গল্প: ‘অভাবের ছায়া’
(১) একটি দুঃখের জন্ম
রাজু জানতো, তার জন্ম হওয়া মানেই কষ্ট। এক ছোট্ট গ্রামে, যেখানে দিন শেষে খাবারের ঠিকানা ছিল না, সে বড় হচ্ছিল। বাবা ছিল কৃষক, মা ছিল ঘরের কাজের মানুষ। তবুও, তাদের জীবন ছিল সংগ্রামী। কেউ জানতো না, রাজুর মনের মধ্যে অদম্য এক স্বপ্ন ছিল—“একদিন এই কষ্টের জীবন পালটে যাবে।” কিন্তু কীভাবে? সে জানতো না। তার চোখের সামনে ছিল শুধু এক অভাবী পৃথিবী, যেখানে রাতের অন্ধকার আর দিনের ক্লান্তি ছাড়া কিছুই ছিল না।
রাজু কখনোই হার মানতে চায়নি। সে বিশ্বাস করতো, পৃথিবী তার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে, যেখানে তার স্বপ্ন ছোঁয়ার আশা ছিল, সেখানে আরও গভীর দুঃখের ছায়া পেত। জীবন যেন তাকে প্রতিটি মুহূর্তে জানিয়ে দিচ্ছিল, “তুমি এখানে নেই, তুমি এখানে থাকতে পারো না।”
(২) সেলিম স্যারের প্রলোভন
একদিন, রাজুর জীবনে এমন একটি মুহূর্ত এলো, যা তার পুরো জীবন বদলে দিল। গ্রামের পাশের বাজারে সেলিম স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেলিম স্যার ছিল এক কালো চরিত্র, যার মুখে একটা মিষ্টি হাসি থাকলেও, তার হাত ছিল ডুবে মিথ্যা, প্রতারণা আর অপরাধের সাগরে। সেলিম স্যার জানতো, রাজুর মত একটা সহজ সরল ছেলে, যে কোনো প্রলোভনে সহজেই পড়ে যেতে পারে।
সেলিম স্যার বলল, “তুমি যদি আমার কাজ শুরু করো, তোমার সমস্ত সমস্যা শেষ হয়ে যাবে। তুমি কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসবে, তোমার পরিবার সুখী হবে। শুধু আমার কিছু কাজ করো, তারপর দেখো কীভাবে তোমার জীবন বদলে যায়।”
রাজু, যে প্রতিদিন শুধু অভাব আর অন্ধকারের মধ্যে ডুবে থাকতো, সেলিম স্যারের কথাগুলো শোনার পর নিজেকে ভেবেছিল—এটাই তার জীবনের একমাত্র সুযোগ। তাকে বুঝতে হয়নি, সেলিম স্যারের প্রলোভন ছিল একটা ভয়ংকর জাল। রাজু সেই জালে প্রথম পা রেখেছিল, বিশ্বাস করেছিল যে এই পথে তার পরিবার একদিন সুখী হবে। সে জানত না, যে পথ সে বেছে নিচ্ছে, সেই পথ একদিন তাকে শেষ করে দেবে।
(৩) প্রথম লাভ, তারপর বিপদ
প্রথম কয়েকদিন রাজু খুব সাবধানে কাজ শুরু করেছিল। টাকা আসছিল, আর তার জীবনের দিনগুলো কিছুটা স্বাভাবিক হচ্ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে, সে বুঝতে পারল, সেলিম স্যারের ব্যবসা নাকি শুধুমাত্র টাকা রোজগারের মাধ্যম ছিল না, বরং একটা ভয়ানক অপরাধের দুনিয়া ছিল—যেখানে মাদক, চোরাচালান, সরকারী অর্থের লুট সব কিছু চলছিল। কিন্তু রাজু তখন পুরোপুরি ওই অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল।
প্রথমবার রাজু যখন সেলিম স্যারের কথামত অবৈধ মালপত্র শহরের বাজারে নিয়ে গেল, তখন তার মনে ছিল এক অদ্ভুত উত্তেজনা। মনে হয়েছিল, সে যেন কোনও বিপদগ্রস্ত পৃথিবীকে জয় করে এসেছে। তবে, সেই উত্তেজনা ছিল এক মিথ্যা সুখ, যা কিছুদিন পরেই তার জীবনে ভয়ানক বিপর্যয় নিয়ে আসবে।
(৪) পাপের পরিণতি
দিন যেত, আর রাজু তার কাজ আরো গভীরভাবে করতে থাকল। একদিন, তার ভুলটা ধরা পড়ল। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে, রাজু যখন জেলে বন্দী হলো, তখন তার জীবন যেন একদম শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে জানতো, তার সাথে প্রতারণা হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কষ্ট ছিল, সে নিজের পরিবারের চোখে পড়লো একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। মা-বাবা, যারা তার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেছিল, তারা জানল, তাদের ছেলে আসলে অপরাধী।
গ্রামে যখন রাজুর পরিচয় ফাঁস হলো, সবাই তাকে ঘৃণা করতে লাগল। তার পরিবারের মুখে, যা একসময় ছিল গর্ব, তা এখন ছিল চুপ চাপ কষ্ট। রাজু বুঝতে পারল, তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল সেই এক মুহূর্তের সিদ্ধান্ত—অভাবের কারণে সৎ পথে না চলা, ভুল পথে পা রাখা।
(৫) শুদ্ধির পথ
জেলখানায় কাটানো প্রতিটি দিন ছিল রাজুর জন্য এক নতুন শিক্ষা। সে জানতো, একবার যদি জীবনে ভুল পথে পা রাখা হয়, তবে সেই ভুলের পরিণতি তাকে এক জীবন্ত শাস্তি দেয়। তবে, সে বিশ্বাস করতো যে, পরিশুদ্ধ হতে পারলে সে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে। সে শপথ নিয়েছিল, জীবনের বাকি দিনগুলো সে সৎভাবে কাটাবে।
রাজু জেল থেকে মুক্তি পেয়ে যখন গ্রামে ফিরে এলো, তার চেহারা ছিল পাল্টে যাওয়া, কিন্তু তার হৃদয় ছিল ভাঙা। সে জানতো, এবার সে শুদ্ধ হতে চায়, আর নতুন করে জীবন শুরু করবে। রাজু আবার মাঠে ফিরল, তার পরিশ্রমী জীবনে, আর গ্রামের যুবকদের সতর্ক করতে লাগল—অভাব কোনো দিন ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু সে পথ কখনোই সুখের পথ নয়।