পোস্টস

পোস্ট

উত্তরাধুনিক-ডিজিটাল যুগের কবিওয়ালারা!

১৮ মে ২০২৪

Abdullah Noman

যাঁরা কবিগান গাইতেন তাঁদেরকে বলা হতো কবিওয়ালা বা কবিয়াল। আঠারো শতকের শুরুতে গোঁজলা গুঁই নামের এক কবিওয়ালার হাত ধরে কবিগানের উদ্ভব। এই কবিগান হলো উপস্থিত কবিতা গাওয়ার এক ধরনের প্রতিযোগিতা। দুটি দলের দুজন কবিওয়ালা প্রতিযোগিতায় মুখে মুখে কবিতা তৈরি করে তাতে তাৎক্ষণিক সুর দিতেন। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ছোটো করে জয়ী হওয়াটাই ছিল কবিগানের প্রতিযোগিতা।

উনিশ শতকে এই কবিগান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সে সময়ের কয়েকজন নামকরা কবিওয়ালা ছিলেন- হরু ঠাকুর, নিতাই বৈরাগী, ভোলা ময়রা, এন্টনি ফিরিঙ্গি প্রমুখ। এঁদের মধ্যে ভোলা ময়রা ছিলেন রসগোল্লার উদ্ভাবক নবীনচন্দ্র দাসের শ্বশুর। আর এন্টনি ফিরিঙ্গি ছিলেন জাতিতে পর্তুগিজ। তিনি একটা কবিগানে লিখেছেন—
                   ‘আমি ভজন সাধন জানি নে মা,
                               নিজে ত ফিরিঙ্গি;
                       যদি দয়া করে কৃপা করো,
                               হে শিবে মাতঙ্গী!’

যাঁরা ভ্রূ কুঁচকে এই পর্যন্ত পড়েছেন এবং শিরোনাম দেখে ভাবছেন— এই লেখাটা পাণ্ডিত্য প্রদর্শনমূলক রস-কষহীন প্রবন্ধধর্মী কোনো লেখা, তাঁরা ভ্রূ স্বাভাবিক করতে পারেন। আমার এই কথার কারণ উত্তরাধুনিক-ডিজিটাল যুগের কবিওয়ালাদের পরিচয় বর্ণনা করলেই বুঝবেন। 

 ‘কবি’ শব্দটির প্রচলিত সাধারণ অর্থের বাইরেও আরেকটি অর্থ আছে। বিশেষ করে আমাদের যশোরে গালাগালি করা অর্থে ‘কবি গাওয়া’ শব্দযুগল বহুল প্রচলিত। এই উত্তরাধুনিক-ডিজিটাল যুগে জাকারবার্গের নীল দুনিয়ায় বাঙালির গালাগালি করার অশেষ পারঙ্গমতা দেখে আমার মনে হয় ‘কবিওয়ালা’ হলো তারাই যারা কবি গাইতে অর্থাৎ গালাগালি করতে ওস্তাদ। 

ফেসবুককে বলা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম; কিন্তু বাঙালির হাতে ফেসবুক হয়ে উঠেছে অসামাজিক গালাগালি মাধ্যম। বন্ধুতালিকায় বাবা-মা থাকলেও আমাদের উত্তরাধুনিক-ডিজিটাল যুগের কবিওয়ালারা গালি দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। যেন গালি দেওয়াটাই জীবনের একমাত্র সার্থকতা। 

গালি দেওয়ার জন্য উত্তরাধুনিক-ডিজিটাল যুগের কবিওয়ালাদের কোনো উপলক্ষ্য লাগে না। মেসি ভালো খেলেছে, রোনালদো হ্যাট্রিক করেছে, তাসকিন বাপ হয়েছে, সাকিব বউয়ের সাথে মেয়েকে ছাড়া ছবি তুলেছে, রাষ্ট্রপতি প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে কথা বলে মজা করেছে— এ রকম যেকোনো বিষয়কে ইস্যু বানিয়ে গালি দিতে তারা বিশেষ পারদর্শী। কোনো ইস্যু না থাকলেও বাউলের অমুক-তমুক ভালো লাগে না বলে তারা গালি দিয়ে স্ট্যাটাস প্রসব করে বসে থাকবে। 

সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা হলো— কমেন্টে কমেন্টে গালির প্রতিযোগিতা। আমার ধারণা জাকারবার্গকে যদি কষ্ট করে একবার বাংলা শিখিয়ে দেওয়া যায় তাহলে বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ হয়ে যাবে। 

একটা গালিময় কৌতুক দিয়ে শেষ করি—

আবাহনী-মোহামেডান খেলা হচ্ছে। মোহামেডানের স্ট্রাইকার সুদূর উগান্ডা থেকে আগত। বেচারা গোলমুখে বারবার বল পেলেও গোল দিতে পারছে না। প্রতিবারই বল বাইরে মারছে। তাই দেখে মোহামেডানের অধিনায়ক গেল রেগে। রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে সে উগান্ডা থেকে আগত স্ট্রাইকারকে গালি দিয়ে বসল- বাউল, কী খেলিস এসব! (আপনারা বাউলের জায়গায় নিজেদের পছন্দের গালি বসিয়ে নিন। ) গালি শুনে স্ট্রাইকার অবাক হয়ে ভাবল— কী বলে লোকটা। যাইহোক, খেলাশেষে সে অধিনায়কের কাছে জানতে চাইল— তুমি তখন আমাকে বাউল বললে কেন? অধিনায়ক ভাবল— তখন রাগের মাথায় ব্যাটারে বাউল বলছি, এখন তো আর বাউলের অর্থ বলা চলে না। তখন সে বুদ্ধি করে বলল, ‘আরে, তুমি মোটাসোটা বলে তোমাকে বাউল বলেছি; বাউল হলো মোটাসোটা ব্যক্তি।’ 

অধিনায়কের কথা শুনে উগান্ডার স্ট্রাইকার হো হো করে হাসতে হাসতে বলল, ‘আরে, আমি আর কী বাউল; আমার বাপ ইয়া বড় বাউল‍!’

উত্তরাধুনিক-ডিজিটাল যুগের কবিওয়ালাদের অবস্থাও এখন ইয়া বড় বাউলের মতোই। তাই যদি না হয়, তাহলে এত ভয়ংকর সব অশ্লীল গালি এরা বিনা দ্বিধায় দেয় কীভাবে!