Posts

চিন্তা

বুলডোজার সংস্কৃতি আমাদেরকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে!

February 7, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

41
View

হাসতে হাসতে ক্রোধোন্মত্ত যারা বুলডোজার সংস্কৃতি চালু করে দিলেন। পরম্পরাগত পরিবর্তনের ধারায় এর বিষাক্ত ফণা থেকে কারো রেহাই মিলবে না। কখনো এপক্ষ বুলডোজার খাবে, কখনো খাবে ওপক্ষ। কাজেই ধ্বংসের সংস্কৃতি বদলে দিয়ে প্রেম ও মায়া-মমতার সমাজ কায়েম করতে হবে। সভ্যতার আদি ও চিরায়ত সুত্র এটাই। 

বুলডোজার সংস্কৃতি যে প্রতিহিংসার এক দুষ্টচক্র তৈরি করবে, তা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। কাজেই ধ্বংস নয়, প্রেম ও মমতার ভিত্তিতে সমাজ গঠনের আহ্বানই নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী। সভ্যতার স্থায়িত্ব ও মানবিকতার বিকাশের জন্য এটাই সত্যিকারের পথ। 

'বুলডোজার সংস্কৃতি'র ধারক ও বাহক হয়ে যদি কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ির মতো ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করতে চায়, তাহলে সেটি নিছক একটি ভবন ভাঙার ঘটনা নয়, বরং এর মাধ্যমে স্বাধীনতার ইতিহাস ও জাতির আত্মপরিচয়ের ওপর সরাসরি আঘাত হানা হয়। এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ, যেখানে প্রতিপক্ষের চিহ্ন মুছে ফেলার মাধ্যমে ইতিহাসকে বিকৃত করার অপচেষ্টা চলে। 

বিভিন্ন দেশে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক বিদ্বেষের কারণে ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস করার প্রবণতা তৈরি হয়। মধ্যপ্রাচ্যে আইএস জঙ্গিগোষ্ঠী শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য ধ্বংস করেছে, আফগানিস্তানে বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ভারত-পাকিস্তানে মসজিদ-মন্দির নিয়ে সহিংসতা ঘটেছে। বাংলাদেশেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করতে ইতিহাসবিধ্বংসী পদক্ষেপের নজির রয়েছে। 

ধ্বংসের সংস্কৃতির বিপরীতে প্রেম, মায়া-মমতা, সংহতি ও সহনশীলতার ভিত্তিতে সমাজ গঠন করা জরুরি। স্বাধীনতাকামী শেখ মুজিবের আদর্শও এই নীতি অনুসরণ করেছিল—তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর শাসনকাল নিয়ে বিতর্ক আছে। তিনি পরিবার, স্বজনসহ নিজের জীবন দিয়ে সেই ভুলের খেসারত দিয়েছেন। তারপরও আবার কেন বুলডোজার? 

ইতিহাসের শিক্ষা হলো, যারা প্রতিহিংসার বুলডোজার চালায়, তারাই একদিন সেই ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়। একে রুখতে হলে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং প্রেম, মানবতা ও সত্যের শক্তিকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়ি ধ্বংসের ঘটনা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করল। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে এই ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়, যেখানে সরকারের নীরব সম্মতি ছিল বলে অভিযোগ উঠে। 

বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটি শুধু একটি স্থাপনা নয়, বরং জাতির সংগ্রাম, ত্যাগ ও অর্জনের প্রতীক। এই বাড়ি ধ্বংসের মাধ্যমে একটি বিশেষ গোষ্ঠী ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মুছে ফেলার চেষ্টা করল, যা সামাজিকভাবে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড সমাজে বিভাজন ও বিদ্বেষ বাড়িয়ে দেয়, যা সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। 

ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস করা মানে একটি জাতির স্মৃতি ও পরিচয়কে আঘাত করা। এটি প্রতিহিংসা ও অসহিষ্ণুতার চর্চা, যা সমাজে সহমর্মিতা ও সহনশীলতার বিপরীত। এ ধরনের কর্মকাণ্ড সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয় ও মূল্যবোধের সংকটকে প্রকট করে তোলে। 

বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ি ধ্বংসের ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রতিহিংসা ও ধ্বংসের পথ সমাজকে অগ্রগতির বদলে পশ্চাদপসরণে নিয়ে যায়। সামাজিক ও দার্শনিকভাবে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানানো উচিত এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সমাজের সকল স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। 

বুলডোজার সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় এরপর আসবে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহিদ মিনার কিংবা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বিলীন করবার উদগ্র খায়েশ। আমরা সেই বেপরোয়া বাসনাকে আর কি থামাতে পারব? 

