প্রকল্পে আরো বড় এক জালিয়াতি করে ফেলে। এই প্রকল্পে সাবির চুরি করে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু সে তখনও থামেনি। আরও গভীরভাবে সরকারি তহবিলের প্রতিটি খাতে ঢুকতে শুরু করল। তার নতুন কৌশল ছিল—বিশাল এক ঋণসংস্থান প্রতিষ্ঠা করা, যাতে সরকারী প্রকল্পের বড় বড় ঋণ তারা তাকে বিনা পয়সায় সরবরাহ করে।

(৪) দুর্দিনের আগমনী বার্তা

যদিও সাবির দুনিয়ার শীর্ষে পৌঁছেছিল, কিন্তু তার এই একনায়কত্ব আর জালিয়াতি দীর্ঘকাল টিকল না। একদিন, এক অজানা সূত্র থেকে সরকার তার সমস্ত কার্যক্রমের উপর নজর রাখা শুরু করল। সুনির্দিষ্ট সূত্র পাওয়া গেল—যেখানে তার কোম্পানি এবং সরকারের মধ্যে আদান-প্রদান ছিল সম্পূর্ণ ভুয়া। সাবিরের সমস্ত টেকনিক্যাল সিস্টেমে জালিয়াতি ধরতে পারল। কিন্তু সাবির খুবই সজাগ ছিল। সে জানত, এমন সময় আসবে যখন তার পতন হবে, কিন্তু সে তখনও বিশ্বাস করত—পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই সে পালিয়ে যাবে।

(৫) খোঁজ আর ধরা পড়ার মুহূর্ত

তবে, একদিন সবকিছু একেবারে ভেঙে পড়ল। পুলিশ সাবিরের হদিস পেয়ে গেল এবং তার কোম্পানির সবকিছু বাজেয়াপ্ত করল। সাবির বুঝতে পারল, এবার তার পালানোর পথ শেষ। সরকার তার বিরুদ্ধে সমবেত অভিযোগ এনেছে—তার বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতি, জালিয়াতি এবং অর্থ পাচারের মামলা। এক রাতের মধ্যে সাবির যে স্বপ্নে চলছিল, তা হঠাৎ এক মহাপ্রলয়ের মতো ভেঙে পড়ল।

এবং তার পর, দেশের জনগণ দেখতে পেল, এক সময়ের প্রযুক্তির রাজপুত্র আজ হোশিয়ারি এবং বিশ্বাসের খেসারত দিতে গিয়ে একেবারে শেষ। তার কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেল, সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত হল, এবং সাবিরের বিরুদ্ধে চলতে লাগল এক দমনের খেলা।

(৬) শেষ কথা

এটি ছিল সেই প্রতারকের গল্প, যিনি একসময় দেশের শীর্ষে উঠে গিয়ে সরকার এবং জনগণের বিশ্বাস ভেঙে ফেলেছিল। কিন্তু, ইতিহাস শিখিয়েছে—অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থ কখনোই স্থায়ী নয়। সাবিরের গল্পে একটি শিক্ষা রয়েছে, যে ক্ষমতার জন্য মানুষ কখনো নিজের সততা এবং নীতি বিসর্জন দিতে পারে, তবে একদিন তাকে সেই ভুলের পরিণতি ভোগ করতেই হয়।

Comments

    Please login to post comment. Login