৩২ নাম্বার বাড়ি ভাঙার প্রতিক্রিয়া এসেছে রাষ্ট্র ও সামাজিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের তরফে। 

জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে জানিয়েছে, ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে৷ আগে থেকে ঘোষণা দেওয়ার পরও বাড়িটি রক্ষায় সরকারের উদ্যোগ না থাকায় হতবাক হয়েছেন বিশ্লেষকেরা৷ 

বৃহস্পতিবার সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত৷ পলাতক অবস্থায় ভারতে বসে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের কারণে জনমনে গভীর ক্রোধের সৃষ্টি হয়েছ যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে৷ 

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ফিরোজ আহমেদ তাঁর এক ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ‘‘আজকে যারা যারা এই কাজটা করেছে, যারা যারা এই কাজের উসকানি দিয়েছে, যেই হোক না কেন সে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া ইউনূস সরকারের কর্তব্য৷'' তিনি লিখেছেন, ‘‘বৈধ হিসেবে মনে করেন এমন একটা সরকারের অস্তিত্ব থাকলে কোনো ভবনে বুলডোজার চালানো কিংবা আগুন দেয়া কিংবা ভাঙচুর সন্দেহাতীতভাবেই ফৌজদারি অপরাধ৷'' 

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘‘এত বড় গণঅভ্যুত্থানের বিষয়ে পতিত স্বৈরাচারের কোনো অনুশোচনা নাই৷ তারা দেশের বাইরে বসে নানা ধরনের উসকানি দিচ্ছে৷ এই বিষয়ে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ অন্যান্য বিষয়ে সরকার উদাসীন৷'' 

এই প্রেক্ষাপটে বুধবার রাতে বিশেষ করে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জায়গা ৩২ নম্বরসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ঘোষণা দিয়ে হামলা চালানো হলো৷ এটা অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্খিত৷ এটা দেখে যেন মনে হয় দেশে কোনো সরকার নাই৷ এই দায় সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না৷ আমরা দাবি করি সরকার এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে,'' বলেন তিনি৷ 

সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, ‘‘যা ঘটলো তা দেখে আমার মনে হয়েছে দেশে কোনো সরকার আছে কিনা৷ ৫ আগস্টের পর যদি ঘটত, তখন কোনো সরকার ছিলো না৷ কিন্তু এখন ছয়মাস পর সরকার আছে৷ তারা কী করেছে?'' তিনি বলেন, ‘‘মানুষের মনে ক্ষোভ থাকতেই পারে৷ কিন্তু দেশে একটা সরকার থাকা অবস্থায় এই পরিস্থিতিতে তো সরকারের একটি ভূমিকা থাকতে হবে৷ তাতো আমি দেখতে পাচ্ছি না৷ এমন মনে হচ্ছে তোমরা যার যা খুশি করো আমি (সরকার) কোনো ব্যবস্থা নিবো না৷ কিন্তু মানুষের জানমালের নিরাপত্তাতো দিতে হবে৷ সরকার যদি মনে করে ওই স্থাপনাগুলো ভেঙে দিতে হবে, আইনগতভাবে তা করুক৷ কিন্তু ছাত্রদের উসকে দিয়ে এটা কেন করালো? এটা একটা টেকনিক৷ একজন ফাঁসির আসামিরও জীবনের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের৷ এই সরকার দিয়ে আমি কী করব?''
মাসুদ কামাল বলেন, ‘‘শেখ হাসিনার এই সময়ে ভারতে বসে এই সময়ে ভাষণটা দেয়া ঠিক হয়নি৷ তার ভাষণে কী এমন আছে? আমি তো শুনেছি৷ তার এই হঠকারীমূলক কাজ করা ঠিক হয়নি৷'' 

মানবাধিকার কর্মী নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমি স্তম্ভিত৷ আমার কোনো ভাষা নাই এই বিষয়গুলোর ওপর মন্তব্য করার৷ মানুষ অধিক শোকে পাথর যখন হয় তখন সে স্তম্ভিত হয়৷'' তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হয়েছে এখানে রাষ্ট্রের তরফ থেকে উদ্যোগের অভাব আছে৷ ৫ আগস্টের পর একটা পরিস্থিতি ছিলো৷ তখন দেশে সরকার ছিলো না৷ এখন আছে৷ যা কিছু ঘটেছে তা কোনোভাবেই কাম্য ছিলো না৷'' 

উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তাঁর ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘‘আমরা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক আধিপত্যবাদ মোকাবিলা করছি৷ নিছক কিছু মূর্তি বা দালান নয়৷ মূর্তি না ভেঙে আমাদের উচিত আমাদের শত্রুদের শক্তির বিপরীতে পাল্টা চিন্তা, শক্তি ও হেজেমনি গড়ে তোলা৷ ভাঙার প্রকল্প থেকে সরে এসে দিনকে দিন আমাদের গড়ার প্রকল্প হাতে নেওয়া উচিত৷'' 

এখনো সময় আছে। ভাঙাভাঙি বা জ্বালাও পোড়াও এর মধ্যে না গিয়ে দায়িত্বশীলদের করণীয় হলো, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ব্যাপক প্রাণহানিতে দায়িদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠ আইনি কার্যক্রম ও শাস্তি নিশ্চিত করা। দেশে নৈরাজ্য দূর করা না গেলে ভোটের পরিবেশ ফিরবে না। আর যথাশীঘ্র অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে দেশের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র সমুন্নত ও সুসংহত হবে না। 

লেখক: সাংবাদিক
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login